বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে৷ আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল এবং একমাত্র লক্ষ্য ছিল একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা৷ কিন্তু বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের চেয়ে বড় দায়িত্ব হিসাবে বেছে নিয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারকে৷ আর এখানেই যত সংকটের শুরু হয়েছে৷
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের নানা বক্তব্যে আমরা জানতে পেরেছি, গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পলায়ন এবং সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় সরকার গঠনের চেষ্টা করা হয়েছিল৷ কিন্তু বিএনপি সেই সরকারে অংশগ্রহণ করতে চায়নি বলেই সেটা আর সম্ভব হয়নি৷ ফলে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক যে ঐক্য প্রয়োজন ছিল, সেটি দিন দিন আরো কঠিন হয়েছে৷
এরপর থেকে আমরা দেখেছি ধীরে ধীরে সরকার, আন্দোলনকারী এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা ইস্যুতে পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে৷ এর কারণ হিসাবেও মোটা দাগে বলা যায়, ভবিষ্যত বাংলাদেশের নীতি কী হবে সেই দ্বন্দ্বই কাজ করছে৷
এখন দেশের প্রতিটি পক্ষই ‘সিঁদুরে মেঘ' দেখে ভয় পাওয়া ‘ঘরপোড়া গরুর' মতো আচরণ করছে৷ নানা কর্মকাণ্ড দেখে বাংলাদেশের সেক্যুলাররা ভয় পাচ্ছেন মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কিনা৷ বিএনপি ভয় পাচ্ছে, ১/১১ এর মতো তাদের দলে ভাঙন ধরিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা হয় কিনা৷ ইসলামিস্টরা ভয় পাচ্ছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের ক্ষমতা খর্ব হয়ে যায় কিনা৷ আন্দোলনের নেতারা ভয় পাচ্ছেন, গণঅভ্যুত্থান কোনো কারণে ব্যর্থ হলে বা পরবর্তী বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা তাদের মনমতো না হলে, তাদের ফাঁসিতে ঝুলতে হয় কিনা৷
এইসব ভয়ের কোনোটিকেই অমূলক বলার মতো যথেষ্ট কারণ এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই৷
সরকারের ভবিষ্যত বাংলাদেশ নিয়ে সুস্পষ্ট নীতি ও ঘোষিত লক্ষ্য না থাকায় পরিস্থিতি আরো বেশি জটিল হয়ে উঠছে৷ সরকারও যে আসলে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করছে না, একই ইস্যুতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বক্তব্য ও অবস্থানই তার প্রমাণ৷ কয়েকটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে৷
সঠিক-বেঠিক আন্দোলন, অনুভূতির বৈষম্য
কীভাবে গুটিকয়েক আন্দোলনকারীর দাবির মুখে পুরো দেশের শিক্ষার্থীদের এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হলো, সেটা তো সবারই মনে আছে৷ কিন্তু এরপর আনসার সদস্যরা যখন তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে একই পদ্ধতিতে সচিবালয়ে গেলেন, তাদেরকে আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী আখ্যা দিয়ে রাজু ভাস্কর্যে মানুষ জড়ো করে রীতিমতো পিটিয়ে এলাকাছাড়া করা হলো৷
এরপর আমরা আরো অনেক আন্দোলন দেখেছি৷ কিন্তু একই রকম ঘটনায় সরকার ও তাদের বাহিনীর ভিন্ন অবস্থান ও আচরণ বিচলিত হওয়ার মতোই৷
রীতিমতো ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙার ঘটনা ঘটেছে৷ এ নিয়ে ফেসবুকে হুংকার দিয়েছেন সরকারে থাকা একাধিক ব্যক্তি৷ কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা কি নেয়া হয়েছে? আমার চোখে পড়েনি৷ বরং ইসলাম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে পুলিশের হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে থানা থেকে‘ছিনিয়ে নিয়ে' গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে৷
