প্যারিসে চলছে জলবায়ু সম্মেলন৷ বিশ্ব নেতারা সেখানে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন৷ কিন্তু বিশ্বকে বাঁচাতে প্যারিসের এ সম্মেলন কি কার্যকর হবে? ইয়েন্স টুরাউ মনে করেন, এই চুক্তি অলিক স্বপ্ন মাত্র৷
বিজ্ঞাপন
প্রথমেই একটা সুখবর৷ প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে উপস্থিত ১৫০টি দেশের রাষ্ট্র এবং সরকার প্রধানদের সকলেই একটি বিষয়ে একমত – জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সকলকে একজোটে এগিয়ে আসতে হবে৷ তা না হলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা, তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকানো কখনোই সম্ভব নয়৷ অবশেষে আজ সকলেই একমত যে জলবায়ুর পরিবর্তন বর্তমানকালের এক স্বীকৃত সত্য, বাস্তব ঘটনা৷ তাপমাত্রা বাড়ছে৷ ঘটছে পৃথিবী নামের গ্রহটির উষ্ণায়ন৷ আর উষ্ণতা বাড়ার কারণে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের হারও বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ তাই যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন৷
জলবায়ু সংরক্ষণে আমরা কী অবদান রাখতে পারি?
গোটা বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় তিন-চতুর্থাংশের উৎস কয়লা, তেল ও গ্যাস৷ বাকি এক-চতুর্থাংশের জন্য কৃষি ও কাঠ কাটার কাজ দায়ী৷ ১০টি উপায়ে আমরাও কার্বন নির্গমন এড়িয়ে চলতে পারি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কয়লা, তেল ও গ্যাসের কম ব্যবহার
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কল-কারখানা ও পরিবহণ ক্ষেত্রই মূলত কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী৷ শীতের দেশে ঘরবাড়ি গরম রাখতে প্রায় ৬ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করা হয়৷ তাই পরিবেশ সংরক্ষণ করতে কয়লা, তেল ও গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে আরও দক্ষতার সঙ্গে জ্বালানি ব্যবহার করা উচিত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘ক্লিন এনার্জি’ নিজেই উৎপাদন করুন
বিদ্যুতের জন্য আর কয়লা, তেল বা গ্যাস-ভিত্তিক জ্বালানি কেন্দ্রের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না৷ বিকল্প জ্বালানি ইতোমধ্যে আরও সস্তা হয়ে উঠেছে৷ নিজস্ব উদ্যোগে জ্বালানি উৎপাদন করে চাহিদা মিটিয়ে প্রায়ই কিছু উদ্বৃত্ত থেকে যায়৷ ছাদের উপর সৌর প্যানেলের জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে৷ এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিরও যথেষ্ট উন্নতি ঘটছে৷
ছবি: Mobisol
ভালো আইডিয়ার প্রতি সমর্থন চাই
পৌর কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কোম্পানি পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছে ও ‘ক্লিন এনার্জি’ বিক্রি করছে৷ যেমন জার্মানির সাবেক শহরের সোলার পার্ক৷ জনসংখ্যা মাত্র ৭,২০০৷ চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আদর্শ হয়ে উঠেছে এই ছোট্ট শহরটি৷ এক মার্কিন প্রতিনিধিদল সেই সাফল্যের রহস্য বুঝতে এসেছে৷
ছবি: Gemeinde Saerbeck/Ulrich Gunka
জলবায়ুর ক্ষতি করলে কোম্পানির লোকসান
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিমা কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়, পৌর কর্তৃপক্ষ – সবাই জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি কোম্পানি থেকে বিনিয়োগের অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে৷ জার্মানির ম্যুনস্টার শহর কর্তৃপক্ষ সবার আগে এই ‘ডাইভেস্টমেন্ট’ আন্দোলনে শামিল হয়েছে৷ গোটা বিশ্বে মোট ৫৭টি পৌর কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত একই পথ বেছে নিয়েছে৷
ছবি: 350.org/Linda Choritz
গাড়ি ছেড়ে সাইকেল, ট্রাম-বাস, ট্রেন
সাইকেল, ট্রাম-বাস ও ট্রেন ব্যবহার করলে অনেক কার্বন সাশ্রয় করা যায়৷ গাড়ির তুলনায় বাস ৫ গুণ বেশি পরিবেশবান্ধব – ইলেকট্রিক ট্রেন ১৫ গুণ বেশি৷ আমস্টারডাম শহরের বেশিরভাগ মানুষই সাইকেল চালান৷ শহর কর্তৃপক্ষ সাইকেলের জন্য চওড়া পথ তৈরি করেছে৷
ছবি: DW/G. Rueter
