এক ‘অপরাধীকে’ বাড়ি গিয়ে ধরে আনা হলো, অন্যজনকে নিরাপদে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করলো পুলিশ৷ বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের জন্যও কি গরিবের ঘরে জন্ম নেয়াই সবচেয়ে বড় অপরাধ?
বিজ্ঞাপন
জানি, অনেকেরই খুব ‘ফিল্মি’ মনে হবে প্রশ্নটা৷ কিন্তু কিছু বিষয় তো অধিকাংশ মূলধারার গতানুগতিক বাণিজ্যিক ছবির কাহিনীর মতোই সোজা৷ এমন বিষয় ঘুরিয়ে বা গুরুগম্ভীর করে বলার কোনো মানেই হয়না৷ শিশুর প্রতি পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণ দেখে তা-ই সোজাসরল প্রশ্নটাই প্রথমে এলো- পুলিশের কাছে কি শিশুদের বেলায়ও ধনী-গরীব আলাদা? ‘অদম্য বাংলাদেশ’-এর চার তরুণ জামিনে মুক্ত হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আরেকটি ঘটনা৷গুলশানে প্রাইভেটকারে চাপা দিয়ে কয়েকজনকে আহত করল ১৬ বছর বয়সি এক কিশোর৷ নাম ফারিজ রহমান৷ বলা হচ্ছে, ছেলেটি আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ এইচবিএম ইকবালের ভাতিজা৷ মানুষকে গাড়িচাপা দিয়ে আহত করার পরও পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি, উল্টো দুর্ঘটনাস্থল থেকে তাঁকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে সহায়তা করেছে৷ এক পুলিশ কর্মকর্তা ফারিজকে মোটরবাইকে তুলে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে৷ ছেলেটির বিরুদ্ধে কেন কোনো মামলা হলো না? পুলিশ বলেছে, আহতদের কেউ মামলা করেনি, তাই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি৷ এমনকি হাইকোর্ট ফারিজ রহমান ও গাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে ১৪ দিনের মধ্যে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিলেও শুক্রবার সকাল পর্যন্ত পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
ফারিজ হঠাৎ ঘটনাটি ঘটিয়েছে৷ কিন্তু ঢাকার এজিবি কলোনিতে তার বয়সি কিছু ছেলে কয়েক মাস ধরেই মোটবাইক নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে চলেছে৷ প্রভাবশালী পরিবারের এই ‘বখাটে’ সন্তানদের বখাটেপনায় ইতিমধ্যে এক নারী মারাও গেছেন৷ নিহতের স্বামী মামলা করেছেন৷ তারপর থেকে হুমকির মুখে আছেন তিনি৷ স্থানীয়রা একজনকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছিল৷ একই মোটরবাইকের বাকি দুজনকে পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করেনি৷
ফারিজ রহমান ও এজিবি কলোনির ছেলেগুলোর ভাগ্য আপাতত ভালো৷ অপরাধ করেও তাই এখনো তারা মুক্ত৷ তবে আইনের আওতায় এনে ওদের ভুল শুধরে নেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে না এনে পুলিশ বা ছেলেগুলোর পরিবার ওদের ক্ষতিই করছে৷ প্রশ্রয় ওদের আরো বেপরোয়া করলে সমাজ হয়তো ভবিষ্যতে আরো কয়েকজন বড় অপরাধীই পাবে৷ কোনো সুস্থ, সচেতন অভিভাবক কখনো তা চাইতে পারেন বলে আমার মনে হয়না৷ কিন্তু পরিবার এবং পুলিশের প্রচ্ছন্ন সমর্থন কচি কচি ছেলেগুলোকে কি সেদিকেই এগিয়ে দিচ্ছে না?