৫ সেপ্টেম্বর খুলনায় ইসলামের নবীকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটূক্তি করে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে উৎসব মণ্ডল নামের এক ব্যক্তি গণপিটুনির শিকার হন৷ তিন বাহিনীর উপস্থিতিতে থানা থেকে বের করে তাকে গণপিটুনি দেয়া হয়৷ তার মৃত্যু হয়েছে, এমন বিবৃতিও দেয় পুলিশ৷ যদিও পরে আবার পুলিশই জানায় যে উৎসব বেঁচে আছেন, সেনা হেফাজতে আছেন৷
৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়ায় পার্থ বিশ্বাস পিন্টুর বিরুদ্ধে কটূক্তির অভিযোগ তুলে তাকে পিটিয়ে মারার দাবি তোলেন৷ পুলিশ রাজি না হওয়ায় থানা ভাংচুর করা হয়, সেনাবাহিনীর গাড়িতে হামলা হয়৷
২৮ অক্টোবর ফরিদপুরে হৃদয় পালকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ' একটি ফেসবুক পোস্টের জন্য পিটিয়ে মারার পরিস্থিতি তৈরি হয়৷ কেন এই পোস্ট প্রশ্নবিদ্ধ বলছি, জানতে পারবেন এই সংবাদটি পড়লে৷
এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে গত কয়েক মাসে৷ এমন নয় যে এগুলো এই প্রথম ঘটছে বা কেবল এই সরকারের আমলেই ঘটছে৷ গত ১৬ বছরেও এমন ঘটনা ঘটেছে, তার আগেও ঘটেছে৷ তবে ‘নতুন বাংলাদেশে' কি পুরাতন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার কথা ছিল? ফরিদপুরের ঘটনায় ‘জনতাকে সন্তুষ্ট করতে' একটা মানুষকে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে সেনাবাহিনী চোখ বেঁধে পিটিয়েছে৷
এবার আসুন খুবই বিরল একটি বিপরীত চিত্র দেখি৷
চট্টগ্রামে ৫ নভেম্বর হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন ইসকনকে নিয়ে ‘কটূক্তির' অভিযোগে ওসমান আলী নামের এক ব্যবসায়ীর দোকান ঘেরাও করেন হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু বিক্ষুব্ধ লোক৷ এক্ষেত্রেও পুলিশ আসে, বিক্ষুব্ধ জনতার কাছ থেকে তারা অভিযুক্তকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা করে৷
দুই জনতার আচরণে কী অদ্ভূত মিল! কিন্তু সেনাবাহিনী ও পুলিশের হামলা পরবর্তী আচরণ কি একই ছিল? হামলার পর রাতভর হিন্দু অধ্যুষিত হাজারী গলির বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ব্যাপক লাঠিপেটা করে, সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে, ৬০০ জনকে মামলার আসামি করা হয়, ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
আগে যেমন প্রতিটি ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে আমরা একই ধরনের বিবৃতি পেতাম পুলিশের কাছ থেকে, এখনও প্রতিটি ঘটনাতে মোটামুটি একই বক্তব্য৷ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকেই ‘উত্তেজিত জনতা' পেটায়, পরে সেই মার খাওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই চালান করা হয় আদালতে৷ যারা তাকে পিটিয়েছেন, তাদের আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার জন্য কোনো শাস্তির মুখোমুখি করা হয় না৷ তবে এর উলটোটা হবে কিনা, সেটা নির্ভর করছে অভিযুক্তের এবং বিক্ষুব্ধদের পরিচয়ের ওপর৷
ফলে সমাজে এক ধরনের বার্তা দেয়া হয়, তুমি সংখ্যালঘু হলে তোমাকে পেটানো জায়েজ৷ এখানে আইন সবার জন্য সমান, তবে কারো কারো জন্য একটু বেশি সমান৷
পাহাড়ে কেউ নিজেদের দাবি তুললে, তাকে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়, বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্যাগ দেয়া হয়৷ হিন্দুদের কেউ তাদের দাবি তুললে তাদেরকে ‘অন্য কোনো উদ্দেশ্য' আছে কিনা, এমন চিন্তা করতে হয়৷ অথচ হেফাজতে ইসলামসহ সংখ্যাগুরুদের নানা ধর্মীয় সংগঠন আরামসেই নিয়মিত নানা রকমের দাবি তুলে যাচ্ছেন, পাঠ্যপুস্তক সমন্বয় কমিটি বাতিল করাসহ তাদের নানা দাবি মেনেও নেয়া হচ্ছে৷ এক্ষেত্রে কোনো প্রশ্নও উঠছে না৷
