1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সব ব্যর্থতা মুছে দিতে পারে ভালো নির্বাচন

শহীদুল ইসলাম ঢাকা
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় দায়িত্ব নিয়ে প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা পূরণে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

সাড়ে চার মাস পার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সময়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। কমেনি জিনিসপত্রের দাম। জনপ্রশাসনে বিরাজ করছে অস্থিরতা। সংস্কার কার্যক্রমেও গতি নেই। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়া তৈরি হলেও নির্বাচন ইস্যুতে ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সপ্তাহ গড়াতে না গড়াতেই ১৭ আগস্ট উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর কয়েক ধাপে উপদেষ্টা পরিষদের আকার বাড়িয়ে উপদেষ্টাদের দপ্তরে রদবদল করা হয়।

অন্যদিকে সরকার গঠনের পর গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদগুলোতে নিয়োগ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায় সরকার। বেশ কয়েকটি পদে নিয়োগ দিয়ে সেগুলো বাতিল করা হয়। আগের সরকারের সময় চুক্তিভিত্তিক বেশিরভাগ নিয়োগ বাতিল করে সরকার চালাতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পথেই হাঁটে সরকার। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের অবসর থেকে ফিরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে।

উদ্যোগগুলো এখনো চোখে পড়ার মতো না: কাজী মোহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান

This browser does not support the audio element.

অনেক আগে অবসরে যাওয়া ১৭ জন কর্মকর্তাকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলাতে চুক্তিতে সচিব পদে বসানো হয়েছে। এছাড়া তিন ধাপে পদোন্নতি দিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছে। এমন অতিরিক্ত সচিবদের অনেকেই এখন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ উইংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার দাবি, চুক্তিতে নিয়োজিত সচিব এবং তিন ধাপে পদোন্নতির পর অতিরিক্ত সচিব হওয়া কর্মকর্তাদের নিয়মিত কর্মকর্তারা ভালোভাবে নেননি। ফলে তারা মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না।

অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে চার মাসে প্রশাসনে একের পর এক বিষয় নিয়ে বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। সবশেষ উপসচিব পুলের কোটা নিয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের বক্তব্যের প্রতিবাদে ক্যাডার কর্মকর্তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। গত সাড়ে চার মাসে নিজেদের পদোন্নতি, পদায়নসহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা। ফলে নিয়মিত কাজ ছাড়া নীতিনির্ধারণী বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে পারছে না প্রশাসন। গত সাড়ে চার মাসে ৫৩৭ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে আর্থিক সুবিধা দেবে সরকার।

জনপ্রশাসনে অস্থিরতার বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রশাসনে এই অস্থিরতা সাময়িক। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এখনো তাদের প্রতিবেদনের কাজ সম্পন্ন করেনি। প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে দাখিলের পর অন্তর্বর্তী সরকার সেটি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। এরপর আসবে সংস্কার বাস্তবায়নের পর্যায়। প্রশাসনিক সংস্কারের সঙ্গে অন্যান্য খাতের সংস্কারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমার ধারণা এই প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক সংস্কার একটি বাস্তবসম্মত রূপ লাভ করবে। মনে রাখতে হবে যে, সংস্কারের মূল লক্ষ্য হলো অধিকতর জনকল্যাণ এবং নাগরিকসেবার মান বৃদ্ধি।’’

আমলাদের মতো পুলিশ প্রধান এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ প্রধানের পদেও চুক্তিতে দুইজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পুলিশে এ নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলছে না। ঢাকার ৯৫ শতাংশ পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হলেও বাহিনীর মনোবল এখনো ফেরেনি। গুম কমিশনের সুপারিশের আলোকে র‌্যাব বিলুপ্ত করা নিয়েও সরকার সিদ্ধার্থহীনতায় রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। গত ৫ আগস্ট থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে শুধু ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন সাতজন। ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় গত ১ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৪ জন ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে থানায় মামলা করেছেন। অন্যান্য অপরাধের হারও সারা দেশে বেড়েছে।

জাতীয় নির্বাচনের চূড়ান্ত রূপরেখা না ঘোষণার কারণ হিসেবে সরকার সংস্কার প্রক্রিয়াকে সামনে এনেছে সরকার। এখন পর্যন্ত ১৪টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। তবে এসব কমিশন তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারকে প্রতিবেদন দিতে পারবে না বলে কমিশন সূত্রগুলো জানিয়েছে। ছয়টি কমিশনকে চলতি বছরের মধ্যে সরকারকে সুপারিশ দেওয়ার কথা।

