বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানলেও এর তীব্রতা আশঙ্কার চেয়ে কম ছিল৷ দক্ষিণে সুন্দরবন দিয়ে প্রবেশ করায় তা আরো দুর্বল হয়ে যায়৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, সুন্দরবনই বারবার বাংলাদেশকে বুক পেতে রক্ষা করছে৷
বিজ্ঞাপন
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকায় আঘাত করে শনিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে৷ এরপরই তার তীব্রতা কমে যায়৷ ধীরে ধীরে এটি সাইক্লোন থেকে গভীর স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়৷ তবে এর আগে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা আরো একটু কমে৷ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘‘সুন্দরবন বারবারই বাংলাদেশকে ঘূর্ণিঝড় থেকে ঢাল হয়ে রক্ষা করছে৷ আর উপকূলীয় এলকার সবুজ বেষ্টনীও এই সময় কাজ করে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হানে পশ্চিমবঙ্গ এবং খুলনা হয়ে, সুন্দরবনের ওপর দিয়ে৷ তার গতিবেগ ছিলো ঘন্টায় ৯০ থেকে দমকা হাওয়ায় ১২০ কিলোমিটার৷ তখন এটা ছিলো প্রবল ঘুর্ণিঝড়৷ কিন্তু স্থলভাগে সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে এটা গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়৷ বাতাসের গতিবেগ কমে গিয়ে ৬০ থেকে দমকায় ৮০ কিলোমিটার হয়৷''
এ কে এম রুহুল কুদ্দুস
তাঁর মতে, ‘‘সুন্দরবনের গাছপালা ঘুর্ণিঝড়কে প্রতিরোধ করায় সেটা দুর্বল হয়ে পড়ে৷''
এবারের ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের গাছপালার কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে তা এখনও নির্ণয় হয়নি৷ তবে জলোচ্ছ্বাস না হওয়ায় বন্য প্রাণীর তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে বন বিভাগ৷ ওই অঞ্চলে বিভিন্ন স্থাপনার বড় ধরনের কোনো ক্ষতির খবরও পাওয়া যায়নি৷ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুন বলেন, ‘‘সুন্দরবন বরাবরের মত এবারও ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের রক্ষা করেছে৷ সিডরে সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি হয়েছিল৷ তবে ১২ বছরে প্রাকৃতিকভাবে সুন্দরবন আবার তার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে৷ আসলে সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক ঢাল৷ তাকে বিরক্ত না করলেও সে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠে, সুরক্ষা দেয়৷ সেখানোতো গাছ লাগাতে হয়না৷ ওটা একটা প্রাকৃতিক সিস্টেম৷ একটু ভালো ব্যবস্থাপনা হলেই সে শতাব্দির পর শাতাব্দি এভাবেই টিকে থাকবে৷''
ডা. মো এনামুর রহমান
এদিকে ঘূর্ণিঝড় এখন নিম্নচাপে রূপান্তরিত হয়ে দক্ষিণের পটুয়াখালি অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে৷ সতর্কতা সংকেত তিনে নামিয়ে আনা হয়েছে৷ আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে আগামীকাল (সোমবার) দেশের আবহাওয়া পরিস্থতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে আসবে৷
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো এনামুর রহমান বলেন ,‘‘যে পরিমান ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ছিলো তা হয়নি৷ পূর্ব প্রস্তুতি এবং ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে পড়ায় ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে৷ আমরা এখন তথ্য সংগ্রহ করছি৷ পূর্ণ চিত্র পেতে কয়েকদিন সময় লাগবে৷ তবে প্রাথামিকভাবে এটা বলা যায় যে বিপদ কেটে গেছে৷ আর এজন্য সুন্দরবন আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা সুন্দরবনকে বাঁচাতে এবং এটা যাতে আর কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করব৷ এই বনের গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, বন উজাড় করা হচ্ছে৷ নানাভাবে বনের ক্ষতি করা হচ্ছে৷ এটা বন্ধ করে সুন্দরবনকে সুরক্ষা দিতে হবে৷''
প্রসঙ্গত, ২০০৭ এবং ২০০৯ সালে সিডর ও আইলার প্রাথমিক আঘাত সামাল দিয়েছিল সুন্দরবন৷ যাার কারণে সম্ভাব্য বিপুল প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায় বাংলাদেশ৷ দেশের দক্ষিণে ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন এভাবে বারবারই এই জনপদকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করছে৷
এক দশকের বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়
দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের অন্যতম ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা৷ এক নজরে দেখে নিন গত এক দশকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলি...
