জার্মানি এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এ কথা উল্লেখ করে জার্মানির চ্যান্সেলর দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সব দলমতের প্রতি সহনশীলতা না থাকলে সমাজে চিড় ধরতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেলের নববর্ষ উপলক্ষ্যে দেয়া ভাষণটি রোববার টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়৷ সেখানে তিনি বলেন যে, বহুদিন ধরেই রাজনীতিতে মতাদর্শিক দূরত্ব বাড়ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব সমাজের ওপরও পড়ছে বলে অনেকের বিশ্বাস৷ ‘‘ভিন্ন মতের মানুষদের প্রতি সহনশীল হতে হবে৷'' বলেন ম্যার্কেল৷ তাঁর মতে সহনশীলতার অর্থ, ‘‘অন্যদের প্রতি মনোযোগী হওয়া, তাঁদের কথা শোনা এবং বোঝার চেষ্টা করা'’৷
অসন্তোষ ও বিভ্রান্তি
গেল ২৪ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের পর থেকে নতুন কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে গিয়ে রীতিমত গলদঘর্ম হতে হচ্ছে ৬৩ বছর বয়সি ম্যার্কেলকে৷ যদিও তাঁর দল ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও এর ব্যাভারিয়ান সহযোগী ক্রিস্টিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন সে নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পায়৷
যেভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করেন ম্যার্কেল
এমনকি ২০১৭ সালের নির্বাচনের আগেও তাঁর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো রাজনীতিবিদদের নিষ্ক্রিয় বা পাশে সরিয়ে দিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ নিজের দল বা বিরোধী দলের অনেক নেতাকেই নানাভাবে ঠেকিয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/ANP/R. De Waal
‘কোল গার্ল’ যখন গুরুকে ছাড়লেন
দীর্ঘদিন চ্যান্সেলর পদে থাকে হেলমুট কোল ম্যার্কেলকে মন্ত্রিসভায় প্রথম সুযোগ দিয়েছেন এবং তাঁর উত্থানে সহায়তা করেছিলেন৷ কিন্তু ১৯৯৮ সালে চ্যান্সেলর পদ হারানোর পর ম্যার্কেল এবং সিডিইউ তাঁর বিপক্ষে চলে যায়৷ কোল কিছু সূত্র থেকে নগদ অর্থ সাহায্য নিয়েছিলেন৷ কিন্তু সে সব সূত্রের বিস্তারিত তিনি জানাননি যা দলের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছিলেন সেসময় সিডিইউ’র সাধারণ সম্পাদক আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Altwein
গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার – রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি
২০০৫ সালের নির্বাচনে এসপিডি’র চ্যান্সেলর শ্র্যোডারকে পরাস্ত করেন ম্যার্কেল৷ তবে এই পরাজয়ে শ্র্যোডারের নিজের দাম্ভিকতাও কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল৷ সেই নির্বাচনে খুব অল্প ব্যবধানে সিডিইউ’র কাছে হেরে যায় এসপিডি৷ যদিও নির্বাচনের আগে টিভি বিতর্কে তিনি দাবি করেছিলেন, যে জার্মানরা চায় তিনি ক্ষমতায় থাকুন৷ কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি এবং তিনি রাজনীতি থেকে বিদায় নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার - দীর্ঘদিনের সঙ্গী
শুরুতে ম্যার্কেলের অধীনে চারবছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার৷ এরপর ২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেন সামাজিক গণতন্ত্রীদের এই রাজনীতিবিদ৷ কিন্তু সেই নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেনি স্টাইনমায়ারের দল৷ পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আবারো ম্যার্কেলের অধীনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন স্টাইনমায়ার৷ আর চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে তিনি জার্মানির প্রেসিডেন্ট৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Kembowski
গ্যুন্টার ও্যটিঙার - পথের কাঁটা দূর হলো
