দুই সমকামী অ্যাক্টিভিস্টসহ ব্লগার, লেখক, প্রকাশক হত্যার দায় নেয়া জঙ্গি গোষ্ঠী আনসার আল-ইসলামকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার৷ মুসলিম প্রধান দেশটিতে গত কয়েকবছরে বেশ কয়েকজন মুক্তমনা ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্ট খুন হন৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রবিবার একসংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করে৷ এতে বলা হয়, জঙ্গি গোষ্ঠীটটি জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে৷ আনসার আল-ইসলাম এর আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম হিসেবেও কার্যক্রম পরিচালনা করেছে৷ এটি আল-কায়দার ভারত উপমহাদেশীয় অংশের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করে কাজ করতো৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘‘আনসার আল-ইসলামের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে৷ গোষ্ঠীটির সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে কেননা এগুলো জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ৷''
গতবছর ঢাকায় নিজের অ্যাপার্টমেন্টে খুন হন সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট জুলহাস মান্নান৷ এসময় তাঁর সঙ্গে থাকা আরেক অ্যাক্টভিস্টকেও খুন করে দুর্বৃত্তরা৷ আনসার আল-ইসলাম হত্যাকাণ্ড দু'টির দায় স্বীকার করেছিল৷ জিহাদিদের অনলাইন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা মার্কিন প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এর আগে দুই বাংলাদেশি ব্লগার নিলয় নীল এবং নাজিমউদ্দিন সামাদ হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছিল আনসার আল-ইসলাম৷
জার্মানি প্রবাসী ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন মনে করেন, ‘‘আনসার আল-ইসলামের মতো জঙ্গি সংগঠন হচ্ছে দেশের প্রচলিত মৌলবাদ বান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফলাফল৷ সেটা রোগ নয়, রোগের লক্ষণ মাত্র৷ রোগ নির্ণয় এবং সেই অনুসারে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যত খুবই ভয়াবহ৷''
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ব্লগারদের উপর বিভিন্ন হামলায় মাদ্রাসা এবং সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জড়িত থাকার কথা বলছে গোয়েন্দারা৷ এই নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মহলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
অভিযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে
২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বা এনএসইউ-এর পাঁচ ছাত্র৷ তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়৷ এরা সকলেই ছিল আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মগজ ধোলাই
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের ভুলিয়েভালিয়ে দলে নিচ্ছে জঙ্গিরা, এমন ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরা তাই জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের জন্য আগামীতে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করার কথাও ভাবছেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আছে বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট-এর ছাত্র মোহাম্মদ নুরউদ্দনি এবং আবু বারাকাত মোহাম্মদ রফকিুল হাসান হাসানকে বুয়েট থেকে বহিষ্কার করে পুলিশে দেয়া হয় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
হিযবুত তাহরীরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের প্রধান মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয়ের আইবিএ-র শিক্ষক ছিলেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও রয়েছে
কওমি মাদ্রাসাগুলোকে জঙ্গিবাদের কারখানা বলা হতে একসময়৷ সেই বাস্তবতা মুছে যায়নি৷ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটক দু’জন নিজেদের মাদ্রাসার শিক্ষার্থী দাবি করেছেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
সতর্ক পুলিশ
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এবং জঙ্গি বিষয়ক বিশেষ সেলের সদস্য সানোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের একাংশ এখন জঙ্গি তৎপরতার দিকে ঝুঁকছে৷ আর যারা অপারেশনে অংশ নিচ্ছে, তারাও বয়সে তরুণ এবং ছাত্র৷''
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