শ্রমিকদের আন্দোলন, সংখ্যালঘুদের আন্দোলন, এমনকি অতিসম্প্রতি গণঅভ্যুত্থানে আহতদের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও আমরা শুনেছি আন্দোলনে ‘বিশেষ পক্ষ' ঢুকে অস্থিরতা তৈরি করছে কিনা! যে-কোনো আন্দোলন দানা বাঁধলে একই ধরনের বক্তব্য আমরা শেখ হাসিনা ও তার দল-সরকারের নেতাদের মুখ থেকেও শুনতাম৷ রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক মানুষের মৃ্ত্যুর পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ‘হরতালকারীরা পিলার ধরে নাড়া দিয়েছিল', এমন বক্তব্য মনে আছে তো?
কোটা আছে, নাকি নাই?
কোটার বদলে মেধাকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টিই ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের মূল দাবি৷ কিন্তু সরকারের উপদেষ্টাই এখন কোটায় নিয়োগ হচ্ছে কিনা, এমন প্রশ্ন উঠেছে খোদ আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকেই৷
ফেসবুকে সক্রিয় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলমের কয়েকটি স্ট্যাটাস দেখা যাক৷ ১৪ নভেম্বর নিজের ফেসবুক স্টোরিতে পোষ্য কোটার বিরুদ্ধে দেয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমানের একটি বক্তব্য শেয়ার করেন৷ অথচ ১০ নভেম্বর একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ১৩ জন উপদেষ্টা নিয়োগ করায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করেন৷
প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি মেধাকেই প্রাধান্য দেয়া হয় তাহলে উপদেষ্টাদের বাড়ি চট্টগ্রামে নাকি উত্তরবঙ্গে, সেটা কেন বিবেচ্য বিষয় হবে? আবার অন্তর্বর্তী সরকারকেও প্রশ্ন করা যায়, মেধা বিবেচনায় উপদেষ্টা নিয়োগ করা হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কি নিজের এলাকার, নিজের প্রতিষ্ঠানের লোকজন ছাড়া কাউকে মেধাবী মনে করেন না? নাকি এখানে মূল বিষয়টা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের?
কে দোসর, কে না?
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে, জামায়াত ও রাজাকার কার্ড ব্যবহার করা হয়েছে হরেদরে৷ এর ফলে কী হয়েছে? স্বাধীনতাবিরোধী এবং রাজাকারের মতো শব্দগুলোকে খেলো বানিয়ে এখন হাস্যরসে পরিণত করা হয়েছে৷ যার পরিণতি হলো, শিক্ষার্থীদের ‘আমি রাজাকার' বলে স্লোগান এবং জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেয়া৷
এখন যেভাবে কারো বক্তব্য পছন্দ না হলেই হরেদরে ফ্যাসিস্ট এবং আওয়ামী লীগের দোসর বানিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ ঘর পোড়া গরুর প্রবাদটি আরেকবার মনে করিয়ে দিলে এমন আশঙ্কা উঠতেই পারে যে, ফ্যাসিস্ট শব্দটাকেও খেলো বানিয়ে ফেলা হলে ভবিষ্যতে আবার ‘তুমি কে আমি কে, ফ্যাসিস্ট ফ্যাসিস্ট' স্লোগান তোলা শুরু করে কিনা৷
সবশেষ বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে দুই উপদেষ্টার নিয়োগ নিয়ে৷ একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অন্যজন ব্যবসায়ী বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন৷ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা শেখ হাসিনার শাসনামলে তার কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়েছেন৷ ফারুকীর বিরুদ্ধে অভিযোগটা বেশি, কারণ তিনি ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন বরাবরাই৷ ফলে তার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পুরাতন নানা স্ট্যাটাস আমরা ভাইরাল হতে দেখেছি৷ তার স্ত্রী অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার' সিনেমায় অভিনয়ের বিষয়টিও এখানে আলোচনায় উঠে এসেছে৷
এই আলোচনায় সমস্যা দেখি না৷ কিন্তু একই ধরনের পরিস্থিতিতে অন্যদের ক্ষেত্রে বক্তব্য কী?
