ভারতে পণপ্রথার কারণে নববধূর মৃত্যুহার বিশ্বে সর্বাধিক৷ ২০১৫ সালে ৭৬ হাজারেরও বেশি নববধূকে পুড়িয়ে মারা হয় কিংবা নির্যাতনের মুখে আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়৷ অভিযুক্তদের মাত্র ৩৫ শতাংশের সাজা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বরপক্ষের দাবিমতো পণ না দিতে না পারার কারণে গোটা ভারতে প্রতিদিন গড়ে প্রাণ হারাতে হয় ২০ জন নববধূকে৷ রাজধানী দিল্লিতেই গত কয়েক বছরে পণপ্রথার কারণে প্রাণ হারান ৭১৫ জন নববধূ৷ এই সংখ্যা ক্রমশই উর্ধ্বমুখী৷ এ বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত পণ সংক্রান্ত কারণে ১০৫ জন নববধূর প্রাণ হারান৷ এই কুপ্রথা এক সামাজিক সংক্রমণের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এখানে ধনী-দরিদ্র নেই, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বা শহর-গ্রামের প্রশ্ন নেই৷ মানুষের অর্থলোলুপতাই একমাত্র কারণ বলে মনে করেন সমাজবিদরা৷ শুধু তাই নয়, পরিবারের সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে গয়না, নগদ অর্থ কিংবা বিলাসবহুল গাড়ি থেকে জমি, গরু, মহিষ কিছুই বাদ যায় না৷ না দিলে সমাজে বরপক্ষের মান থাকে না– এই ধরনের মানসিকতা এর পেছনে কাজ করে৷
জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু, মুসলিম সব সমাজেই পণপ্রথা পারিবারিক হিংসার এক বড় কারণ৷ পাকিস্তান বা বাংলাদেশেও তা বাড়ছে বলে সংবাদ মাধ্যমের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, যদিও মুসলিম ধর্মে পণপ্রথা নিষিদ্ধ৷
লাভ ম্যারেজ বা প্রেম করে বিয়ে কেন করবেন
সম্মন্ধ করে বিয়ে ভালো নাকি প্রেমের বিয়েতেই বেশি সুখ? এ নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে৷ তবে আজকের যুগে বিয়ে করার আগে হবু স্বামী বা স্ত্রী কেন পূর্ব পরিচিত হওয়া দরকার বা প্রেম করে বিয়ে করার সুবিধাগুলো কী জেনে নিন৷
ছবি: Fotolia/Maridav
পছন্দ বা ভালো লাগা
বিয়ে শুধু দু’টি মানুষের মধ্যে নয়, দু’টি পরিবারের মধ্যেও নতুন সম্পর্কের সূচনা করে৷ তাই নব দম্পতির অনেকটা সময় চলে যায় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হতে৷ নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের খবর নেয়ার তেমন সুযোগ পান না তাঁরা৷ ফলে দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হতে পারে৷ কিন্তু বিয়ের আগে প্রেম বা বন্ধুত্ব থাকলে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে কম, দাম্পত্যজীবনও হয় মধুময়৷ আর পরবর্তীতে উপহার নির্বাচনেও অসুবিধা হয় না৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/McPHOTO
একে অপরের প্রতি বিশ্বাস
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মূল ভিত হলো বিশ্বাস৷ বিশ্বাস ছাড়া কখনো সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়৷ আর বিয়ের আগে, অর্থাৎ মন দেয়া-নেয়ার সময় একে-অপরের প্রতি বিশ্বাসের প্রমাণ দেওয়া বা পাওয়ারও যথেষ্ট সুযোগ থাকে৷ সুযোগ থাকে অন্যজনের ভালো লাগা-মন্দ লাগা, চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে জানারও৷
ছবি: AV/Fotolia
ভুল-ক্রুটি বা দূর্বলতা
প্রতিটি মানুষই ভুল করে৷ প্রত্যেকের মধ্যেই থাকে নানা ক্রুটি বা দূর্বলতা৷ কিন্তু বিয়ের পরে, হঠাৎ করে এ সব জানার পর অনেক দম্পতির মধ্যেই হতাশার জন্ম নেয়৷ কেউ-ই ‘পারফেক্ট’ নয় – কথাটা যেমন ঠিক, তেমনই বিয়ের আগে এ সমস্ত কথা জানা থাকলে একে-অপরের ক্রুটিগুলো মেনে নেওয়া সহজ হয় বৈকি!
ছবি: Fotolia/ArTo
ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই
আজকের যুগের বিয়ের পর অনেক দম্পতির ভেতর তাদের পুরনো প্রেম নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকে৷ কিন্তু প্রেম করে বিয়ে করলে এর কোনো সুযোগ থাকে না৷ বরং স্বামী-স্ত্রীর বুন্ধদের মধ্যে অনেকেই পূর্ব পরিচিত বা ‘কমন ফ্রেন্ড’ হওয়ায় আধুনিক জীবনযাপন আরো সহজ হয়৷
ছবি: picture alliance/Arco Images GmbH
পারিবারিক কলহ এড়াতে...