6 ছবি1 | 6
২০১৩ সালে ঢাকায় উগ্রপন্থিদের হামলায় গুরুতর আহত এই মুক্তমনা ব্লগার পরবর্তীতে নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য হন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘অতীতে আমরা জেএমবি দেখেছি, হরকাতুল জিহাদ, বাঙলাভাই ইত্যাদি সবই দেখেছি৷ এগুলো থামানো যাবে না৷ একটার পরে আরেকটা নাম পালটে চেহারা পালটে শূন্যতা পূরণ করবে৷ সরকার স্বল্পমেয়াদি সমাধানে বেশি আগ্রহী, যার ফলাফল খারাপই হবে৷''
জার্মানি প্রবাসী আরেক ব্লগার অর্ণব গোস্বামী মনে বলেন, ‘‘ওলামা লীগ, হেফাজতের মতো দলগুলোর ‘দাবির' প্রতি যতদিন সরকার ‘শ্রদ্ধাশীল' থাকবে, ততদিন চলবে ব্লগার, লেখক বা প্রগতিশীলদের ওপর আক্রমণ৷ হার্ডলাইন এই সংগঠনগুলো নাস্তিক এবং মুক্তমনাদের ফাঁসি চাইছে৷ মতপ্রকাশ কেনো ফাঁসির উপযুক্ত শাস্তি হবে সে নিয়ে সরকার পাল্টা আর্গুমেন্ট করেনি৷ সরকার যদি আদৌ ব্লগার, মুক্তমনা হত্যা বন্ধ করতে চায় তবে প্রথমে বন্ধ করতে হবে মতপ্রকাশকে ক্রিমিনালাইজ করা৷''
উল্লেখ্য, এর আগে আরো ছয়টি জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছিল বাংলাদেশ সরকার৷ এগুলো হচ্ছে: জামিয়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকাতুল-জেহাদ আল-ইসলামি বাংলাদেশ (হুজি-বি), হিজবুত তাহরীর এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)৷
বিশ্বের ভয়ংকর পাঁচ জঙ্গি সংগঠন
তথাকথিত জঙ্গিদের কারণে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷ অনেকেরই ধারণা তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস-ই সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি গোষ্ঠী৷ কিন্তু বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচি বা গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স কিন্তু বলছে ভিন্ন কথা৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Lieman
বোকো হারাম
ইসলামিক স্টেট বা আইএস নয়, বিশ্বের ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠনগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে নাইজেরিয়ার বোকো হারাম৷ ২০১৫ সালে আবু বকর শেকাউ-এর নেতৃত্বে এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি ৬ হাজার ৬৪৪ জন মানুষকে হত্যা করেছে৷ তাদের হামলায় আহত হয়েছে ১,৭৪২ জন৷ বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক৷ এছাড়া হাজারো কিশোরীকে অপহরণ করেছে বোকো হারাম৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S.Alamba
ইসলামিক স্টেট
যদিও বোকো হারাম আইএস-এর তুলনায় বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, কিন্তু আতঙ্ক সৃষ্টির দিক থেকে সবচেয়ে উপরে আছে আইএস৷ বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলা হচ্ছে আইএসকে৷ ২০১৫ সালে তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৬ হাজার ৭৩ জন মানুষ এবং আহত হয় ৫ হাজার ৭৯৯ জন৷ ১০৭১টি হামলা চালিয়েছে তারা বিশ্ব জুড়ে৷ আবু বকর আল-বাগদাদির নেতৃত্বে সংগঠনটি সিরিয়া, ইরাক, তুরস্ক ও ইউরোপ জুড়ে এখনো হামলা চালিয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তালেবান
১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলার সময় এই জঙ্গি সংগঠনটির আবির্ভাব৷ বিশ্বের সবচেয়ে অভিজ্ঞ জঙ্গি সংগঠন বলা হয় এদের৷ ২০১৫ সালে তালেবানের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৩ হাজার ৪৭৭ জন এবং আহত হয়েছে ৩ হাজার ৩১০ জন৷ গত বছর বিশ্ব জুড়ে ৮৯১ টি হামলা চালিয়েছে তারা৷ হিবাতুল্লাহ আকন্দজাদা এখন তালেবানের নেতৃত্বে রয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Noorullah Shirzada
ফুলানি জঙ্গি গোষ্ঠী
বিশ্বব্যাপী এদের তেমন পরিচিতি নেই৷ এরা নাইজেরিয়ার ফুলা সম্প্রদায়ের মানুষ৷ এদের লক্ষ্য ফুলানির ভূমি মালিকদের হত্যা করা৷ ২০১৫ সালে ১৫০ টি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে ফুলানি, তাদের হামলায় মারা গেছে ১ হাজার ২২৯ জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Lieman
আল-শাবাব
বোকো হারামকে যদি আইএস-এর সাথে তুলনা করা হয়, তবে আল শাবাবকে তুলনা করা যায় আল-কায়েদার সঙ্গে৷ পূর্ব আফ্রিকায় এদের আধিপত্য অনেক বেশি৷ সোমালিয়াকে ইসলামিক রাষ্ট্র বানানোই তাদের মূল লক্ষ্য৷ গত বছর জঙ্গি গোষ্ঠীটি ৪৯৬টি হামলা চালিয়েছে, হত্যা করেছে ১ হাজার ২১ জন মানুষকে, আহত হয়েছে ৮৫০ জন৷