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ফারুকীর দেয়া স্ট্যাটাসের কাছাকাছি রকমের স্ট্যাটাস গত কয়েকবছর ধরেই দিয়ে এসেছেন আরেক উপদেষ্টা আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক আসিফ নজরুল৷ কিন্তু তার ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের আচরণ অনেকটাই ভিন্ন৷
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা ফারুকীর নিয়োগের প্রতিবাদে রীতিমতো আন্দোলন করেছেন৷ এই আন্দোলনের অন্যতম দুই নেতা সারজিস আলম এবং হাসনাত আবদুল্লাহর বিরুদ্ধেই কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা ইস্যুতে দেয়া নানা অতীত বক্তব্য রয়েছে৷ এক্ষেত্রে একই যাত্রায় ভিন্ন ফল কেন? যে-কোনো ইস্যুতে একটা নীতি তো থাকতে হবে৷ ফারুকী যে দোষে দুষ্ট, অন্যরা কেন নয়?
সারজিস অবশ্য একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন ছাত্রলীগ নিয়ে৷ তার দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকে বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগ করেছেন হলে সিট পাওয়ার জন্য, নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে৷ এটা সত্যও হতে পারে, নিজের অতীতকে জাস্টিফাই করার চেষ্টাও হতে পারে, আমি জানি না৷ তবে তিনি যদি একদা ছাত্রলীগ করে, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ নিয়ে উদ্বেলিত ভাষণ দিয়ে এখন বঙ্গবন্ধুকে ফ্যাসিস্ট বলে আন্দোলনের নেতা হতে পারেন, ফারুকী কেন একসময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে এখন হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বলে উপদেষ্টা হতে পারবেন না?
আমি যুক্তিটা বোঝার চেষ্টা করছি, পারছি না বলেই এমন আচরণকে দ্বিচারিতা বলে মনে হচ্ছে৷
ছাত্ররাজনীতি, পাবলিক-প্রাইভেট বৈষম্য
আন্দোলনের সময় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি সামনে নিয়ে এসেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন৷ এর পেছনে বিপুল জনসমর্থন ছিল বলে খালি চোখেই বোঝা যায়৷ কিন্তু আন্দোলন সফল হওয়ার পর কী ঘটছে?
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কমিটি ঘোষণা হলো৷ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্র শিবির আলোচনা সভা এবং সংবাদ সম্মেলনও করেছে৷ অ
অথচ, বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে' দেয়ালে পোস্টার লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়৷ ৭ নভেম্বর রাতেই বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন৷ কেন? কী উদ্দেশ্য? সবার ব্যাপারে একই নীতি না থাকলে সেটা কেমন বৈষম্যবিরোধিতা?
