‘সবার অধিকার নিশ্চিতের বার্তা দেয়া আলেম সমাজের দায়িত্ব’
২২ অক্টোবর ২০২১
বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর সাম্প্রতিক হামলার ঘটনার প্রেক্ষিতে সবার অধিকার নিশ্চিতের বার্তা দিতে আলেম সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি৷
বিজ্ঞাপন
‘ডয়চে ভেলে খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’ ইউটিউব টকশোতে এবারের আলোচনার বিষয় ছিল: গুজবের মন ও জ্বালাও-পোড়াও৷ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘‘তৃণমূলে বিভিন্ন ধরনের গোষ্ঠীস্বার্থ, সাম্প্রদায়িক চিন্তা বিভিন্ন কিছু কাজ করে সংখ্যালঘুদের আক্রমণের যেসব ঘটনা ঘটে তার পিছনে৷ গোষ্ঠীস্বার্থ যখন চলে আসে তখন দেখা যায় যে কর্মী সেখানে জড়িত হয়ে যাচ্ছে সে দেখা যায় অনেক সময় দলের আদর্শের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে ফেলে৷’’
তিনি মনে করেন, সহিংসতা শুরুর পরপরই আওয়ামী লীগ তার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছে৷ নেতকর্মীরা ঘটনাস্থলগুলোতে ছুটে গেছেন৷ কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না৷ এছাড়া প্রশাসন যেভাবে তৎপর হওয়ার কথা ছিল সেটিও সন্তোষজনক ছিল না৷ বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে নিরাপত্তা দেয়ার কথা ছিল সেখানে ব্যর্থতা আছে৷
জোনায়েদ সাকি তার আলোচনার শুরুতেই রংপুরের পীরগঞ্চে হামলার শিকার হিন্দু পল্লী পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন৷ তার মতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা বাংলাদেশের জন্য লজ্জার৷ এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে আলেম সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমরা কিছুদিন আগে ভারতে আসামে মুসলমানদের উপর অত্যাচার হতে দেখেছি, তাদের হত্যা করতে দেখেছি, এর আগে বহু ঘটনা দেখেছি৷ বিজেপি সেখানে একটা উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করে তার স্বার্থে তারা সেখানে হামলা চালায়৷ বাংলাদেশে একইভাবে যদি মুসলিম সম্প্রদায়ের কতিপয় লোক এটা করে এবং সামগ্রিকভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর একই অভিযোগ আসে, বিজেপি সেটা ভারতে বসে করে তখন বাংলাদেশে যারা বিপুল সংখ্যক মুসলমান সম্প্রদায় বাস করছেন তাদের জন্য কি এটা সম্মানের হয়? বাংলাদেশের বিবেকবান, দায়িত্ববান আলেম সমাজ দেশের ধার্মিক মানুষকে নিশ্চিতভাবে এখন তাদের উচিত আমি তাদের কাছে আহ্বান জানাব অন্তত তারা এই বার্তাটা দিবেন ইসলাম ধর্মের যে বাণী সেটাতো বটেই এবং রাষ্ট্র হিসেবে এই দেশে সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত রাখা, তাদের জীবন ও সম্মানের অধিকার নিশ্চিত রাখা এইটা সবার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে৷ সেই বার্তা যদি ধার্মিকদের মধ্যে আপনারা দিতে না পারেন এই দায় আপনাদেরও৷’’
দুই আলোচকের কাছেই প্রশ্ন ছিল ৭২ এর সংবিধান ও রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে৷ এই বিষয়ে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অবস্থান কী এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আরাফাত বলেন, ‘‘৫০ বছরের ইতিহাসে ২৮ বছর এদেশ ছিল উল্টাদিকে৷ এই ২৮ বছরে যে সাম্প্রদায়িকতার শিকড় ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে সেটিকে উপড়ে ফেলে ১২ বছরে আওয়ামী লীগ সব শুদ্ধ করে ফেলবে তেমন না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ চায় সংবিধান থেকে সমস্ত সাম্প্রদায়িক উপাদান বাতিল করতে৷ তার প্রমাণ হচ্ছে একজন প্রতিমন্ত্রীও এই কথা জোর গলায় বলে যাচ্ছেন৷ আওয়ামী লীগ তার বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি৷’’
