কারণ আমলাদের মধ্যে যাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা থাকে, তারা চাকরিতে থাকার সময়ই ক্ষমতার ব্যবহার বা অপব্যবহার করে এলাকায় অনেক কাজ করেন, যা সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে তাদের এগিয়ে রাখে৷ মানে হলো, তিনি খেলাটা শুরুই করেন একটু এগিয়ে থেকে৷
অবশ্য নির্বাচনে মাঠ সমতল রাখার স্বার্থেই আমলাদের চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর তিনবছর অপেক্ষা করার বিধান, যাতে মানুষ তাদের কাজ ভুলে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পান৷ আমলাদের ক্ষেত্রে এত কড়াকড়ি বিধান থাকলেও খেলোয়াড়দের জন্য সবকিছু উন্মুক্ত৷ মাশরাফি অবসর নেয়ার আগেই এমপি বনে গেছেন৷ সাকিব আল হাসান এখনও বাংলাদেশ ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেরই অধিনায়ক৷ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন মাঠের খেলায় ব্যস্ত, অধিনায়ক সাকিব আল হাসান তখন ব্যস্ত নির্বাচনের মাঠে৷ মাগুরা-১ আসনে ঝানু পলিটিশিয়ান সাইফুজ্জামান শিখরকে হটিয়ে সাকিবকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ৷ আমলারা যাতে তাদের ক্ষমতাকালীন সুবিধা নির্বাচনের মাঠে টেনে আনতে না পারেন, সে জন্য তিনবছরের সময় বাধা থাকলেও খেলোয়াড়রা খেলার মাঠের জনপ্রিয়তা নিয়েই নেমে পড়তে পারেন নির্বাচনের মাঠে৷ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান৷
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বেরই সেরা অলরাউন্ডার সাকিব৷ আরেকটু মনোযোগ দিয়ে, আরো বেশি ম্যাচ খেললে সাকিবের সামনে সুযোগ ছিল সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ারও৷ কিন্তু খেলার চেয়ে তার মনোযোগ ব্যবসা-বাণিজ্য, মডেলিং, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হওয়ার দিকেই বেশি৷ মাঠের সেরা পারফরমার সাকিবের মাঠের বাইরের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ, নৈতিকতা নিয়েও কথা হয়৷ জুয়ারীদের সাথে যোগাযোগের অপরাধে একবছর নিষিদ্ধও ছিলেন৷ দর্শক পেটানো, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, কারণে-অকারণে ছুটি নেয়া তো আছেই, সাকিবের নাম এসেছে শেয়ার কেলেঙ্কারিতেও৷ সাকিব আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম, ‘সাকিব এখন কোনটা মনোযোগ দিয়ে করবে- খেলা, রাজনীতি না ব্যবসা?' সেখানে একজন মন্তব্য করেছিলেন, ‘সাকিব খেলা ও রাজনীতিকে ব্যবহার করে ব্যবসা করবে৷‘ আরেকজন লিখেছেন, সাকিব মূলত ব্যবসায়ী৷ এতদিন টাকার জন্য বিভিন্ন ক্রিকেট লীগে খেলেছে৷ এখন বুঝেছেন, সবচেয়ে লাভজনক লীগ হলো আওয়ামী লীগ, তাই এই লীগেই যোগ দিয়েছেন৷
আসলেই রাজনীতি হলো এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা৷ একসময় জমিদারের সন্তানেরা রাজনীতি করে নিঃস্ব হয়ে যেতেন৷ আর এখন নিঃস্ব লোকজন রাজনীতি করে জমিদার বনে যাচ্ছেন৷ রাজনীতি সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা, এটা কিন্তু কথার কথা নয়৷ এটার কিন্তু দালিলিক প্রমাণ আছে৷ প্রতিবছর নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের হলফনামা দিতে হয়৷ তাতে প্রার্থীদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাব থাকে৷ আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে পত্রিকায় এই হলফনামার খবর পড়ি, আর বিস্মিত হই৷ এবারেরটা ধরলে এখন পর্যন্ত চারটি নির্বাচনে প্রার্থীরা হলফনামা দিয়েছেন৷ হলফনামাগুলো বিশ্লেষণ করলে যে কেউ আমার সাথে একমত হবেন, রাজনীতির চেয়ে লাভজনক কোনো ব্যবসা নেই৷ এত প্রবৃদ্ধি আর কোনো ব্যবসায় সম্ভব নয়৷