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল৷ অনেকে হতাহতও হয়েছেন এই আন্দোলনকে সফল করতে গিয়ে৷ কিন্তু আন্দোলন সফল হওয়ার পর সব ক্ষেত্রেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷ ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসাবে এখন অন্তর্বর্তী সরকারে তিন উপদেষ্টা রয়েছেন৷ এদের প্রত্যেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী৷
এমনকি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা হিসাবে সবার সামনে যাদের দেখা যায়, তারাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী৷ এই বৈষম্য নিয়েও নানা ধরনের ক্ষোভ দেখা দিয়েছে নানা জায়গাতেই৷
সংবিধানে বৈষম্য নিয়ে আদালতে দ্বিচারিতা
বৈষম্যবিরোধী একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম একটি কাজ হিসাবে দেখা হচ্ছে সংবিধান সংস্কার৷ সংবিধান সংশোধন করা হবে, নাকি পুনর্লিখন, এ নিয়ে এখনও রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি করা সম্ভব হয়নি৷ তবে পঞ্চদশ সংশোধনী যে সংবিধানে কর্তৃত্ববাদী শাসনের পথ তৈরি করে দিয়েছে, এ ব্যাপারে প্রায় সকলেই একমত৷
বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমে প্রায় অদৃশ্য একটি সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি৷
১৩ নভেম্বর হাইকোর্টে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সংবিধান থেকে ‘জাতির পিতা', ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ' এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' বিষয়গুলো বাদ দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন৷
এক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে যে যুক্তি দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল, ঠিক তার বিপরীত যুক্তি দিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়ার যুক্তিতে৷
সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ' ইস্যুতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, এতে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অবদানকে ছোট করা হয়৷ মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা চাকমা, মারমাসহ অন্যান্য ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে যথাযথভাবে সম্মান করা হচ্ছে না বলে তিনি মন্তব্য করেন৷
আমি একমত৷ বাংলাদেশকে সবার জন্য সমান একটি দেশই হওয়া উচিত৷ যাতে নির্দিষ্ট কোনো জাতি নিজেদের আইনগত বা সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যদের চেয়ে ক্ষমতাশালী মনে না করে৷ এর সঙ্গে সংখ্যার কোনো সম্পর্ক থাকা উচিত নয়৷ একজন মানুষও যদি মনে করে রাষ্ট্র তার প্রতি বৈষম্য করছে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সেই চিন্তাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা৷
কিন্তু সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' নিয়ে ঠিক তার পালটা যুক্তি দিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল৷ তিনি বললেন, সংবিধানের ২ (ক) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম উল্লেখ আছে এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে৷ তার মতে, এর কারণে ধর্মনিরপেক্ষতা ধারণা এখানে অপ্রয়োজনীয়৷
এটা কেমন হলো? যে কারণে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকতে সমস্যা নেই, সেই একই কারণে তো বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকতেও সমস্যা দেখছি না৷ আবার যে যুক্তিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাদ দিতে চাইছেন, সেই একই যুক্তিতে তো ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্ব মানুষকে যথাযথভাবে সম্মান করা হচ্ছে না' দাবি করাই যেতে পারে৷ মুক্তিযুদ্ধে কি অন্য ধর্মের মানুষেরা অবদান রাখেননি?
এখন ‘৯৯ শতাংশ বাঙালির দেশে' কেউ বলতেই পারে, সংবিধানে ‘রাষ্ট্রজাতি' হিসাবে বাঙালি অন্তর্ভুক্ত করেন এবং সেই সঙ্গে ফুটনোটে লিখে দেন- ‘‘তবে, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা হবে৷''
এটা মানবেন?
মানার প্রয়োজন নেই৷ কিন্তু একেকসময় একেক কথা না বললে নীতি বুঝতে জনগণের সুবিধা হবে৷ রাজনীতিবিদদের কারণে নিজের পছন্দমতো একেকসময় একেক যুক্তি দেয়ার ব্যাপারটাতে বাংলাদেশিরা দীর্ঘদিন ধরে অভ্যস্ত৷ এবার অন্তত নতুন কিছু হোক, নীতির কিছু হোক৷