ম্যার্কেল যে শুধু তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেন এমন নয়৷ বরং নিজের দলে থাকা সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের লোভনীয় অন্য কোন পদেও পাঠিয়ে দেন৷ তাঁর সহকর্মী বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গ্যুন্টার ও্যটিঙারকে ২০১০ সালে তিনি ইউরোপীয় কমিশনে বড় পদে পাঠিয়ে দেন৷ অথচ ও্যটিঙারের সেই পদ পাওয়ার মতো কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Seeger
রোনাল্ড কখ - বাতিলের তালিকায় ফেলে দেয়া
দুই কারণে রোনাল্ড কখ পরিচিত৷ প্রথমত, তিনি দলাই লামার বন্ধু৷ দ্বিতীয়ত, সরকারের দ্বৈত নাগরিকত্ব চালুর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য৷ হেসে রাজ্যের এই রাজ্য প্রধান কখনো ম্যার্কেলের উত্থানে বাধা না হলেও হঠাৎ করেই মনে করেছিলেন তাঁকে বার্লিনে বড় পদের জন্য ডাকা হবে৷ কিন্তু ম্যার্কেলকে তাঁকে সেরকম কোন সুযোগ দেননি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্রিস্টিয়ান ভুল্ফ - একজন দুর্ভাগা রাষ্ট্রপতি
ক্রিস্টিয়ান ভুল্ফ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ম্যার্কেলের প্রথম পছন্দ ছিলেন না৷ কিন্তু ২০১০ সালে হর্স্ট ক্যোলার পদত্যাগ করার পর সিডিইউ বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় ভুল্ফ সুযোগ পেয়ে যান৷ ভুল্ফ তখন লোয়ার স্যাক্সনি রাজ্যের রাজ্যপ্রধান৷ পরবর্তীতে অবশ্য দুর্নীতির দায়ে প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়তে হয় তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পেয়ার স্টাইনব্রুক – সঠিক মানুষ, ভুল সময়
২০১৩ সালে ম্যার্কেল যখন তাঁর ক্যারিয়ারের তুঙ্গে, তখন এসপিডি থেকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বেছে নেয়া হয় পেয়ার স্টাইনব্রুক’কে৷ ম্যার্কেলের অধীনে একসময় অর্থমন্ত্রী থাকা এই রাজনীতিবিদের চ্যান্সেলর পদ পাওয়ার সব যোগ্যতাই ছিল৷ কিন্তু সময়টা ঠিক ছিল না৷ ম্যার্কেলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সুবিধা করতে পারেননি তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
সর্বোচ্চ ভোট পেলেও আগের যে কোনোবারের চেয়ে বাজে ফল করে দল দু'টি৷ সেই সুযোগে প্রথমবারের মতো অতি-ডানপন্থি দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) সংসদে ঢোকার সুযোগ পায়৷ রক্ষণশীল সংসদ সদস্য ও বক্তারা এর জন্য ম্যার্কেলের সাম্প্রতিক উদারনীতিকে দায়ী করেন৷ তাঁরা মনে করেন, সে কারণেই গেল চার বছরে ভোটাররা অতি-ডানদের দিকে ঝুঁকেছেন৷
‘বিশ্ব অপেক্ষা করবে না'
যে গ্যাঁড়াকলে আটকে আছে সরকার গঠনের প্রক্রিয়া, তা থেকে অচিরেই বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ম্যার্কেল৷ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ব অপেক্ষা করবে না৷'' তিনি মনে করেন, এভাবে চলতে থাকলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে৷
জানুয়ারিতে গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের জন্য আবারো আলোচনায় বসবে সিডিইউ-সিএসইউ এবং মধ্যবামপন্থি দল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এসপিডি)৷
গেল নভেম্বরে সিডিইউ-সিএসইউ-এর সঙ্গে ব্যবসা বান্ধব ফ্রি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও গ্রিন পার্টির মধ্যকার আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি৷ এরপরই নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্তে আসে সিডিইউ-সিএসইউ ও এসপিডি৷ তবে এ আলোচনা কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে৷
ইউরোপই ভরসা
নতুন কাজের সুযোগ তৈরি, শিক্ষার মানোন্নয়ন, আঞ্চলিক বৈষম্য কমানো, উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো এবং আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে জার্মানির অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপরও জোর দেন ম্যার্কেল৷
ম্যার্কেল মনে করেন, জার্মানির ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ তাঁর মতে, ২৭ দেশের এই জোট এর সীমান্ত নিরাপদ রাখতে একসাথে কাজ করতে হবে, অন্তত আরো কয়েক বছর৷
নিজ বক্তব্যে ‘ভবিষ্যতের জন্য ইউরোপকে তৈরি করা'-র ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁর মূলমন্ত্রে আস্থা রাখলেন ম্যার্কেল৷