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Kakade
ক্যার ও মাহা, ২০১৯
চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ভারতের পশ্চিম উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় মাহা ও ক্যার৷ এর আঁচ এসে পড়ে ভারত-বাংলাদেশ টি টুয়েন্টি ক্রিকেট সিরিজেও৷ বিজ্ঞানীরা জানান, ১৯৬৫ সালের পর এই প্রথম একসাথে দুটি ঘূর্ণিঝড় একসাথে অনুভব করছে ভারত৷
(প্রতীকী ছবি)
ছবি: IANS
ফেনী, ২০১৯
ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্য ওড়িষার উপকূলে কেন্দ্রবিন্দু থাকা এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব সীমিত থাকেনি ভারতে৷ বাংলাদেশেও আসে তার প্রভাব৷ ১৯৯৯ সালের পর থেকে ওড়িষার উপকূলের সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ছিল এটি৷ মোট ক্ষয়ক্ষতি ছিল ৭০ কোটি টাকার সমান৷
ছবি: AFP/M.U. Zaman
তিতলি, ২০১৮
গত বছর অক্টোবর মাসে ভারতের পূর্ব উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় তিতলি৷ নাসার তথ্য অনুযায়ী, এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা থেকে মাত্র ৩১২ মাইল দূরে৷ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছিলেন, এই ঝড় বাংলাদেশে এসে ঢুকবে৷ কিন্তু তা না হয়ে শেষ মুহূর্তে ঝড়টি পথ বদল করে চলে যায় দক্ষিণের দিকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
অক্ষী, ২০১৭
দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করা এই ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণ করেছিল বাংলাদেশ৷ ২০১৭ সালের এই ঝড় বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে জন্ম নিয়ে দক্ষিণের দিকে এগোয়৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ভারতের দ্বীপ লাক্ষাদ্বীপ, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায়৷ ঝড়ে প্রাণ হারান অন্তত ২৪৫ জন এবং নিখোঁজ হন সাড়ে পাঁচশরও বেশি মানুষ, যাদের বেশির ভাগই মৎস্যজীবী৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Kakade
মোরা, ২০১৭
একই বছরের আরেকটি বিদ্ধংসী ঝড় ছিল মোরা৷ শ্রীলঙ্কা, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, উত্তরপূর্ব ভারত, মিয়ানমার, ভুটান, তিব্বত ও বাংলাদেশ এই ঝড়ে আক্রান্ত হয়৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চট্টগ্রাম এবং ঝড় চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম, পায়রা, মংলা ও কক্সবাজার বন্দরে বিপদসঙ্কেত জারি করা হয়৷ বন্ধ রাখা হয় বিমানবন্দরও৷
ছবি: bdnews24.com/Muhammad Mostafigur Rahman
রোয়ানু, ২০১৬
বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন, রোয়ানু দুর্বল ঘূর্ণিঝড় হওয়ার কারণে তেমন ক্ষতি হবে না৷ কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে নতুন করে জেগে ওঠে এই ঝড়৷ মিয়ানমার উপকূলের কাছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে প্রাথমিকভাবে আছড়ে পড়ে রোয়ানু৷ মারা যান ২৭জন৷ এরপর বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের সংস্পর্শে এসে শক্তিলাভ করে আরো বড় হয় ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দু৷ শ্রীলঙ্কায় এই ঝড়ের কবলে প্রাণ হারান ২০১জন৷
ছবি: Imago/Zuma Press
কোমেন, ২০১৫
বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে ছিল এই ঘূর্ণিঝড়ের উৎস৷ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এই ঝড় আছড়ে পড়ে বাংলাদেশে৷ মিয়ানমারেরও কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
ছবি: Getty Images/D. Chakraborty
হুদহুদ, ২০১৪
পূর্ব ভারত ও নেপাল ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারত মহাসাগরের এই ঝড়ে৷ এছাড়াও, অন্ধ্র প্রদেশ ও ওড়িষায় এসে পড়ে এর ছোঁয়া৷ প্রায় ২৪ কোটি টাকা মূল্যের ক্ষতি হয় এই ঝড়ের কারণে৷ প্রাণ হারান ১২৪ জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
ফিলিন, ২০১৩
থাইল্যান্ড, ভারত, মিয়ানমার ও নেপালের গায়ে আছড়ে পড়া এই ঝড় ছিল ১৯৯৯ সালের পরের সবচেয়ে ভয়াবহ ঝড় ছিল এটি৷ এর আগের ২৩ বছরে এত বড় মাপের কোনো ঝড় ভারত সামলায়নি৷ সরকারী তথ্য অনুযায়ী প্রায় ২৫০ কোটি ভারতীয় রুপির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইলা, ২০০৯
গত এক দশকে বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ছিল আইলা, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ ও ভারতে পূর্ব উপকূলের বিশাল অংশ৷ প্রায় দুই কোটি মানুষ এই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ ঘরছাড়া হন অনেকে৷ শুধু কলকাতা শহরেই এই ঝড় কেড়ে নেয় ১৮টি প্রাণ, বাংলাদেশে হারিয়ে যায় প্রায় ৬০ হাজার গবাদি পশু৷