নরওয়ে যা করেছে তা অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হতে পারে৷ কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, সেটাই আসলে স্বাভাবিক হওয়া উচিত৷ ক্রীড়াঙ্গনে নারী-পুরুষের মধ্যকার বেতন বৈষম্য কমাতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দেশটি৷
বিজ্ঞাপন
চলতি বছর থেকে নরওয়ের নারী ও পুরুষ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা সমান বেতন পাচ্ছেন৷ গত বছরের ডিসেম্বরে এ সংক্রান্ত এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন দেশটির নারী ও পুরুষ ফুটবল দলের অধিনায়করা৷ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম নারী ও পুরুষ ফুটবলারদের বেতন এক করার এই সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক' আখ্যা দিয়েছে৷
কেউ কেউ অবশ্য ভাবতে পারেন, কিভাবে এই সমতা আনা হলো, যেখানে গত বছরও দেশটির জাতীয় ফুটবল দলের একজন পুরুষের তুলনায় নারীর বেতন অর্ধেকেরও কম ছিল! পুরুষ ফুটবল দলের আয়ের একটি অংশ নারী ফুটবল দলকে ট্রান্সফারের মাধ্যমে এই সমতা আনা হয়েছে৷ আর এতে কোন পুরুষ ফুটবলারই আপত্তি জানাননি৷ বরং নারীর অবদানকে স্বীকার করে নিয়ে সানন্দেই তাঁরা তাদের আয়ের একটা অংশ দিয়ে দিয়েছেন৷
বলাবাহুল্য, নরওয়ের মতো এমন উদাহরণ এখনও সৃষ্টি করতে পারেনি অনেক দেশ৷ ইউরোপের অন্যতম ফুটবল পরাশক্তি জার্মানিতো এক্ষেত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে৷ দেশটিতে জাতীয় দলের ফুটবলারদের বাৎসরিক গড় আয় যেখানে মিলিয়ন ইউরোর উপরে, সেখানে নারী ফুটবলারদের গড় আয় এক লাখ ইউরোই ছাড়ায় না৷ আর ক্লাব ফুটবলেতো নারীদের অবস্থা আরো শোচনীয়৷
সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে সফল যাঁরা
নানান বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশকে সাফল্য এনে দিয়েছেন৷ সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা সাফল্যটি এসেছে মেয়েদের হাত ধরেই৷
ছবি: Suhaimi Abdullah/Getty Images
নারী ক্রিকেট দল: বাংলাদেশের অহঙ্কার
এই খেলায় বাংলাদেশের সেরা সাফল্যটি এসেছে মেয়েদের হাত ধরেই৷ সম্প্রতি এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ছয়বারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে ফাইনালে হারিয়ে দেন সালমা, জাহানারা আর রুমানারা৷ এর আগে ২০১০ সালে চীনের গুয়াংজুতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের ক্রিকেটে রৌপ্যপদক জয় করেছিলেন বাংলাদেশের মেয়েরা৷
ছবি: Suhaimi Abdullah/Getty Images
ফুটবলেও এগিয়ে আসছে নারী
বয়সভিত্তিক ফুটবলে একের পর এক সাফল্য এসেছে৷ এপ্রিলে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৫-র এক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ৷ এর আগে গত ডিসেম্বরে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম আসরে বাংলাদেশ সেরা হয়৷ তবে সাফল্যের শুরু ২০১৫ সালে৷ সেবার এএফসি কাপ অনূর্ধ্ব-১৪’র আঞ্চলিক পর্বে সেরা হয়েছিল তারা৷ পরের বারও তারা চ্যাম্পিয়ন হয়৷ এছাড়া ২০১৬ সালেই এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
দাবায় রানী হামিদ
তিনি দাবায় বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক মাস্টার৷ জাতীয় মহিলা দাবায় ১৮ বার সেরা হয়েছেন রানী হামিদ৷ দাবার প্রসারেও ভূমিকা রেখেছেন ৭৩ বছর বয়সি এই দাবাড়ু৷ তাঁর লেখা ‘মজার খেলা দাবা’ বইটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ রানী হামিদের সন্তান কায়সার হামিদ আশির দশকের তারকা ফুটবলার৷
ছবি: Khandakar Tarek
গিনেস বুকে নাম ওঠা লিনু