রেজাউল করিম বাবলু ছিলেন বগুড়ার স্থানীয় এক পত্রিকার সাংবাদিক৷ নির্বাচন করারও রোগ ছিল তার৷ একবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ১৭ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছিলেন৷ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ১৭ ভোট পাওয়া সেই বাবলুই এখন জাতীয় সংসদ সদস্য৷ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বগুড়া-৭ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন তিনি৷ গাবতলী-শাহজাহানপুর নিয়ে গঠিত বগুড়া-৭ আসনটি বিএনপির ঘাঁটি৷ কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে শেষ মুহুর্তে বগুড়া-৭ আসনে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়ে গেলে বিপাকে পড়ে যায় বিএনপি৷ আর কোনো উপায় না পেয়ে নিজেদের আসনটি ধরে রাখতে স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম বাবলুকে সমর্থন দেয় তারা৷ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ১৭ ভোট পাওয়া বাবলু ১ লাখ ৯০ হাজার ২৯৯ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন৷ লটারি জিতে না হয় এমপি হয়ে গেলেন৷ কিন্তু এরপর কোন আলাদীনের চেরাগ পেয়ে গেলেন তিনি, সেটা বিস্ময়কর৷ হলফনামায়ি দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তার মাসিক আয় ছিল ৪১৭ টাকা৷ ঠিক পড়েছেন, মাত্র ৪১৭ টাকা৷ আর গত পাঁচ বছরে তিনি নিজে কোটিপতি হয়েছেন, স্ত্রীকে কোটিপতি বানিয়েছেন৷ ৪১৭ টাকার মাসিক আয় বেড়ে এখন হয়েছে ৩ লাখ ২২৮ টাকা৷ কোটি টাকা দামের গাড়ি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট৷ আঙ্গুল ফুলে বটগাছ বনে যাওয়ার উদাহরণ হতে পারেন এই রেজাউল করিম বাবলু৷
শুধু বাবলু একা নন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা জমা দিয়েছেন; তাতে সব এমপি আঙ্গুল ফুলে বটগাছ না হলেও কলাগাছ হয়েছেন প্রায় সবাই৷ আমি বুঝি না, জাতীয় সংসদ সদস্যরা তো জনগণের প্রতিনিধি৷ তাদের মূল কাজ হলো জনগণের জন্য আইন প্রণয়ন করা৷ কিন্তু তারা কীভাবে মাত্র পাঁচবছরে একেকজন কোটি কোটি টাকা কামাই করেন৷ তাও প্রদর্শিত অর্থ যাদের এত, না জানি তাদের অপ্রদর্শিত অর্থ কত৷ বরিশাল-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন শাম্মী আহমেদ৷ এই আসনে আওয়ামী লগের বর্তমান সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ৷ মনোনয়ন বঞ্চিত পঙ্কজ স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছেন৷ তিনি নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেছেন, শাম্মী আহমেদ অস্ট্রেলিয়ায় অঢেল সম্পদের মালিক৷ কয়েকদিন আগে পত্রিকায় খবর এসেছে, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সোবহান গোলাপের আমেরিকায় প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে৷ রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেরই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় সম্পত্তির খবর শুনি৷ ক্যানাডায় তো বেগম পাড়া আছে; যেখানে বাংলাদেশের মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী, আমলাদের বেগমদের নামে বাড়ি আছে৷ আমি নিশ্চিত কোনো প্রার্থীই তাদের হলফনামায় দেশের বাইরের সম্পত্তির হিসাব দেননি৷ তার মানে তারা সবাই হলফ করে মিথ্যা কথা বলেছেন৷ শুধু নির্বাচনের আগের হলফনামা নয়, নির্বাচনের পরে নির্বাচনের ব্যয় নিয়েও নির্বাচিত এমপিরা যে হলফনামা দেন; তাও একশোভাগ মিথ্যা৷ তার মানে মিথ্যার ওপর ভর করেই শুরু হয় আইন প্রণেতাদের দায়িত্ব৷
প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন জমা দিতে গেলে ভয়ে ভয়ে থাকি৷ পাই পাই হিসাব দিতে হয়৷ আয়কর কর্মকর্তার নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হয়৷ আগের বছরের সম্পদের সাথে পরের বছরের সম্পদের ধারাবাহিকতা থাকতে হয়৷ কিন্তু ৪১৭ টাকা মাসিক আয়ের একজন ব্যক্তি মাত্র পাঁচবছরে কীভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান৷ আয়কর কর্মকর্তারা কি সংসদ সদস্যদের সম্পদের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেন না!
এমনিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে একজন ব্যক্তি একবার একটি শুল্কমুক্ত গাড়ি পান৷ এমপি হোস্টেলে একটি বাসা পান৷ প্রতি মাসে ভালো অঙ্কের সম্মানী পান৷ আবেদন করলে রাজউকের কোনো আবাসিক এলাকায় একটি প্লট পান৷ তার মানে একজন সংসদ সদস্য চাইলে সৎভাবেও স্বচ্ছল জীবনযাপন করতে পারেন৷ কিন্তু আমাদের এমপিরা অল্পে সন্তুষ্ট নন৷ দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা বা পেশা ছাড়াই তারা পাঁচবছরে সম্পদের পাহাড় গড়েন৷ তাদের কোনো চক্ষুলজ্জাও নেই৷ সবাই যে তাদের এই প্রবৃদ্ধির ফাঁকিটা ধরতে পারেন, সেটাও তারা ধরতে পারেন না৷
মন্ত্রী-এমপিরা কীভাবে অঢেল অর্থ উপার্জন করেন, তার একটা ছোট উদাহরন গত সপ্তাহেই দেখেছে বাংলাদেশ৷ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরির জন্য ৪৮ জনের কাছ থেকে মোট ৯৪ লাখ টাকা নিয়েছেন প্রতিমন্ত্রীর লোকজন৷ কিন্তু ৪৮ জনের কেউ চাকরি পাননি৷ টাকাও ফেরত দেওয়া হয়নি৷ এই অবস্থায় ভূক্তভোগীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ করেন৷ জাকির হোসেনের ধারণা, এই অভিযোগের কারণেই তিনি এবার মনোনয়ন পাননি৷ এরপর তিন চাকরি প্রার্থীকে প্রতিমন্ত্রীর মিন্টো রোডের বাসায় ডেকে পাঠানো হয় টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলে৷ কিন্তু ডেকে নিয়ে তাদের একটি রুমে আটকে বেধড়ক পেটানো হয়৷ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তো বটেই, এমনকি প্রতিমন্ত্রী নিজেও রড দিয়ে তাদের পিটিয়েছেন৷ মন্ত্রীর বাসায় মারধরের ঘটনায় পত্রিকায় খব্র প্রকাশিত হলে, প্রতিমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পুরো ঘটনাটি অস্বীকার করা হয়৷ কিন্তু পুরো ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়, প্রতিমন্ত্রীর বাসায় পিটুনী থেকে বাঁচতে পালাতে গিয়ে একজন দেয়াল টপকে পাশের বাসায় চলে যান৷ পড়বি তো মালির ঘাড়ে৷ পাশের ভবনটি হলো গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়৷ দেয়াল টপকে প্রবেশের অপরাধে তাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ৷ পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে উদঘাটিত হয় সত্য৷ গোয়েন্দা পুলিশের মধ্যস্থতায় প্রতিমন্ত্রীর লোকজন ঘুষের সাড়ে নয় লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন৷ একদফা চাকরির তদ্বির থেকে যদি প্রায় কোটি টাকা ঘুষ পাওয়া যায়, তাহলে সম্পদ তো লাফিয়ে লাফিয়েই বাড়ার কথা৷
এখন ব্যবসায়ীরাও চালাক হয়ে গেছেন৷ আগে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদদের চাঁদা দিতেন৷ এখন ব্যবসায়ীদের অনেকে নিজেরাই রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন৷ তাতে এখন আর চাঁদা দিতে হয় না৷ আর রাজনীতিতে এলে ব্যবসাও চাঙা হয়৷ যারা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, সেসব মন্ত্রী-এমপির আয় ও সম্পদের যৌক্তিক প্রবৃদ্ধি না হয় মানা গেল৷ কিন্তু মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে যাদের কোনো দৃশ্যমান ব্যবসা বা পেশা নেই, তাদের অর্থ আসে কোত্থেকে? ৫ বছরে তা ১০০ গুন, ২০০ গুন বাড়ে কীভাবে? দুর্নীতি দমন কমিশন সত্যিকারের স্বাধীন হলে, এই হলফনামা বিশ্লেষণ করেই এমপি প্রার্থীদের মধ্যে অনেককে আটকাতে পারতো৷ কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত বলে নৈতিকতার একটা ধারণা আছে৷ বাংলাদেশে এই ধারণাটা নেই বললেই চলে৷ মন্ত্রী-এমপিরা যে কোনো অর্থ উপার্জন করেন, নীতি নৈতিকতার ধার ধারেন না৷
রাজনীতি হলো নীতির রাজা৷ কিন্তু আমরা সেটিকে বানিয়েছি রাজা হওয়ার নীতি৷ রাজনীতিবিদরা মুখে জনগণের ভাগ্য পারিবর্তনের কথা বলেন বটে৷ কিন্তু আসলে জনগণের ভাগ্য বদলায় না৷ বদলায় শুধু নিজেদের ভাগ্য৷ সে জন্যই রাজনীতিবিদরা তো বটেই; খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী, শিল্পী, নায়ক, গায়ক, আমলা, পেশাজীবী সবাই এমপি হতে চান৷ একবার এমপি হওয়া মানেই যেন আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্যকে বশ করে ফেলা৷