রাষ্ট্রধর্ম ইস্যুতে বলতে গিয়ে জোনায়েদ সাকি দাবি করেন, এই মুহূর্তে রাষ্ট্রধর্ম ইস্যু তৈরি করে সরকার বিভাজনের রাজনীতি করতে চায়৷ আওয়ামী লীগ আমলে রামু থেকে এখন পর্যন্ত যতগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে তার জন্য প্রধানত আওয়ামী লীগ দায়ী বলে মনে করেন তিনি৷ কেননা যেসব গুজব ছড়ানোর পর বিভিন্ন হামলার ঘটনা ঠেকাতে প্রশাসন যথাযথ ভূমিকা নেয়নি, বড় সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগও তাদের ভূমিকা পালন করেনি৷
তিনি বলেন, ‘‘ঘটনা যখন ঘটে গেছে তখন আমরা অসাম্প্রদায়িক, আমরা অসাম্প্রদায়িক বলে তারা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে নেমেছেন এবং দেশকে বিভাজিত করতে চাইছেন৷ যখন আমাদের ভোটের অধিকার নিয়ে কথা বলার কথা তখন উনি চাইছেন এই বিভাজনের রাজনীতিটাকে শক্তিশালী করি৷’’
তার মতে, ‘‘একমাত্র গণতন্ত্রের গতিমুখে ফেরা হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য সমাধান৷ ...আজকে এই ঘটনায় ভারতে বিজেপি লাভবান হচ্ছে তারা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে৷ (বাংলাদেশে) সরকার লাভবান হচ্ছে কারণ সরকার এই মুহূর্তে এই বিভাজনটা তৈরি করতে চাচ্ছে৷ আর একটা উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী লাভবান হচ্ছে৷ যারা বাংলাদেশে এই ঘটনাগুলোতে লাভবান হতে চায়৷ সরকার চায় এইরকম একটা উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তৈরি হোক৷ যাতে তাদেরকে দমনের নামে তাদের ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে পারবে এবং এই দেশে দীর্ঘসময় তারা তাদের রাজত্ব কায়েম করতে পারবে৷’’
এফএ/এআই
হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা পরিক্রমা
কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে কোরআন পাওয়া যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের উপর হামলা হয়েছে৷ ইকবাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি কোরআনটি সেখানে রেখেছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
কুমিল্লায় শুরু
১৩ অক্টোবর বুধবার দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন কুমিল্লার নানুয়া দীঘি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে চকবাজার এলাকায় (কাপুড়িয়াপট্টি) শত বছরের পুরনো চাঁন্দমনি রক্ষাকালী মন্দিরে সকাল ১১টায় প্রথম হামলা হয়৷ এর আগে সকালে পূজা মণ্ডপ থেকে পবিত্র কোরআন উদ্ধার করেন কোতোয়ালী থানার ওসি আনোয়ারুল আজিম৷ কোরআন রাখার অভিযোগে ইকবাল হোসেন (৩৫) নামের এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
অন্যান্য জেলায় হামলা
কুমিল্লা ছাড়াও একইদিন চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, গাজীপুর, কুড়িগ্রাম, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ভোলা, চট্টগ্রাম, ও কক্সবাজারে হামলা হয়েছে বলে ১৬ অক্টোবর জানায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ৷ এছাড়া ১৪ অক্টোবর বান্দরবান ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে হামলার ঘটনা ঘটে৷ আর ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর চৌমুহনী ও চট্টগ্রামে হামলা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
তিন দিনে ৭০ মণ্ডপে হামলা
১৬ অক্টোবর শনিবার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ জানায়, দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন দিনে ৭০টি পূজা মণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে৷ এসবের বাইরে ৩০টি বাড়ি এবং ৫০টি দোকানেও ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
ফেনীতে হামলা
