ভারতে আবারো ঘটে গেল একটা ধর্ষণের ঘটনা৷ আসলে নারী-পুরুষের ‘বাইনারি সিস্টেম' শুরু করার সময়েই হয়ত বিধাতা জানতেন, গোলমাল বাঁধবে৷ অথচ তাঁর সৃষ্ট প্রণালীতে দ্বন্দ্বের জন্য জায়গা রাখা ছিল তা ঠিক৷ কিন্তু তা কখনোই নীচতার জন্য নয়৷
বিজ্ঞাপন
ইস্কুলে থাকতে আমরা বলতাম ‘বুলি', অর্থাৎ যে ছেলেটি গায়ের জোর দেখিয়ে তার চেয়ে যারা দুর্বল, তাদের উপর কর্তৃত্ব কিংবা অত্যাচার করে৷ সেই ধরনের তিনটি ‘বুলি' যদি বেঙ্গালুরুর বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকা একটি তরুণীকে মিনিবাসের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে রেপ করে, তাহলে আমাদের সেই বারো'শ ছাত্রের ছেলেদের স্কুল হলে তাদের আর...
ছেলেদের স্কুলে এক ধরনের ‘থিভস হনার' বা চোরেদের সম্মানজ্ঞান থাকে৷ সেই সম্মানজ্ঞানই আমাদের বলে দিত, মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে নেই৷ তুললে মেয়েদের – এবং মায়েদের – যতটা বিরাগভাজন হবো, তার চেয়ে বেশি ঠাট্টা শুনতে হবে সহপাঠী এবং ফুটবল টিমের অন্যান্য সতীর্থদের কাছ থেকে৷ সে আমলে – সে অনেকদিন আগের কথা – পুরুষমানুষ হবার সংজ্ঞাই ছিল মেয়েদের উপর জোরজার না করা৷ নয়ত যে এই পোড়া পৃথিবীর কতো সুন্দরীকে যে স্রেফ গায়ের জোরে নিজের প্রেমে পড়িয়ে ফেলতাম – যাক, সে দুঃখের কথা বলে আর কী হবে?
কেন এত ধর্ষণ? কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ?
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/DW
উন্নত বিশ্বের নারীরাও রেহাই পান না
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ধর্ষিতা নারীরা জানাতে ভয় পান
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷ তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ছবি: detailblick/Fotolia
ধর্ষককে ধরার জন্য দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় – এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷ গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷ নারীর শরীরে নখের আচড় বা খামচি থাকলে ধর্ষকের চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Ruettinger
যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের জন্য জরুরি বিভাগ
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে৷ তাছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্রুপ থেরাপি
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে গ্রুপ থেরাপি, যার সাহায্যে নারীরা আবার সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সহজে ভুলে যেতে পারেন৷
ছবি: dpa
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ হয় বাড়িতেই
ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷ তাই আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ চলতি বছরের গত আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷ অর্থাৎ নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
সঠিক বিচার চাই
২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণধর্ষণ ঘটনার পর, ভারতে ঘটা করে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়ে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ দমনে আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হয়৷ শাস্তির বিধান আরো কঠোর করা হয়৷ কিন্তু তাতে যৌন অপরাধের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/abaca
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ছ’মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ করে ধর্ষণ এবং পরে হত্যার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৷
ছবি: DW
নারীর পোশাকই কি ধর্ষণের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন৷’’ পুলিশের কর্মকর্তার দাবি, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বখাটে ছেলেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷’’ এ কথা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার নয়, ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই এরকম৷ ধর্ষণ বন্ধ করতে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
ছোট বেলা থেকে সচেতন করতে হবে
ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷ তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ ধর্ষিতা নারীকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়, সে সম্পর্কেও সচেতনতা দরকার৷ অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে৷ ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
11 ছবি1 | 11
মোট কথা, নারী-পুরুষের সমতা মানে যে নারীরা সবাই কারাটে শিখে ‘টুম্ব রেডার'-এর মতো পুরুষদের পিটিয়ে ঠান্ডা করবেন, এমন নয়৷ যেমন নারী-পুরুষের একটা ব্যবধান মেটারনিটি লিভ আর পেটারনিটি লিভের মধ্যে থেকে যাচ্ছে৷ ভয় পেলে আমরা – পুরুষরা – বলি, ‘‘ওরেঃ বাবা!'' কিন্তু চোট লাগলে বলি, ‘‘মা গো৷'' এ-ও এক ফান্ডামেন্টাল ডিফারেন্স৷ নারীর প্রেমে পড়ায়, কামনা করায় কোনো দোষ নেই, কেননা সেটা বিধাতার সৃষ্ট সফটওয়্যারের অঙ্গ৷ কিন্তু জোর করে নারীর সঙ্গ আদায় করার প্রচেষ্টার সঙ্গে একমাত্র তুলনা করা যেতে পারে – মনে পড়ছে হাস্যরসিক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সেই ‘মধুলিড়' গল্পের ফুলপ্রেমী ভদ্রলোকের কথা, যিনি ফুল খেতে ভালোবাসতেন, নানারকম ফুলের রান্না জানতেন৷ অথবা ধরুন বাড়িতে লোকজনকে নেমন্তন্ন করে তাদের কাঁচা মাংস খেতে দিলেন – হোয়াই নট? বাঘ-সিংগিরা তো তেমনই খেয়ে থাকে৷ বাইসন, পাহাড়ি ছাগল কিংবা হাতিসিলদের মধ্যে ধরতে গেলে প্রতিটি যৌন সম্পর্কই তো রেপ৷
প্রতি যুগে নারী-পুরুষের সম্পর্ক বদলায়৷ প্রস্তরযুগে নারী-পুরুষের যে সম্পর্ক ছিল, আজ সে সম্পর্ক থাকতে পারে না৷ কিন্তু সভ্যতা হল পৃথিবীর মতো, ওপরের একটা আস্তরণ, তার নীচেই লাভার মতো বইছে নানা প্রবৃত্তি৷ সেই প্রবৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব যেমন ব্যক্তির, তেমনই সমাজের বা সরকারের৷ রেপ-এর ঘটনা একক হলেও, তার তাৎপর্য সার্বিক: ধর্ষণের অর্থ সমাজে কোথাও একটা, কিছু একটা ভীষণভাবে ভুল হচ্ছে অথবা হয়েছে৷ উপমহাদেশে নারীর মূল্যায়ন এখনও অংশত পড়ে আছে প্রস্তরযুগে৷ বলতে কি, শুধু উপমহাদেশেই নয়৷ ইউরোপে আজও ৬২ শতাংশ নারী নাকি জীবনের কোনো না কোনো সময় শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হন৷
স্কুলে পড়ার সময় যখন প্রথম তিনটে দাড়ি বের হলো আর মেয়েদের বিরক্ত করা শিখলাম, তখন প্রায়ই শুনতাম: ‘অসভ্য!' আজ বুঝি, কথাটা কত সত্যি৷ তবে সেই সঙ্গে এ-ও বলি, ‘‘সভ্য হতে জীবন কাটলো বটে, তবে নীচ কোনোদিন হইনি, ধর্মাবতার৷ সেটাই বা কম কিসের?''
আপনি কি অরুণ শঙ্কর চৌধুরীর সঙ্গে একমত? জানান নীচের মন্তব্যের ঘরে৷