খবরটা শুনেছিলেন দুদিন আগে৷ কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছিল না৷ তারপর যখন ডয়চে ভেলে থেকে টেলিফোন করে জার্মানিতে আসার প্রস্তুতি নিতে বলা হয় তখনই কেবল বিশ্বাস হয়েছিল৷ কথাগুলো তথ্যকল্যাণী মাহফুজা আক্তারের৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্ব দরবারে এক মুহূর্তের জন্য হলেও তিনি বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন মঙ্গলবার৷ ডয়চে ভেলে আয়োজিত একটি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি এখন বন শহরে৷
জার্মানির পুরনো সংসদ ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মাহফুজা ‘গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম অ্যাওয়ার্ড' গ্রহণ করেন৷ সে সময় তিনি উপস্থিত দর্শকদের তথ্যকল্যাণী হিসেবে তার নিত্যদিনকার কাজ ও কীভাবে তাদের দ্বারা গ্রামের মানুষজন উপকৃত হচ্ছেন, তা জানান৷
অনুষ্ঠান শেষে ডয়চে ভেলের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মাহফুজা বলেন, ‘‘আমার শুধু মনে হচ্ছে, কোথায় ছিলাম আর কোথায় আসলাম৷ মনে হচ্ছে, এতোদিন পর আমার মতো তথ্যকল্যাণীদের কষ্টটা সার্থক হলো৷''
উচ্চমাধ্যমিক পাস করা মাহফুজা তথ্যকল্যাণী হিসেবে কাজ করছেন ২০১০ সাল থেকে৷ গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী ইউনিয়নে অবস্থিত তাঁর নিজের গ্রাম সহ আশেপাশের মোট পাঁচটি গ্রামে কাজ করেন তিনি৷
কী কাজ করেন?
মাহফুজার কাছে এই প্রশ্নটা রাখার পর যখন উত্তর পেলাম তখন মনে হলো প্রশ্নটা এভাবে না করে করতে হতো এভাবে, ‘‘কী করেন না!'' মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া থেকে শুরু করে নষ্ট মোবাইল সারানো, যেসব গ্রামবাসীর আত্মীয় দেশের বাইরে থাকেন তাদের সঙ্গে স্কাইপে কথা বলিয়ে দেয়া, শিশুদের ভিডিও দেখানোর মাধ্যমে লেখাপড়ায় উৎসাহ যোগানো, কারও অনুষ্ঠানে ছবি তুলে সেগুলোর প্রিন্ট দেয়া, ভিডিও করা সব কাজ পারেন মাহফুজা৷ শুধু তিনি নন, তার মতো ৬৫ জন তথ্যকল্যাণীর কাজই হচ্ছে এগুলো৷
প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করেন বলে তাদের প্রত্যেকের রয়েছে সাইকেল, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, ডায়াবেটিস ও প্রেসার মাপার যন্ত্র, গর্ভবতীদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার মতো মৌলিক সরঞ্জাম ইত্যাদি৷
তথ্যকল্যাণী, শিক্ষক ডটকমসহ বিজয়ী যারা
ডয়চে ভেলের সেরা অনলাইন অ্যাক্টিভিজম অ্যাওয়ার্ড দ্য বব্স-এর ২০১৩ সালের বিজয়ীদের নিয়ে বিশেষ ছবিঘর এটি৷ এই আসরে বাংলাদেশের তথ্যকল্যাণী প্রকল্প জিতেছে ‘জুরি অ্যাওয়ার্ড’, শিক্ষক ডট কম পেয়েছে ‘ইউজার প্রাইজ’৷
ছবি: D.net/Amirul Rajiv
সেরা ব্লগ: লি চেনপেং
চীনা লেখক ও সাংবাদিক লি চেনপেং সেরা ব্লগ পুরস্কার জিতে নিলেন৷ ‘গোটা বিশ্ব জানে’ নামের একটি বই লিখে চীনা কর্তৃপক্ষের রোষের মুখে পড়েছেন তিনি৷ বইয়ের প্রচারের সময় মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল তাঁকে৷ প্রতিবাদে তিনি নিজের লেখা থেকে অংশবিশেষ পাঠের সময়ে পরে নিলেন একটি অক্সিজেন মুখোশ৷ ‘নীরব পাঠ’-এর সেই অনুষ্ঠানে তাঁর পরনে ছিল একটি টি-শার্ট, যাতে লেখা ‘আমি তোমাদের সবাইকে ভালোবাসি’৷
