পাঁচ বছরেও সাগর-রুনি হত্যা মামলার কোনো কুলকিনারা হয়নি৷ তদন্ত কর্মকর্তা জানালেন, হত্যাকাণ্ডকে রহস্যাবৃত করে রেখেছে অনেকগুলো প্রশ্ন৷ উত্তর খোঁজা হচ্ছে৷ উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তদন্ত চলবে৷
বিজ্ঞাপন
সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, র্যাবের এএসপি মহিউদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘মামলাটির অনেক দিক আছে ৷ পাঁচ বছর হয়েছে সত্য, তবে আমরা বসে নেই৷ আমরা অপরাধীদের চিহ্নিত করার ব্যাপারে আশাবাদী৷ আর সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে তবে তদন্ত শেষ হবে৷’’
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোর রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজারবাগের বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি৷ হত্যাতান্ডের সময় বাসায় ছিল তাঁদের একমাত্র শিশু সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ৷ ঘটনার পরপরই তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেন৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪৮ ঘন্টা সময়সীমা পার হওয়ার পর ১৩ ফেব্রুয়ারি তখনকার আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘‘এ জোড়া হত্যাকান্ডের তদন্তের ‘প্রনিধানযোগ্য’ অগ্রগতি হয়েছে৷’’ কয়েকদিন পর ২৬ ফেব্রুয়ারি তখনকার ডিসি ডিবি ও ডিএমপি’র মুখপাত্র এবং বর্তমানে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়েছেন৷ দ্রুততম সময়ে আসামীদের গ্রেপ্তার করে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন৷ কিন্তু ৪৮ ঘন্টাতো দূরের কথা, পাঁচ বছরেও এই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই৷
বিচার পাওয়ার আশা যেন দুরাশা
‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ বাংলাদেশে এখন একটি অতি উচ্চারিত শব্দযুগল৷ বিচার হচ্ছে না কিংবা বিচারের অপেক্ষায় আছে এমন কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: dapd
ব্লগার হত্যা
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এরপর একে একে হত্যার শিকার হন ব্লগার নীলাদ্রী নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের কোনোটির বিচারে ‘উল্লেখযোগ্য’ অগ্রগতি না হওয়ায় সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান৷
ছবি: Privat
সাংবাদিক দম্পতি হত্যা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়৷ গত চার বছরে এই মামলার তদন্ত থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ হয়ে র্যাব-এর হাতে পৌঁছেছে৷ গত মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রত্যেক হত্যাকাণ্ড তদন্তের মাধ্যমে তার বিচার করতে পেরেছি৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড অন্য কথা৷ ওটা এখানে না আসাই ভালো৷’’
ছবি: DW
ধর্ষণের বিচার
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৬৬০ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ অথচ কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
ত্বকী হত্যা
নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ হত্যা করা হয়৷ হত্যার দুদিন পর শীতলক্ষ্যার একটি খালে তার লাশ পাওয়া যায়৷ রাষ্ট্রের অনিহা থাকায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার থমকে আছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেন রফিউর রহমান রাব্বি৷ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাংসদ শামীম ওসমানের পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Facebook/Taqi.Mancha
তনু হত্যা
চলতি বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়ার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ উঠেছিল৷ দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি উঠেছিল৷ কিন্তু এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷ তবে তদন্তকাজ চলছে৷
ছবি: Twitter
শিল্প কারখানায় দুর্ঘটনা
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারশ’র বেশি মানুষের প্রাণ যায়৷ এর মধ্যে বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক ছিল৷ তিন বছরেরও বেশি সময় পর গত জুলাইতে এই ঘটনায় করা হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়৷ ঢাকার এক অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ বছরে উল্লেখ্যযোগ্য শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮টি৷ এর কোনোটিরই বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি৷ প্রতিবেদনটি পড়তে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নীচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ ঘটনার দিনই তাঁর ভাই গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন৷ এই অভিনেতা খুন হওয়ার পর চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও এখনও মামলার বিচার শুরু করা যায়নি৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: bdnews24.com