বিয়ের পর দুই পরিবারের মধ্যে যৌতুকের মতো নানা কারণে যে কলহ বা ভুল বোঝাবুঝি হয়, তা এড়ানো সম্ভব যদি আগে থেকেই ছেলে-মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব বা প্রেম থাকে৷ কারণ প্রেম করে বিয়ে হলে পরিবারের বড়রা সাধারণত এ সব ব্যাপারে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করেন৷
ছবি: Fotolia/Sven_Vietense
বিশেষজ্ঞের মত
জার্মানি বা ইউরোপের দেশগুলোতে সাধারণত ভালোভাবে পরিচয়ের পরই মানুষ বিয়ে করে বা অনেকে না করেও একসাথে বসবাস করে৷ তবে বিয়ের আগে একে-অপরের পছন্দ-অপছন্দ, সখ, ইচ্ছে – এ সব খুব ভালো করে জেনে নিয়ে তবেই সারা জীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বা বিয়ের মতো বড় সিদ্ধান্তটি নেওয়া উচিত বলে মনে করেন জার্মানির পারিবারিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ব্যার্নহার্ড ভল্ফ৷
ছবি: Fotolia/Maridav
6 ছবি1 | 6
কয়েকদিন আগে দিল্লির ঘটনা৷ উচ্চ-শিক্ষিতা ২৮ বছরের এক নারী৷ দিল্লির আইআইটি থেকে সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে পিএইচডি-র ছাত্রী মঞ্জুলা দেবক ইনস্টিটিউটের হস্টেলে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন৷ আত্মহত্যার আগে মঞ্জুলা তাঁর এক বান্ধবীকে হোয়াটস-অ্যাপে সবকিছু জানিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন, তাঁর স্বামী নতুন ব্যবসা শুরু করার কারণ দেখিয়ে তাঁর বাপের বাডি থেকে ২৫ লাখ টাকা আনার জন্য চাপ দেয়৷ টাকা না পেলে ডিভোর্স করার হুমকি দেয়৷ মেয়ের আত্মহত্যার পর মঞ্জুলার বাবা মাথা চাপড়ে আর্তনাদ করেন, মেয়েকে উচ্চশিক্ষার জন্য টাকা খরচ না করে ঐ টাকা বিয়ের যৌতুকের জন্য রাখলে হয়ত মেয়ের প্রাণটা বাঁচতো! পুলিশ মঞ্জুলার স্বামী রীতেশকে ভোপাল থেকে গ্রেপ্তার করেছে৷
দিল্লির লাগোয়া উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে পণের দাবিতে বৌয়ের গায়ে অ্যাসিড ঢেলে পুড়িয়ে মারে তাঁর স্বামী৷ পুলিশ তাঁর স্বামীকে অবশ্য গ্রেপ্তার করেছে৷ এই ধরনের পাশবিক ঘটনার অন্ত নেই৷ স্কুল শিক্ষিকা সংগীতা ভার্মাকে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা জীবন্ত পুড়িয়ে মারে গত এপ্রিলে৷
এমন অসংখ্য ঘটনা৷ তার মধ্যে পুলিশ ৯৪ শতাংশের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলেও দোষী সাব্যস্ত হয় ৩৫ শতাংশেরও কম৷ অবশিষ্ট মামলা বিভিন্ন আদালতে ঝুলে থাকে বছরের পর বছর৷ পুলিশের চার্জশিটে বধূ হত্যা কিংবা স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির অন্য লোকেরা দিনের পর দিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে নববধূকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেবার উল্লেখ করা হয়৷ পুলিশ বিভাগের প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হত্যা করা হয় জীবন্ত পুড়িয়ে৷ বধূর গায়ে কেরোসিন বা পেট্রোল কিংবা অ্যাসিড জাতীয় দাহ্য তরল ঢেলে৷ কারণ, পুড়িয়ে মারলে খুনের ঘটনা প্রমাণ করা শক্ত৷
টিউনিসিয়ায় নারী অধিকার উদযাপন
টিউনিসিয়ায় বিক্ষোভের দিন শেষ হয়েছে৷ নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা রুখতে জাতীয় সংসদ ঐতিহাসিক এক আইন পাস করায় এসেছে সুদিন৷ সুন্দর আগামীর আশা নারীদের ভাসিয়েছে আনন্দের জোয়ারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Messara
ঐতিহাসিক আইন
চলতি বছরের জুলাই মাসে টিউনিশিয়ার সংসদ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ঠেকাতে এই আইন প্রণয়ন করে৷ দেশটির পরিবার বিষয়ক মন্ত্রী নাজিয়া লাবিদি একে ‘ঐতিহাসিক প্রকল্প’ বলে অভিহিত করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Messara