মন্দিরে মণ্ডপে হামলার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদের আহ্বানে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছিল৷ ফেনীতে সেই কর্মসূচির প্রস্তুতি চলার সময় হামলা হয়৷ এরপর শহরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়৷ কয়েকটি মন্দির ও হিন্দুদের মালিকানাধীন বেশ কিছু দোকানপাটে ভাঙচুর, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ পাওয়া যায়৷ বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ফেনীতে থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
রংপুরের পীরগঞ্জে হামলা
১৭ অক্টোবর রোববার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জের এক হিন্দু তরুণের ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে রামনাথপুর ইউনিয়নে জেলেপল্লির হিন্দু পরিবারের উপর হামলা হয়৷ হামলাকারীরা ঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুটপাটও করে৷
ছবি: bdnews24.com
নয় বছরে ৩,৬৭৯ হামলা
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর তিন হাজার ৬৭৯টি হামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে এক হাজার ৫৫৯টি বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা৷ ৪৪২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা৷ আর প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৬৭৮টি৷ এসব হামলায় আহত হয়েছেন ৮৬২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী৷ নিহত হয়েছেন ১১ জন৷
ছবি: Tarun Chakraborty Bishnu
প্রতিবাদ
সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে৷ শাহবাগের আন্দোলনকারীরা তিন দফা দাবি পূরণ করতে সরকারকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছেন৷ দাবিগুলো হলো, দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে দোষীদের বিচার; ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং আহত ও নিহতদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
হিন্দুদের প্রতিবাদ
সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ১৮ অক্টোবর সোমবার হিন্দুদের প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়েছে৷
ছবি: Mahmud Hossain Opu/AP/picture alliance
জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ
কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে ১৫ অক্টোবর শুক্রবার জুমার নামাজের পর ‘মালিবাগ মুসলিম সমাজ’ এর ব্যানারে ঢাকার বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের করেন কয়েকশ মানুষ৷ কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড়ের কাছে পুলিশ বাধা দিলে মিছিলকারীরা দুই ভাগ হয়ে যান৷ তাদের একটি অংশ বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে শুরু করে৷ পুলিশ তখন বিভিন্ন গলির মুখে অবস্থান নেয় এবং টিয়ারশেল ও শটগানের গুলি ছোঁড়ে৷
ছবি: bdnews24.com
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বিক্ষোভ
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ব্যানারে প্রায় দশ হাজার মুসলিম ১৬ অক্টোবর শনিবার বায়তুল মোকাররমের সামনে বিক্ষোভ করেন৷ ইসলাম অবমাননার অভিযোগে তারা এই বিক্ষোভ করেন৷
ছবি: Abdul Goni/AP Photo/picture alliance
মাশরাফির প্রতিক্রিয়া
সোমবার ফেসবুকে পীরগঞ্জে হামলার ছবি শেয়ার করে মাশরাফি লেখেন, এই ঘটনা তার হৃদয় ভেঙে চুরমার করেছে৷ ‘‘এ লাল সবুজতো আমরা চাইনি৷ কতো কতো স্বপ্ন, কতো কষ্টার্জিত জীবন যুদ্ধ এক নিমিষেই শেষ৷ আল্লাহ আপনি আমাদের হেদায়েত দিন৷’’
ছবি: Facebook
১০২ মামলা, গ্রেপ্তার ৫৮৩
হিন্দুদের মন্দির, মণ্ডপ, প্রতিমা ও বাড়িঘরে সাম্প্রদায়িক হামলায় শুক্রবার পর্যন্ত ১০২টি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস৷ হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৫৮৩ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্যও দিয়েছে তারা৷