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন৷ এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা – দু’টিই হবিগঞ্জে দায়ের হলেও পরে সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়৷
ছবি: Facebook/Justice-for-Shah-AMS-Kibria
হতাশ রামুর ক্ষতিগ্রস্তরা
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালিয়ে ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক৷ ঐ ঘটনার চার বছর পরও মামলা গতিশীল না হওয়ায় হাতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা৷ পিপি মমতাজ আহমদ সম্প্রতি বলেন, এই হামলার ঘটনায় দায়ের করা ১৯টি মামলায় ইতোমধ্যেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: AFP/Getty Images
নারী নির্যাতনের মামলা ৫,০০৩টি, রায় ৮২০টির
২০১৫ সালে প্রকাশিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ বলছে, গত নয় বছরে দেশের নয়টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২,৩৮৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নেন৷ এই ঘটনাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে এ সব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫,০০৩টি৷ রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের৷ শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার ০.৪৫ শতাংশ৷
ছবি: dapd
10 ছবি1 | 10
ঘটনার পর সন্দেহভাজন হিসেবে বাসার দারোয়ানসহ কয়েকজনকে করা হয়েছিল৷ সেই পর্যন্তই৷ আদালতের নির্দেশে এখন র্যাব মামলাটি তদন্ত করছে৷
এ নিয়ে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের সঙ্গে শুক্রবার সারাদিন যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি৷ তাঁর সেল ফোন সচল থাকলেও কেউ ধরেনি৷ বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও ফোনে পাওয়া যায়নি৷ তবে তিনি বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে সাংবাকিদের বলেছেন, ‘‘এই মামলার তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে আমার কিছু জানা নাই৷’’
গত ৮ ফেব্রয়ারি ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে এই মামলার তদন্ত অগ্রগাত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু র্যাব প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হয়েছে৷ তাই আদালত তদন্ত কর্মকর্তাকে ২১ মার্চ আদালতে তলব করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে৷ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে র্যাব এ পর্যন্ত ৪৬ বার সময় নিল৷
তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি মহিউদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘আমরা ২১ মার্চ তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি৷ আদালতের আদেশ পাওয়ার পর সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছি৷ আশা করি, এবার প্রতিবেদন দিতে পারব৷’’
তদন্তে আদৌ কোনো অগ্রগতি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘অগ্রগতি আছে৷ এই হত্যাকাণ্ডটির নানা দিক আছে৷ আমরা সব দিক যাচাই-বাছাই করে দেখছি৷ আমরা আশাবাদী যে অবশ্যই অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারব৷’’
সুনির্দিষ্টভাবে কোনো অপরাধী চিহ্নিত করা গেছে কিনা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘অনেক দিক, অনেক বিষয় দেখতে হচ্ছে৷ আমরা আশাবাদী৷ আমরা চিহ্নিত করতে পারব৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ডিএনএ টেস্টের তথ্য ধরেও আমরা কাজ করছি৷ সেখান থেকেও আমরা মামলার তদন্ত সহায়ক তথ্য পাচ্ছি৷ মামলার তদন্তে সাগর-রুনির পরিবারের সদসরাও সহায়তা বরছেন৷’’
আশা করি, এবার প্রতিবেদন দিতে পারব: তদন্ত কর্মকর্তা
তদন্ত কবে শেষ হতে পারে?
তদন্ত কর্মকর্তা জানার, ‘‘অনেক প্রশ্ন আছে৷ সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে তদন্ত শেষ হবে৷ অনেক ছায়া আছে সেগুলো তো আমাদের ক্লিয়ার করতে হবে৷ অনেক পয়েন্ট আছে৷ নতুন নতুন ইস্যু আসছে সেগুলোও পরিস্কার করতে হচ্ছে৷’’
এর আগে রুনির ভাই, মামলার বাদি নওশের রোমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তদন্ত কর্মকর্তা এখন আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না৷ ফলে মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতি সম্পর্কে আমরা জানিনা৷ আমরা আশাহত৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, তাঁর কাছে তদন্তের অগ্রগতির কোনো খবর নাই৷ তাই আমার মনে হচ্ছে, মামলাটির এখন আর তদন্ত হচ্ছে না৷’’
সাগরের মা সালেহা মনিরও ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘আমি এখনো আশাবাদী যে সরকার চাইলে আমার সন্তানের খুনিরা ধরা পড়বে৷আমি আমার সন্তানের খুনিদের দেখতে চাই৷’’