শিশুদের নিয়ে মন খারাপ করা কিছু খবর
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকলকে শিশু বলে গণ্য করা হয়৷ শিশুদের নিয়ে ছবিঘরে থাকছে এমন কিছু তথ্য, যা পড়ে আপনার মন খারাপ হতে বাধ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সাত মাসে ৬১ গণধর্ষণ
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ২৬৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ এর হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৬১টি শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য জানায় ফোরামটি৷ একই সময়ে ধর্ষণ, উত্ত্যক্তসহ যৌন সহিংসতার শিকার হয় ৩৪৭টি শিশু৷ এর মধ্যে চারটি ছেলেশিশুও রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বয়স ১৫ হওয়ার আগেই বিয়ে
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে ২৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের বয়স ১৫ পার হওয়ার আগে৷ আর ৬৫ শতাংশের বিয়ে হয় বয়স ১৮ পার হওয়ার আগে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশুর বাস খোদ ঢাকা শহরে৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
কিশোর অপরাধী
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর কমপক্ষে দুই হাজার শিশুকে নানা অপরাধে আটক করা হয়৷ শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৭৬ জন শিশুকে অস্ত্র ও মাদক বহনসহ নানা অভিযোগে আটক করা হয়৷
ছবি: bilderbox
মাত্র তিনটি
আইন অনুযায়ী শিশু-কিশোর অপরাধীদের বিচার করা হয় কিশোর আদালতে৷ এরপর বিচার শেষে শাস্তি ভোগের জন্য তাদের শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর কথা৷ কিন্তু বাংলাদেশে এমন কেন্দ্র আছে মাত্র তিনটি৷ গাজীপুরে দু’টি এবং যশোরে একটি৷ এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য৷ সব মিলিয়ে এই তিনটির ধারণ ক্ষমতা ৬০০৷ অর্থাৎ আটক শিশুদের বড় একটি অংশের জায়গা উন্নয়ন কেন্দ্রে হয় না৷ ফলে তাদের কারাগারে থাকতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
5 ছবি1 | 5
ক্যামেরার চোখে বাংলাদেশে শিশু শ্রম
বাংলাদেশে ৪৫ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ তাদের মধ্যে ১৭ লাখের বেশি আবার কাজ করে রাজধানী ঢাকায়৷ আমাদের আলোকচিত্রী মুস্তাফিজ মামুন শিশুশ্রমের কিছু চিত্র তুলে এনেছেন আপনাদের জন্য৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বেলুন কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের একটি বেলুন তৈরির কারখানায় কাজ করছে দশ বছরের এক শিশু৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, যার প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক খোদ রাজধানীতেই৷
ছবি: Mustafiz Mamun
নেই কোনো নজরদারি
কামরাঙ্গীর চরের এই বেলুন কারখানায় খোলামেলাভাবে নানা ধরনের রাসায়নিকের মাঝে কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সিংহভাগই শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে কমপক্ষে দশটি বেলুন তৈরির কারখানা আছে, যেগুলোর সিংহভাগেই শিশু শ্রমিক কাজ করে৷ সড়ক থেকে একটু আড়ালে ভেতরের দিকেই কাজ করানো হয় শিশুদের৷ সপ্তাহে সাত দিনই সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয় তাদের৷ তবে শুক্রবারে আধাবেলা ছুটি মেলে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