কোনো সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় গত সাড়ে চার মাসে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেনি সরকার। সংস্কার কমিশনগুলো সুপারিশের আলোকে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত্যে না পৌঁছালে পুরো সংস্কার প্রক্রিয়া ঝুলে যেতে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। তারা বলছেন, সংস্কার প্রক্রিয়া থেমে গেলে নির্বাচনের ইস্যু আরো জোরালো হবে।

মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সবচেয়ে দুর্বল সরকার বলে মনে করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন। গত বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, সংস্কারের নামে তারা যদি বছরের পর বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চান, সেটা বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করবে না। কারণ হচ্ছে, ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বলতম সরকার হচ্ছে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার।

‘‘একটা দুর্বল সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। সেজন্য দরকার জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি নির্বাচিত সরকার। ২০২৫ সালের মধ্যেই সম্ভাব্য সমস্ত সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে নির্বাচন দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।’’

 সরকার ‘এখন পর্যন্ত পাস করার মতো নম্বর পায়নি’

অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে চার মাসের কাজের মূল্যায়ন করে এই সরকারকে ফেল মার্কস দিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকারের তো কোনো সময়সীমা নেই। আমি মনে করি অন্তত নূন্যতম সংস্কার করে একটি গ্রহণযোগ্য, গুণগতমানসম্পন্ন নির্বাচন তারা করবে। তবে সরকারের নির্বাচন উপযোগী মেকানিজম তৈরি করার কাজে খুব একটা অগ্রগতি দেখছি না। পুলিশ প্রশাসন এখন পর্যন্ত জনবান্ধব তো নয়ই, তারা এখনো মুখ ফিরিয়ে রাখার মতো অবস্থায় আছে।’’

মান্না বলেন, ‘‘অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে খুব বড় কিছু করেছেন সেটি বলবো না। প্রধান উপদেষ্টা যখন বাইরে গেলেন, অনেক বন্ধুরাষ্ট্র ১০ বিলিয়ন পর্যন্ত কমিটমেন্ট করেছে। ৫ বিলিয়ন ঋণ দেবে বলে শুনেছি। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হয়নি, দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, নতুন বিনিয়োগ আসেনি৷ ফলে নতুন কর্মসংস্থানও হয়নি। সমাজে বিভাজন কমানোর চেষ্টা সরকার করেনি, রাজনৈতিকভাবে ও সাংস্কৃতিভাবেও সেই চেষ্টা করা হয়নি। তবে সব ভালো, যার শেষ ভালো। সরকার শেষ পর্যন্ত যদি একটি ভালো নির্বাচন করতে পারে, তখন ১০০ নম্বরের মধ্যে পুরোটাই দিতে পারি, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাস করার মতো নম্বর পাননি তারা।’’

নির্বাচন উপযোগী মেকানিজম তৈরি করার কাজে খুব একটা অগ্রগতি দেখছি না: মাহমুদুর রহমান মান্না

This browser does not support the audio element.

অন্তর্বর্তী সরকার গত সাড়ে চার মাসে প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠলেও মানুষের আকাঙ্খা পূরণে প্রত্যাশিত অবস্থানে যেতে পারেনি বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘‘প্রচণ্ড বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণহীনতা ছিল। ওই অবস্থা কাটিয়ে ওঠা চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। তবে মানুষের অনেক প্রত্যাশা ছিল, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার এবং গত ১৫ বছর যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা- এই জায়গাগুলো প্রত্যাশিত অবস্থানে পৌঁছায়নি। উদ্যোগগুলো এখনো চোখে পড়ার মতো না।’’

মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘‘নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব আছে, আবার সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়াও দেখতে পেয়েছি। বিশেষ করে ভারতকেন্দ্রিক ইস্যুতে। নির্বাচনকেন্দ্রিক ইস্যু আলোচনার মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে পারবে। অনেকগুলো সংস্কার কমিশন হলেও নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, জনপ্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলের সংস্কারকে প্রাধান্য দিতে হবে। এসবের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর যত দ্রুত করতে পারবে, দেশের জন্য তত মঙ্গল। সরকারের ভোটের প্রক্রিয়ার মধ্যে এগিয়ে যাওয়া উচিত।’’ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