বিমানযাত্রা এড়িয়ে চলুন
বিমানযাত্রা পরিবেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে৷ হিসেব অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে বছরে গড়ে ৫.৯ টনের বেশি কার্বন নির্গমন করলে চলবে না৷ অথচ বিমানে চেপে বার্লিন ও নিউ ইয়র্ক করলেই যাত্রী প্রতি ৬.৫ টন কার্বন নির্গমন করা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Huguen
কম মাংস খান
পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কৃষিক্ষেত্রও সমস্যা সৃষ্টি করে৷ ধানচাষের ফলে এবং গরু, ভেড়া ও ছাগলের পেটের মধ্যে জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর মিথেন সৃষ্টি হয়৷ একদিকে সারা বিশ্বে মাংস খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে৷ অন্যদিকে গবাদি পশুপালনের কারণে পশুখাদ্য হিসেবে সয়াবিনের চাহিদাও বেড়ে চলেছে৷
ছবি: Getty Images/J. Sullivan
অরগ্যানিক খাদ্য কিনুন
লাফিং গ্যাস জলবায়ুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর৷ গ্রিনহাউস এফেক্টের প্রায় ৬ শতাংশ এই গ্যাসের কারণে ঘটে৷ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ইঞ্জিনের পাশাপাশি বিশাল মাত্রার কৃষিকাজে কৃত্রিম সারের কারণে এই গ্যাস সৃষ্টি হয়৷ অরগ্যানিক খামারে এই বস্তুটি নিষিদ্ধ৷
ছবি: imago/R. Lueger
টেকসই নির্মাণ ও ভোগ
ইস্পাত ও সিমেন্ট উৎপাদনের ক্ষেত্রেও প্রচুর কার্বন নির্গমন ঘটে৷ অন্যদিকে কাঠ ও বাঁশের ক্ষেত্রে সেই ক্ষতির আশঙ্কা নেই৷ নির্মাণের ক্ষেত্রে সঠিক উপকরণ বাছাই করে পরিবেশের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব৷ ভোক্তা হিসেবেও সবার মনে রাখা উচিত, যে প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করলে পরিবেশের কত ক্ষতি হয়৷
ছবি: Oliver Ristau
দায়িত্বশীল হবার পালা
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে গ্রিনহাউস গ্যাস পরিহার করতে হবে৷ স্কুলের এই ছাত্রছাত্রীরা ‘ক্লিন এনার্জি’ সম্পর্কে অত্যন্ত উৎসাহী৷ ভবিষ্যতের জন্য তারা এটাকে বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে৷ তাদের এই স্বপ্ন পূরণ করতে সবাই সাহায্য করতে পারে৷
ছবি: Gemeinde Saerbeck/U.Gunnka
10 ছবি1 | 10
কিন্তু বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটি কার্যকর চুক্তি আজও অলিক এক কল্পনা মাত্র৷ কানকুন থেকে কোপেনহেগেন – শত আলাপ-আলোচনার পরও একটি স্বতঃসিদ্ধ চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি বিশ্ব৷ এমনকি হালে প্যারিসেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং– উভয়ে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার কথা বলে যৌথ নেতৃত্বের দাবি তুলেছেন, ঠিকই৷ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিটা ততটা আশাজনক মনে হচ্ছে না৷
এই যেমন, বিশ্বের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ৩০ শতাংশ আসে চীন থেকে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ১৬ শতাংশ৷ গতবছরই ওবামা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, মার্কিন কার্বন নির্গমন আগামী দশ বছরের মধ্যে ২৮ শতাংশ কমানো হবে৷ অন্যদিকে শি ঘোষণা করেন যে, চীন ২০৩০ সালে অথবা তার আগেই কার্বন নির্গমন সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেবে৷ কিন্তু সেই কর্মকাণ্ডের কতটা পথ তারা পার হয়েছে? তাছাড়া এর ফলে বিশ্বের ছোট দ্বীপরাজ্যগুলির ভবিষ্যৎ যে খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, এমনটাও নয়৷ স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মতো ‘বড়' দেশগুলোর ভারত-বাংলাদেশের মতো ‘ছোট' দেশগুলো নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই৷ কাজেই ‘ছোটদের' পক্ষে বর্তমান ও আগামী পরিস্থিতি মেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী পেশা ও জীবিকা পরিবর্তন করাই হবে হয়ত সেরা পন্থা৷ তাই একটি সার্বিক জলবায়ু চুক্তি আজ শুধুই যেন অলিক স্বপ্ন৷ আর সবচেয়ে শেষে মৃত্যু হবে সেই আশার, সেই স্বপ্নের৷
বন্ধু, আপনি কি ইয়েন্স টুরাউ-এর সঙ্গে একমত? জানান নীচে, মতামতের ঘরে৷