ঢাকার কেরাণীগঞ্জে সিলভারের তৈজসপত্র তৈরির কারখানায় কাজ করে শিশু শ্রমিক আলী হোসেন৷ মারাত্মক উচ্চ শব্দের মধ্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় তাকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ট্যানারি কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার হাজারীবাগের একটি ট্যানারি কারখানায় বাইরে কাজ করে নোয়াখালীর আসিফ৷ বয়স মাত্র বারো৷ রাসায়নিক মিশ্রিত চামড়া শুকানোর কাজ করে সে৷ দিনে ১২ ঘণ্টারও বেশি কাজ করে সামান্য যে মজুরি পায় তা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সাহায্য করে আসিফ৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মায়ের সঙ্গে রাব্বি
কামরাঙ্গীর চরের একটি প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে মায়ের সঙ্গে কাজ করে চাঁদপুরের রাব্বি৷ এই কেন্দ্রের মালিক নাকি শিশু শ্রমিক নিয়োগের বিরোধী৷ মায়ের অনুরোধে রাব্বিকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁর৷ কারণ রাব্বির মা সারাদিন খেটে যে মজুরি পান তাতে সংসার চলে না৷ সংসার চালাতে তাই কাজ করতে হচ্ছে রাব্বিকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
হিউম্যান হলারে শিশু হেল্পার
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী হিউম্যান হলারগুলোতে শিশু শ্রমিক চোখে পড়ার মতো৷ বাহনগুলো দরজায় ঝুলে ঝুলে কাজ করতে হয় এ সব শিশুদের৷ চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকারও হয় এসব শিশুরা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্রিক ফিল্ডে শিশুরা
ঢাকার আমিন বাজারের বিভিন্ন ব্রিক ফিল্ডেও কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ প্রতি হাজার ইট বহন করে পারিশ্রমিক পায় ১০০-১২০ টাকা৷ একটি কাঁচা ইটের ওজন কমপক্ষে তিন কেজি৷ একেকটি শিশু ৬ থেকে ১৬টি ইট এক-একবারে মাথায় নিয়ে পৌঁছে দেয় কমপক্ষে ৫০০ গজ দূরে, ইট ভাটায়৷ তাদের কোনো কর্মঘণ্টাও ঠিক করা নেই৷ একটু বেশি উপার্জনের আশায় রাত পর্যন্ত কাজ করে তারা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেদ কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা
পুরনো ঢাকার লালবাগের একটি লেদ কারখানায় কাজ করে ১১ বছরের শিশু রহিম৷ সারাদিন লোহা কাটা, ভারি যন্ত্রপাতি মেরামত, হাতুরি পেটানোসহ নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে সে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
9 ছবি1 | 9
বাংলাদেশের সব সরকারের মতো পুলিশও অতীত থেকে খুব একটা শিক্ষা নেয়না৷ কয়েকদিন আগেই তো হবিগঞ্জের এক কিশোরকে ধরে এনে গাজীপুরের সংশোধন কেন্দ্রে রাখল পুলিশ৷ সেই ঘটনা ভুলে গিয়ে ফারাজকে মোটরবাইকে তুলে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এলো? হবিগঞ্জের রুহুল আমিনের অপরাধ ফারিজের চেয়ে ‘ছোট’ ছিলনা৷ এক কিশোরীকে রাস্তায় নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করেছিল সে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় শুরুর পর আত্মীয়ের বাড়ি থেকে রুহুল আমিনকে আটক করে পুলিশ ৷ তারপর থেকে টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রই রুহুল আমিনের ঠিকানা৷
ফারিজ আর এজিবি কলোনির ওই ‘বখাটে’ ছেলেগুলোকে অবিলম্বে আইনের আওতায় নেয়া হোক৷ রুহুল আমিনের মতো ওদেরও সংশোধন দরকার৷ গ্রামের অখ্যাত দরিদ্র পরিবারের সন্তান বলে রুহুল আমিনের ‘শাস্তি’ হবে আর সরকারি দলের সাবেক সাংসদের ভাতিজা কিংবা সমাজের প্রভাবশালীদের বখাটে সন্তান বলে অন্যরা সাধারণের জীবন নিয়ে খেলবে? জনগণের প্রতি, অভিযুক্ত শিশু-কিশোরদের প্রতি এত বড় অন্যায় অন্যায় পুলিশ করবে কেন? পুলিশ ‘জনগণের বন্ধু’ কিনা এ নিয়ে সংশয় আছে৷ কিন্তু সব শিশুর বন্ধু কিনা এ সংশয়ও স্থায়ী হয়ে গেলে তো মুশকিল৷ ধনী-গরীব, সাদা-কালো তফাতের ঊর্ধ্বে উঠে সব শিশুর ‘বন্ধু’ তো হতেই পারে পুলিশ!