ছবি: Li Ruihe
সেরা উদ্ভাবন: ফ্রিওয়াইবো ডট কম
‘ফ্রিওয়াইবো ডট কম’ নামের মাইক্রোব্লগিং সাইট চীনের সরকারের সেন্সরশিপ প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা দিচ্ছে৷ এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে চীনের অন্যতম প্রধান সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ‘সিনাওইবো ডটকম’-এর সেন্সরমুক্ত সংস্করণে ঢুঁ মারা যায়৷ ফলে ব্যবহারকারীরা জানতে পারেন, কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিবেদন মুছে ফেলে৷
ছবি: freeweibo.com
সেরা উদ্ভাবন: শিক্ষক ডটকম
বাংলাভাষার পক্ষে শিক্ষক ডটকম এই বিভাগে ‘ইউজার প্রাইজ’ জয় করেছে৷ মূলত বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বাংলায় অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে শিক্ষক ডট কম৷ এই সাইটটি গড়ে তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ রাগিব হাসান৷ ডয়চে ভেলের প্রতিযোগিতা চলাকালে শিক্ষক ডটকমের পক্ষে ভোট পড়েছে ৫৬ শতাংশ৷
সেরা সোশ্যাল অ্যাক্টিভিজম: ৪৭৫
মরক্কোর তরুণ প্রজন্মের এক উদ্যোগের নাম ‘৪৭৫’৷ মরক্কোর আইনের ৪৭৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী কোনো ধর্ষক ধর্ষিতাকে বিয়ে করলেই শাস্তি এড়াতে পারে৷ এই ধারার কারণে ২০১২ সালে ১৬ বছরের কিশোরী আমিনা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল৷ সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ‘৪৭৫’ নামের একটি চলচ্চিত্র এবং ফেসবুক ও ফ্লিকার-এ সোশ্যাল মিডিয়া অভিযান৷
ছবি: Naji Tbel
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স: ফাবি কুয়াসি
প্রতি বছরের মতো এবারও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এমন এক প্রতিযোগীকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যিনি বা যাঁরা মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন৷ এ বছর সেই পুরস্কার পাচ্ছেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ টোগো-র মানবাধিকার কর্মী ফাবি কুয়াসি৷ দেশের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় পুলিশ সাংবাদিকদের উপর যে নিপীড়ন চালাচ্ছে, ফাবি সেই সব ঘটনা তুলে ধরছেন তাঁর ওয়েবসাইটে৷
ছবি: fabbikouassi.wordpress.com
গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম পুরস্কার: তথ্যকল্যাণী
২০১৩ সালে ডয়চে ভেলে আয়োজিত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের বিষয় হলো ‘বৈশ্বিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ’৷ বব্স প্রতিযোগিতায়ও বিষয়টিকে আলাদা বিভাগের মর্যাদা দিচ্ছে৷ বাংলাদেশের ‘তথ্যকল্যাণী’ প্রকল্প এবার এই বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে নিয়েছে৷ জুরিমণ্ডলীর কাছে এটা এমন এক ‘বৈপ্লবিক প্রকল্প যার মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বাংলাদেশের অতি দরিদ্র মানুষের নাগালে চলে আসছে৷’
ছবি: D.net/Amirul Rajiv