আর নয় ধর্ষণ
পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে শাস্তি সম্পর্কিত অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে৷ অপরাধের বদলে পরিবারের মধ্যে ধর্ষণ দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তিগত বিষয় বলে বিবেচিত হতো৷এখন আর সেটি সম্ভব হবে না বলে মনে করছে নারী অধিকার বিষয়ক সংস্হাগুলো৷
ছবি: picture alliance / AP Photo
চলবে তদন্ত
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এ ধরনের মামলার তদন্ত করতে হবে৷ কোনো নারী অভিযোগ করার পর যদি তা প্রত্যাহারও করে নেন, তবুও তদন্ত চালিয়ে যেতে হবে৷ এই আইন ‘মানবাধিকার ও লিঙ্গ সমতাকে সমর্থন করে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/F.Belaid
পরিসংখ্যান
৪ হাজার নারীর ওপর চালানো সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাঁদের ৬৪ ভাগই ঘরের বাইরে যাওয়ার আগে পরিবারের পুরুষ সদস্যের অনুমতি নিতে হয়৷ প্রায় ৭০ ভাগ নারী গণপরিবহনে নানাভাবে লাঞ্ছিত হন৷ আর বিবাহিত নারীদের ৭৬ ভাগই বাড়িতে হয় শারীরিক, নয়তো মানসিক নির্যাতনের শিকার হন৷
ছবি: DW
কাটছে না আশংকা
নতুন আইনের ফলে সাংস্কৃতিক সংস্কার হবে বলে মনে করেন প্রগতিশীলরা৷ তবে রক্ষণশীলদের আশংকা এ ধরনের আইনের ফলে ‘কট্টর নারীবাদ, পারিবারিক প্রথা ধ্বংস, এমনকি সমকামীতা বৈধ হতে পারে৷
ছবি: Getty Images/F.Senna
সমালোচনায় ভয়
তবে টিউনিসিয়ায় অনেক পুরুষই তাদের স্ত্রীদের অধিকার দিতে প্রস্তুত৷ দুঃখজনক হলেও সত্য, কেবল সমালোচনার ভয়ে চাইলেও স্ত্রী’র অধিকারের প্রশ্নে কোনো কথা বলেন না তারা৷
ছবি: Getty Images/F.Belaid
6 ছবি1 | 6
জাতীয় অপরাধ ব্যুরোর রেকর্ড অনুসারে, গত তিন বছরে পণপ্রথার কারণে প্রাণ হারাতে হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার নববিবাহিত বধূকে৷ সবথেকে বেশি হয়েছে ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে– ৭০৪৮ জন৷ তারপর বিহার ও মধ্যপ্রদেশে, যথাক্রমে ৩৮২০ এবং ২২৫০ জন৷ স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির লোকেদের হাতে দৈহিক ও মানসিক পীড়নের অভিযোগের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের মতো৷ সবথেকে বেশি পশ্চিমবঙ্গে– ৬১ হাজারেও বেশি৷ তারপর রাজস্থানে৷ সংসদে এই তথ্য জানান মহিলা ও শিশু বিকাশ মন্ত্রী মানেকা গান্ধী৷
দেশের আইন এ ব্যাপারে কী বলছে ? ১৯৬১ সালের পণপ্রথা বিরোধী আইনে বিবাহে পণ দেওয়া বা নেওয়া নিষিদ্ধ হয়৷ কিন্তু তাতে ইতরবিশেষ কিছু হয়নি৷ সমাজে প্রচলিত বিবাহ ব্যবস্থায় আইনের ছাপ পড়েনি মোটেই৷ বিয়েতে রাজি হবার শর্তই হলো পণ দেওয়া বা নেওয়া, যেটাকে ভদ্র মোড়কে বা পোষাকি ভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘উপহার'৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইনে অনেক ফাঁক রয়ে গেছে৷ সেগুলি দূর করে পণপ্রথা বিরোধী আইন আরও কঠোর করা দরকার৷ সেজন্য ১৯৮৩ সালে পণ বিরোধী আইন সংশোধন করা হয়৷ বাঞ্ছিত ফল তবু রয়ে গেছে অধরা৷ আসলে অপরাধীদের শাস্তিদানের আইনি প্রক্রিয়ার গোড়ায় গলদ৷ শুরুতে তদন্ত কাজে ঢিলেমি দেবার জন্য বিচার প্রক্রিয়ার গতি হয়ে পড়ে মন্থর৷ অবশ্য এর অন্য একটা দিকও আছে৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মেয়েপক্ষ কিংবা পুলিশ পণবিরোধী আইনের অপপ্রয়োগ করেছে৷ বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়৷ গত অক্টোবর মাসে শীর্ষ আদালত পণ নেবার অভিযোগে চটজলদি কাউকে গ্রেপ্তার নিয়ন্ত্রিত করার সাময়িক নির্দেশ দেন৷ চূড়ান্ত রায় এখনও দেননি সুপ্রিম কোর্ট৷