নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করে বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে শাসক দল৷ এমন মন্তব্য বিশ্লেষকদের৷ তবে এতে সংকটের সমাধান হবে না৷ তাঁদের কথায়, প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না৷
বিজ্ঞাপন
নির্বাচনকালীন সরকারকে সর্বদলীয় সরকার বলা হলেও, একে তা বলতে নারাজ সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার৷ তিনি ডয়চে ভেলেক বলেন, প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া এটাকে কিভাবে সর্বদলীয় সরকার বলা যায়৷ তাঁর ভাষায়, নতুন মন্ত্রীদের নেয়া হলেও এটা এখনো মহাজোট সরকার৷
তবে এই সর্বদলীয় সরকার গঠন বিএনপিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে৷ তাই সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সঙ্গে দেখা করবেন৷ সেখানে বিএনপি নতুন কোনে প্রস্তাব দেবে, না আগের নির্দলীয় সরকারের অবস্থানে অটল থাকবে – তা স্পষ্ট নয়৷ বিএনপির কোনো নেতা এ নিয়ে মুখও খুলছেন না৷ তবে গত কয়েকদিনে বিএনপির একটি পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়৷ আর তা হলো, ঢাকা সফররত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের সঙ্গে বিরোধী দলীয় নেত্রীর বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতার নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে৷ বলা হয়েছে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের কথা৷ সেখানে নির্দলীয় সরকারের কথা গুরুত্ব পায়নি৷
এদিকে বঙ্গভবনে শপথ নেয়ার পর নতুন মন্ত্রীরা অনেকটা খোলাখুলিভাবেই বলেছেন যে, বিএনপি না এলেও নির্বাচন হবে৷ তবে তাঁরা চেষ্টা করবেন বিএনপি যাতে নির্বাচনে আসে, আসে সর্বদলীয় সরকারে৷
এই পরিস্থিতিতে বিএনপি আন্দোলন আরো জোরদার করবে না রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করবে – তা স্পষ্ট হতে খুব বেশি সময় লাগবে না৷ যদিও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিজভী বলেছেন, তারা কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করবেন৷ প্রতিহত করবেন একদলীয় নির্বাচন৷ তবে এরশাদের জাতীয় পার্টি ডিগবাজি খাওয়ায় পুরো হিসাব আর আগের মতো নেই৷ সর্বদলীয় সরকারে এরশাদের মন্ত্রী পাঁচজন৷ জিএম কাদেরও থাকবেন বলে জানা গেছে৷ তাই সর্বদলীয় সরকারেই এখন নানা হিসাব৷ বিরোধী দলে বসার সুযোগটি এরশাদ হাতছাড়া করতে নাও চাইতে পারেন৷ সুতরাং, বিএনপিকে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত যেতে হবে৷ বিএনপি যে অনড় আছে, তাও নয়৷ তারা এখন নির্দলীয় সরকার নীতিগতভাবে মেনে নেয়ার শর্ত ছাড়াই আলোচনা করতে চায়৷
গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি৷ সর্বদলীয় সরকারে বিরোধী দল থাকতে হবে৷ তাঁর মতে, এখন পর্যন্ত যা অবস্থা তাতে নির্বাচন নয়, নির্বাচনের নামে নাটকের প্রস্তুতি চলছে৷ কিন্তু দেশের মানুষ সত্যিকার অর্থে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়৷
মঙ্গলবার নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে৷ দপ্তরও বণ্টন হবে৷ একথা জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসাইন ভূঁইঞা৷ তিনি জানিয়েছেন, আরো একটি সিদ্ধান্ত হবে৷ তবে সেটা কি তা তিনি প্রকাশ করেননি৷ জানা গেছে, বিএনপির জন্য শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে, যদি তারা নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় যোগ দেন৷
মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ঢাকা সফরের শেষ দিনে সোমবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলার কিছুক্ষণ আগেই আটজন মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী শপথ নেন৷ সেই প্রসঙ্গ টেনেই তিনি বলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি৷ তিনি বলেন যে নির্বাচন এ দেশের মানুষ গ্রহণ করবে না, তা সারা বিশ্বেও গ্রহণযোগ্য হবে না৷ তাই রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সংলাপের তাগিদ দেন তিনি৷ বলেন, মহাসচিব পর্যায়ে দ্রুত সংলাপ শুরুর কথা৷ তিনি সমঝোতার নির্বাচনের কথা বলেন৷
একইরকম কথা বললেন ড. বদিউল আলম মজুমদার ৷ তিনি বলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা এবং সব দলের অংশগ্রহণ দরকার৷ আর এ জন্য দেরি হয়ে গেলেও এখনই আলোচনা শুরু প্রয়োজন৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