শিশুর জন্য মাতৃদুগ্ধের কোনো বিকল্প নেই৷ অথচ সেই দুধ যদি কোনো মা তাঁর শিশুকে জনসমক্ষে পান করান, তাহলেই বিপত্তি৷ সিনেমা বা নাটকে খোলামেলা পোশাক পরলে বা যৌন দৃশ্যে অভিনয় করলেও হয়ত নারীর এমন সম্মানহানি হয় না!
বিজ্ঞাপন
অদ্ভুত আমাদের সমাজ৷ একদিকে ‘মা'-কে আমরা মাথায় করে রাখি, অন্যদিকে মাতৃদেহ দেখি লোলুপ দৃষ্টিতে৷ তা না হলে, একটি মা নিজের শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে, হোক না তা জনসমক্ষে, এত কটাক্ষ আসে কোথা থেকে? সর্বসমক্ষে স্তন্যপান করানোকে কেন ভালো চোখে দেখি না আমরা?
এই তো সেদিনও সন্তানকে প্রকাশ্যে স্তন্যপান করানোর অভিযোগ এক মা-কে হত্যা করে বসে তথাকথিক ‘ইসলামিক স্টেট' বা আইএস৷ এ তো না হয় একটি জঙ্গি সংগঠনের কার্যকলাপ৷ কিন্তু সম্প্রতি ব্রিটেনে যা ঘটে গেল, তারও জুড়ি মেলা ভার৷
লন্ডন মেট্রোতে সেদিন একটি মেয়ে হঠাৎ করেই তাঁর কোলের সন্তানটিকে বুকের দুধ খাওয়াতে শুরু করেন৷ কিছুক্ষণের মধ্যে জনৈক তরুণ তার বিরোধিতা করে ওঠে৷ শুরু হয় বচসা, তারপর চ্যাঁচামেচি৷ শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়ারও কথা হয়৷ কিন্তু গল্পটা সে'পর্যন্ত যায় না, কারণ, পুরো ঘটনাটা ছিল একটা ‘সামাজিক পরীক্ষা'৷
তবে এমন ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ তো বটেই, ইংল্যান্ডের মতো আপাত আধুনিক দেশেও আকছারই ঘটছে৷ এই যেমন কয়েক মাস আগে এক মা লন্ডনের একটি দোকানে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে গেলে, দোকানের এক কর্মকর্তা তাঁকে বের করে দেন৷ বলা হয়, দোকানে নাকি প্রকাশ্যে স্তন্যপান করানোর নিয়ম নেই৷ অথচ ব্রিটেনের সংবিধানের ‘ইকুয়ালিটি অ্যাক্ট ২০১০' অনুযায়ী, সব মায়েদেরই যে কোনো সার্বজনীন এলাকায় নিজের শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর অধিকার রয়েছে৷
যা-ই হোক, সে সময় উপস্থিত অন্যান্য ক্রেতারাও দোকান কর্তৃপক্ষের এমন ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হন৷ অবশ্য এ ঘটনার ক'দিন বাদে ঘটে আসল ঘটনাটি৷ একদিন সকালে দেখা যায় দোকানের সামনে প্রায় ৭০ জন মায়ের ভিড়৷ সকলের কোলেই ছিল একটি করে দুধের শিশু৷ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নিজ শিশুটিকে স্তন্যপান করাতে শুরু করেন তাঁরা৷ সকলে মিলে প্রতিবাদ করেন, যাতে বুকের দুধ খাওয়াতে গিয়ে নারীর আর সম্মানহানি না হয়৷ এমন প্রতিবাদের কথা আগে কখনো শুনেছেন কি?
ডিজি/এসিবি
মায়ের দুধের নানা গুণ
১লা আগস্ট ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃদুগ্ধ পান দিবস৷ এই দিবস পালন করা শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর থেকেই৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, মায়ের দুধ শিশুদের জন্য ম্যাজিক পানীয়৷ বিস্তারিত জানতে এই ছবিঘরটি দেখুন৷
শিশু পেটে আসার পর থেকেই মায়ের বুকে দুধ তৈরি হওয়া শুরু হয়৷ এর জন্য সাহায্য করে প্রোজেস্টেরন এবং প্রোলাকটিন নামের দুটি হরমোন৷ এই দুধ শিশুকে জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পান করানো যায়৷ তবে শিশু কতটা দুধ পাবে তা নির্ভর করে প্রথম স্তন্যপানের ওপর৷ অর্থাৎ শরীরের প্রোলাকটিন হরমনই মায়ের নার্ভ সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেভাবেই প্রয়োজনীয় দুগ্ধ উৎপাদন করে৷
ছবি: Svetlana Fedoseeva - Fotolia.com
শিশুদের জন্য সবচেয়ে ভালো
মায়ের দুধ শিশুদের শরীরে ম্যাজিকের মতো কাজ করে৷ শিশুর জন্মের প্রথম সপ্তাহে মায়ের দুধ পান করলে তা বাচ্চাকে অন্ত্র সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে এবং হজম করতে ও দুধ পান করার সময় পেটে বাতাস জমা থেকে রেহাই পেতেও সহায়তা করে৷ মায়ের দুধ শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং অ্যালার্জির বিরুদ্ধে কাজ করে৷ তাছাড়া মায়ের দুধ পান করার কারণে শিশুর মুখের তালু এবং মাড়ি শক্ত হয়৷
ছবি: Fotolia/Marcito
মায়ের দুধে কী আছে?