১৯৭৭ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে বড় বোন হেলেনকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো জাতীয় টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন জোবেরা রহমান লিনু৷ এরপর ২০০১ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন তিনি৷ ফলে ২০০৩ সালে গিনেস বুকে নাম ওঠে তাঁর৷
ছবি: Khandakar Tarek
শুটিংয়ের সাবরিনা
১৯৯৭ সালে কমনওয়েলথ গেমসের শ্যুটিংয়ে সোনা জেতেন সাবরিনা সুলতানা৷ এছাড়া সাফ গেমসে তিনটি ও সাফ শ্যুটিংয়ে দুটি সোনা জেতেন বাংলাদেশের শ্যুটিংয়ের এই অন্যতম তারকা৷ তাঁর স্বামী সাইফুল আলম রিংকিও সাফ গেমসে ব্যক্তিগত ও দলীয় মিলে পাঁচটি আর সাফ শ্যুাটিংয়ে ছয়টি সোনার পদক জেতেন৷
ছবি: Khandakar Tarek
ভারোত্তোলনের তারকা মাবিয়া
২০১৬ সালের দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে মেয়েদের ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণির ভারোত্তলনে স্বর্ণ জয় করেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত৷ সেই সময় পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত বাজার সময় তাঁর কান্না কাঁদিয়েছিল অনেককে৷ এরপর চলতি বছর এপ্রিলে কমনওয়েলথ গেমসে নিজের ব্যক্তিগত রেকর্ড করে ষষ্ঠ হন তিনি৷
ছবি: Khandakar Tarek
সাঁতারের মাহফুজা খাতুন শিলা
২০১৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে দুটি স্বর্ণপদক জয় করেন মাহফুজা৷ ১০০ মিটার ও ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক – এই দুই ইভেন্টে সোনা জেতেন তিনি৷ ফলে দীর্ঘ ১০ বছর পর এসএ গেমসের সাঁতারে সোনা জিততে সমর্থ হয়েছিল বাংলাদেশ৷ ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে গেমসের নতুন রেকর্ড গড়েছিলেন মাহফুজা৷ সময় নিয়েছিলেন ৩৪ দশমিক ৮৮ সেকেন্ড৷ এতে ভেঙে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কার রাহিম মাইয়ুমির করা ২০০৬ সালের রেকর্ড৷
ছবি: bdnews24.com
সফল ক্রীড়াবিদ ও সাহসী সংগঠক কামরুন নাহার ডানা
জাতীয় ব্যাডমিন্টনে তিন বার সেরা হন তিনি৷ ব্যাডমিন্টন খেলা ছাড়ার পর থেকে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন৷ ২০০৪ সালে মৌলবাদীদের আন্দোলনের ভয়ে যখন কেউ মহিলাদের ফুটবল মাঠে নামানোর সাহস পাচ্ছিলেন না, মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্বে থাকা ডানা তখনই মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল চালু করেন৷
ছবি: Khandakar Tarek
8 ছবি1 | 8
পরিস্থিতি এমন যে, অনেককেই দ্বিতীয় একটা চাকুরি করতে হয় জীবিকা নির্বাহের জন্য৷ মোটের উপর, ক্লাব পর্যায়ে ফুটবল যারা খেলছেন, তাদের ভবিষ্যত নিয়েও শঙ্কায় থাকতে হয়৷ কেননা, নারী ফুটবলারদের পুরুষদের অনেক আগেই অবসরে যেতে হয়৷ ফলে বাড়তি কিছু রোজগার না হলে তাদের অবসর জীবনে আর্থিক কষ্টে ভোগার আশঙ্কা থেকেই যায়৷
যদিও অবকাঠামোগত দিক দিয়ে নারীরা পুরুষের তুলনায় সুযোগ সুবিধা তেমন একটা কম পান না, তা সত্ত্বেও উপার্জনের দিক দিয়ে ব্যবধানটা অনেক বড়৷ এই বিষয়ে সংবাদমাধ্যম জার্মান ফুটবল ফেডারেশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বহুবার৷ তবে ফেডারেশন নারী আর পুরুষের আয়ের ব্যবধানকে সাদা চোখে দেখতে রাজি নয়৷ বরং তাদের ভাষ্য হচ্ছে, পুরুষ ফুটবলের জনপ্রিয়তা, স্পন্সরশিপ, টিভি সত্ত্বসহ নানা দিক থেকে যে আয় হয়, তার সঙ্গে নারী ফুটবলের তুলনা চলে না৷
অথচ জার্মান নারী ফুটবল দলও বিশ্বকাপে অন্যতম সফল ফুটবল দল৷ এরইমধ্যে দু'বার বিশ্বকাপ জয় করেছে এই দল৷ কোয়ার্টার ফাইনালের আগে বাদ পড়েনি কোনবারই৷ অথচ সেই দলও কি না আর্থিক বিবেচনায় পুরুষ দলের মতো লাভজনক নয়?