সবচেয়ে সৃজনশীল ও মৌলিক উদ্যোগ: আমি ও আমার ছায়া
ইন্টারনেটে আমাদের গতিবিধির চিহ্ন কতটা থেকে যায়? এই প্রশ্ন নিয়েই কাজ করছে ‘মি অ্যান্ড মাই শ্যাডো’ বা ‘আমি ও আমার ছায়া’৷ ইন্টারনেটে কীভাবে নিরাপদে বিচরণ করা যায় ও তা করতে কী কী জানতে হয়, খেলাচ্ছলে ব্রাউজারের সেটিং বদলানোর মতো সেই সব পথ বাতলে দিচ্ছে এই ওয়েবসাইট৷ এই উদ্যোগের পিছনে রয়েছে ‘ট্যাকটিক্যাল টেকনোলজি কালেক্টিভ’ নামের এক আন্তর্জাতিক সংগঠন৷
ছবি: myshadow.org
সেরা বাংলা ব্লগ: শৈলী
সেরা বাংলা ব্লগ বিভাগে ইউজার প্রাইজ জয় করেছে শৈলী ব্লগ৷ এই জয়ের পর ডয়চে ভেলেকে জানানো প্রতিক্রিয়ায় শৈলী ব্লগের কর্ণধার রিপন কুমার দে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘এটা শুধু আমি না, সকল শৈলার এবং শৈলীর পাঠকদের জন্য খুব আনন্দের খবর৷ শৈলার এবং পাঠকদের ভালোবাসা ছাড়া এই স্বীকৃতি কোনোভাবেই আসত না৷ তাই তাদের সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা৷ সকলের ভালোবাসা নিয়ে শৈলী আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে এটাই আমার প্রত্যাশা৷’’
ছবি: http://shoily.com/
বাংলা সেরা অনুসরণযোগ্য: সাইফ সামির
‘বাংলা: সেরা অনুসরণযোগ্য’ বিভাগে বিজয়ী সাইফ সামির৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরকার কর্তৃক লেখক-ব্লগার-সাংবাদিকদের ওপর যে দমন-নিপীড়ন চালানো হচ্ছে ডয়চে ভেলের মাধ্যমে আমি তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি৷ একজন লেখককে তাঁর ব্যক্তিগত মত প্রকাশের জন্য আটক করা হবে, রিমান্ডে নেয়া হবে – এটা কি ধরনের কথা?’’
ছবি: Twitter
9 ছবি1 | 9
গ্রামবাসীর কাছে মূল্যায়ন
একজন মানুষের কাছ থেকে কেউ যখন এতো ধরণের সেবা পায় তখন স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি গ্রামবাসীর ভাল ধারণা হয়ে যায়৷ যেমনটা ঘটেছে মাহফুজার ক্ষেত্রেও৷ তিনি বলেন, ‘‘শুরুর দিকে গ্রামের অনেকের কাছ থেকে বাধা আসলেও এখন অনেকেই তাদের সম্মান দেখায়, তার কাজে সহায়তা করে৷''
স্থানীয় সাংসদ অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বিও মাহফুজার কাজে উৎসাহ দেন বলে জানান তিনি৷ ‘‘এমপি যদি কখনো রাস্তায় আমাকে দেখেন তখন তিনি গাড়ি থামিয়ে আমাদের কাজের খোঁজখবর নেন৷''
তিনমাস আগে মাহফুজার ল্যাপটপে স্কাইপ ব্যবহার করে গ্রামবাসীরা ঢাকায় অবস্থান করা সাংসদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছে, বলে জানান তিনি৷
উদ্যোক্তা ডিনেট
তথ্যকল্যাণী প্রকল্পের উদ্ভাবক আসলে তথ্য প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠান ডিনেট৷ তারাই তথ্যকল্যাণীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এ কাজে নামিয়েছেন৷ সংস্থার উপ-পরিচালক মোশাররফ হোসেন জানালেন, ২০১৭ সালের মধ্যে তথ্যকল্যাণীর সংখ্যা বাড়িয়ে ১২,০০০ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷
বাংলাদেশের পাশাপাশি কঙ্গো, রুয়ান্ডা এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশেও এই প্রকল্পকে ছড়িয়ে দিতে চায় ডিনেট৷ এই লক্ষ্যে এখন কাজ চলছে বলেও জানালেন মোশাররফ হোসেন৷