মায়ের দুধে কী আছে তার হিসেব অনেক লম্বা৷ এতে রয়েছে মিনারেল, ভিটামিন, ফ্যাট, পানি ইত্যাদি৷ মায়ের দুধে বিশেষ এক রকম ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা শিশুর চোখের জ্যোতি বাড়াতেও সাহায্য করে থাকে৷
ছবি: Getty Images
শালদুধ
সদ্য প্রসূতির স্তন থেকে বের হওয়া প্রথম দুধ৷ হলদেটে রং-এর এই দুধ পরিমাণে কম হলেও এতে থাকে শ্বেতকণিকা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা৷ শালদুধ শিশুর জন্য অত্যন্ত উপকারি, যা শিশুর জীবনের প্রথম টিকা হিসাবেও কাজ করে৷ শালদুধে থাকে আমিষ ও প্রচুর ভিটামিন-এ৷ শালদুধ শিশুর পেট পরিষ্কার করে এবং শিশুর জন্ডিস হবার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়৷
ছবি: imago/Xinhua
মায়ের দুধই কি যথেষ্ট?
নবজাতকের মা এক লিটারের মতো দুধ উৎপাদন করে থাকেন৷ শিশুরা সাধারণত প্রতিবার ২০০ থেকে ২২৫ মিলিগ্রাম দুধ পান করে৷ তবে একজন শিশুর যতটা দুধ প্রয়োজন শিশু চাইলে ঠিক ততটুকুই পায়৷
ছবি: Royal Holloway, University of London
কত বয়স পর্যন্ত স্তন্যপান করা উচিত
মায়ের দুধ শিশুদের আদর্শ পুষ্টিকর খাবার৷ তবে এ দুধ কতদিন শিশু পান করবে – সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জার্মানির জাতীয় মাতৃদুগ্ধ পান কমিশনের পরামর্শ: কমপক্ষে ছয়মাস মায়ের দুধ পান করানো উচিত৷ তবে চার মাসের পর থেকে নবজাতকদের মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবারও দেয়া যেতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দেশ ভেদে রয়েছে পার্থক্য
মায়ের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে একেক দেশে একেক রীতি প্রচলিত৷ যেমন মধ্য আফিকার ‘বফি’-তে সাধারণত সাড়ে চার বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করানো হয় বাচ্চাদের৷ অবাক করার মতো হলেও অনেক মা ১৬,০০০ লিটার দুধ উৎপাদন করে থাকেন৷ তবে সারা বিশ্বে গড়ে মায়েরা ৩০ মাস পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ পান করিয়ে থাকেন৷
ছবি: imago/blickwinkel
অন্য নারীর নয়, মায়ের দুধ চাই
বহুদিন আগে কিন্তু শিশুদের অন্য নারীর বুকের দুধ পান করানো হতো৷ পরবর্তীতে ১৮ শতক থেকে একটি প্রচারাভিযান চালানো হয়, যেখানে বলা হয় যে, মা-রাই যেন শিশুকে নিজের বুকের দুধ পান করান৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রকাশ্যে দুধ পান করানো
মা তাঁর শিশুকে প্রকাশ্যে দুধ পান করাচ্ছেন – এটা কিছু দেশের মানুষের কাছে তেমন পছন্দ নয়৷ তাই সেসব দেশে মা শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে এমন ছবি কেউ ফেসবুকে দিলে সেগুলো ফেসবুক থেকে মুছে ফেলা হয়৷
ছবি: Getty Images
শুধু শিশু নয়, মায়েরও উপকার হয়
যে মা তাঁর শিশুকে বুকের দুধ পান করান সেই মায়ের জরায়ু, স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ঝুঁকি কমে যায়৷ তাছাড়া দুধ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে সন্তান ও মায়ের মধ্যে তৈরি হয় এক নিবিড় সম্পর্ক৷