বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দলের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের প্রথম দিনে দেশের চারটি জেলায় সহিংসতায় চারজন নিহত হয়েছেন৷ ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে সারাদেশে৷ ওদিকে বিরোধী দল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাহার করতে বলেছে৷
বিজ্ঞাপন
বিরোধী দলের রাজপথ, নৌপথ এবং রেলপথ অবরোধের প্রথম দিন, মঙ্গলবার, সাতক্ষীরায় যুবলীগ নেতা মাহমুদ হাসান বাবু নিহত হন পিকেটারদের লাঠিপেটায়৷ তিনি মটর সাইকেল করে যাওয়ার সময় পিকেটাররা তাঁকে লাঠিপেটা করলে তিনি নিহত হন৷
কুমিল্লার লাকসামে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে বাচ্চু মিয়া নামে একজন রিকশা চালক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন৷ এছাড়া, সিরাজগঞ্জে বিএনপির সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে লোকমান হোসেন নামে এক পথচারী নিহত হয়েছেন বলে প্রকাশ৷ জানা গেছে, টিয়ার শেল তাঁর বুকে আঘাত করলে তিনি নিহত হন৷ এদিকে বিকেলে বগুড়ায় বিএনপি এবং পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে অজ্ঞাত পরিচয় আরো একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷
এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ এবং নাশকতার ঘটনা ঘটেছে৷ তবে সবচেয়ে বেশি নাশকতার শিকার হয়েছে রেল যোগাযোগ৷ রেলগাড়িতে আগুন দেয়া ছাড়াও, দেশের বিভিন্ন স্থানে রেললাইন উপড়ে ফেলার খবর পাওয়া গেছে৷ হামলা করা হয়েছে বিভিন্ন রেল স্টেশনে৷ ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, লালমনিরহাট ও গাজিপুরে এ ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ৷ শধু তাই নয়, বগুড়া, ফেনী এবং চুয়াডাঙ্গার উপজেলা নির্বাচন অফিসে আগুন দেয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে৷
বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রহুল কবির রিজভী অবরোধ সফল হয়েছে বলে দাবি করেছেন৷ তিনি আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন৷ নয়ত কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে তফসিল প্রত্যাহারে বাধ্য করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি৷ তিনি বলেন, কোনোভাবেই একতরফা নির্বাচন হতে দেয়া হবে না৷ নির্বাচন হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে৷
ওদিকে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য তোফায়েল আহেমেদ বলেছেন, আন্দোলনের নামে নাশকতা করে নির্বাচন বন্ধ করা যাবে না৷ তিনি বলেন, এখনো সময় আছে৷ তাই চাইলে, বিরোধী দল এখনও নাশকতা ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে৷ তবে নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন তিনি৷
অন্যদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ বলেছেন, পরিস্থিতি বিবেচনা করে নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্বাচনের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হতে পারে৷ তিনি আবারো সব দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, রজনৈতিক সমঝোতা হলে নির্বাচনের তফসিল পুনর্নির্ধারণ করা হতে পারে৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