জার্মান ফুটবল ফেডারেশনের মতো যুক্তি অবশ্য আরো অনেকেই দেয়৷ এটা অস্বীকারেরও উপায় নেই যে, নারী ফুটবলের প্রতি দর্শকদের আগ্রহ যেকোন কারণেই হোক অনেক কম৷ যেকারণে পুরুষদের বিশ্বকাপ চলাকালে সর্বত্র যে উচ্ছ্বাস দেখা যায়, নারীদের ক্ষেত্রে সেটা অনেক কম৷ এমন কি আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষই পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে স্টেডিয়ামে যান নারীদের ফুটবল খেলা দেখতে৷
এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে লাভ-লোকসানের হিসেব কষতে গেলে পুরুষের পাল্লা অনেক ভারি৷ এইতো কিছুদিন আগেই জানা গেলে ব্রাজিলের নেইমার শুধু ২০১৭-২০১৮ মৌসুমে পিএসজি থেকে স্পন্সরশিপ বাদেও যা আয় করছেন, তা ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, অ্যামেরিকা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া এবং মেক্সিকোর ১,৬৯৩ জন নারী ফুটবলারের মোট রোজগারের সমান!
তবে লাভ-লোকসানের হিসেব কষে নারীদের বঞ্চিত করার দলে নেই আমি৷ আমি মনে করি, ফুটবল ফেডারেশনগুলোর উচিত নরওয়েকে অনুসরণ করা৷ রাষ্ট্রের তরফ থেকে নারী এবং পুরুষ ক্রীড়াবিদদের বেতন একই করা হোক৷ বাকি লাভের চিন্তা পরে করা যাবে৷
পুরুষদের ফুটবলে পাঁচ নারী রেফারি
গত রবিবার নতুন এক ইতিহাস হলো জার্মান ফুটবলে৷ প্রথমবারের মতো বুন্ডেসলিগায় পুরুষদের এক ম্যাচ পরিচালনা করলেন নারী রেফারি বিবিয়ানা স্টাইনহাউস৷ বিশ্ব ফুটবলে এমন কৃতিত্ব আছে আর মাত্র চারজনের৷
ছবি: imago/Zumapress
বিবিয়ানা স্টাইনহাউস (জার্মানি)
ছিলেন ফুটবলার৷ একসময় হয়ে গেলেন রেফারি৷ রেফারি হিসেবে তাঁর কৃতিত্বের স্মারক ছয়টি জাতীয় পুরস্কার৷ ছয়বার জার্মানির সেরা রেফারি হয়েছেন তিনি! তবে এতদিন শুধু ৮০টি দ্বিতীয় বিভাগ লিগ ম্যাচেই রেফারির ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে৷ গত রবিবার হ্যার্থা বার্লিন বনাম ভ্যেরডার ব্রেমেন ম্যাচের মাধ্যমে প্রথম নারী রেফারি হিসেবে বুন্ডেসলিগায়ও অভিষেক হয়ে গেল তাঁর৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Schmi
নিকোল পেটিগনাট (সুইজারল্যান্ড)
সুইজারল্যান্ডের এই সাবেক রেফারির কৃতিত্বটা অনন্য৷ নারী হয়েও উয়েফা কাপে পুরুষদের ম্যাচ পরিচালনা করার প্রথম নজির গড়েন তিনি ২০০৩ সালে৷ এছাড়া সুইস সুপার লিগ এবং অস্ট্রিয়ান বুন্ডেসলিগাতেও রেফারির ভূমিকায় অনেকবার দেখা গেছে তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/Pressefoto ULMER
গ্লাডিস লেংওয়ে (জাম্বিয়া)
জাম্বিয়ায় পুরুষদের পেশাদার ফুটবল লিগ ম্যাচ পরিচালনা করা প্রথম নারী রেফারি গ্লাডিস লেংওয়ে৷ নারীদের বিশ্বকাপসহ অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচেও রেফারির ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Jaspersen
ক্লাউডিয়া উমপিয়েরেজ (উরুগুয়ে)
উরুগুয়ের হয়ে খেলেছেন দীর্ঘদিন৷ তবে এখন রেফারির ভূমিকায় দেখা যায় তাঁকে৷ উরুগুয়েতে পুরুষদের ফুটবল লিগের প্রথম নারী রেফারি তিনি৷
ছবি: imago/Zumapress
কাটেরিনা মনজুল (ইউক্রেন)
গত ১৩ বছরে দেশে-বিদেশে অনেক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন তিনি৷ ইউক্রেনে পুরুষদের ম্যাচ পরিচালনা করা প্রথম নারী রেফারি কাটেরিনা মোনজুল৷
ছবি: Imago/VI Images
5 ছবি1 | 5
আরাফাতুল ইসলামের লেখাটি কেমন লাগলো? লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