সামাজিক দূরত্ব নেই অনলাইনভিত্তিক সমাজমাধ্যমে৷ অন্তর্জালে কাছে আসছে মানুষ৷ কথা বলছে, তর্ক করছে৷ চলছে কুতর্ক আর কটূক্তিও৷ কখনো প্রতিবাদ হচ্ছে৷ কখনো হচ্ছে না৷ কিন্তু কেন?
বিজ্ঞাপন
করোনাকালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের নানান ঘাটতি সামনে চলে এসেছে৷ যা নিয়ে তুমুল সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে৷ এমনি এক সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আগের মেয়াদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রয়াত হলে তাকে নিয়েও কিছু কথা হয়৷ কেউ কেউ করে বসেন কটূক্তি৷ এমন লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠে নামতে হয় প্রশাসনকেও৷ সেই সময়ে কটূক্তির প্রতিবাদে আমজনতার ঝড় সেভাবে দেখা যায়নি অন্তর্জালে৷ যেটা পরে দেখা গেছে জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের সন্তানের বেলায়৷ সেখানে সাকিব-কন্যাকে কটূক্তিকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেটে পড়েছে লাখো মানুষ৷
সব দূষিত কথার সমান প্রতিবাদ হয় না কেন? এই প্রবণতার পেছনে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে বলে মনে করেন বাংলায় ব্লগ ও সোশ্যাল মিডিয়ার শুরুর দিকের ব্যবহারকারী মাহবুব মোর্শেদ৷ এই কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগকে বলেন, ‘‘প্রতিক্রিয়া সবসময় পলিটিক্যাল৷ মানে মানুষ নিজে পক্ষ অবলম্বন করে৷ যে নিজে যাকে ঠিক মনে করে সেটার পক্ষে সে দাঁড়ায়৷ যেটাকে সে ঠিক মনে করে না তার বিপক্ষে সে দাঁড়ায়৷’’
প্রতিক্রিয়া সবসময় পলিটিক্যাল: মাহবুব মোর্শেদ
তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাজে মন্তব্য বা কটূক্তি আগের চেয়ে কমেছে বলে দাবি করেন ব্লগার ও একটিভিস্ট মাহবুব মোর্শেদ৷ ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগকে তার ভাষ্য হচ্ছে- ‘‘আমরা যখন সোশ্যাল মিডিয়া বা ব্লগের ব্যবহার শুরু করি তখন বাজে মন্তব্য, গালাগালি, কটূক্তি- এই প্রবণতাগুলো অনেক বেশি ছিলো৷ এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় এই মন্তব্যগুলো বন্ধ করার উপায় ইউজারের হাতে আছে৷ তিনি চাইলে যে কাউকে ব্লক করতে পারেন৷ যে কারো কমেন্ট মুছে দিতে পারেন৷’’
মন্তব্য বন্ধ করা বা ব্লক করার কারণে মতপ্রকাশের জায়গা সীমিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয় কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘যিনি কটূক্তি করছেন, বাজে মন্তব্য করছেন৷ তিনি তো আসলে আপনার যে সামাজিক উপস্থিতি সেই উপস্থিতিটাকেই ক্ষুন্ন করতে চাচ্ছেন, ক্ষতিগ্রস্থ করতে চাচ্ছেন৷ ফলে তাকে আপনি যদি ব্লক না করেন, তার মন্তব্যটা মুছে না দেন৷ তাহলে এই বিষয়টা আপনাকে, আপনার উপস্থিতিকে, আপনার পোস্টকে নানাভাবে ক্ষতির মুখে ফেলতে থাকবে৷’’
সমাজমাধ্যমে প্রতিক্রিয়ার পেছনে রাজনৈতিক কারণ থাকে৷ আবার নারী-প্রগতির বিরুদ্ধতাও বড় একটি বিষয়৷ সম্প্রতি যশোরের একজন নারী নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মোটরসাইকেল চালিয়ে যোগ দেন৷ এই ছবি ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ এটা নারী অগ্রগতির অংশ হিসেবে একটি মহলের প্রশংসা পেয়েছে৷ কিন্তু নিন্দায় মেতে উঠেছে তারও বেশি মানুষ৷ এই অংশই আবার ভিন্ন একটি ঘটনার প্রশংসা করেছে৷ অভিমানী একজন রিকশাচালক নিজেই যাত্রীর আসনে বসে আছেন৷ একজন নারী সেই রিকশাচালক স্বামীর পা ধরে মান ভাঙাতে চাইছেন৷ ঘটনা রাস্তার হলেও এই ছবিখানি সমাজমাধ্যমে দেয়ায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সীমানা অতিক্রম করছে কিনা- সেই প্রশ্নও থেকে যায়৷
প্রস্তুত হওয়ার আগেই সোশ্যাল মিডিয়া চলে এসেছে: সাদাত হোসাইন
ভার্চুয়াল পাটাতনে জনপ্রিয় হতেও যা ইচ্ছে বলা বা ছবি দেয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে৷ এমনটা হতে পারে বলে মনে করেন এই সময়ে বাংলাদেশে ফেসবুকের জনপ্রিয় মুখ সাদাত হোসাইন৷ ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের মাধ্যমে এই লেখক ও নির্মাতার সতর্কবাণী হচ্ছে- ‘‘যারা সোশ্যাল মিডিয়াতে ইয়ুথ আইকন বা যাদেরকে মানুষ ফলো করে তাদের আরও বেশি সংযত হওয়া উচিত৷ তাদের কোনো মন্তব্য মাস পিপলকে আহত করতে পারে৷ আমার কাছে মনে হয় দুটির তরফ থেকেই রেসপন্সসেবল হওয়া উচিত৷ সেটি হচ্ছে যে, আমরা যাদের আইকন বলছি, তাদের যেমন সেন্সসেবল আচরণ করাটা জরুরি৷ একই সাথে যারা তাদের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল হচ্ছে তাদেরও অনেক বেশি সেন্সেবল আচরণ করা জরুরি৷’’
অনলাইনভিত্তিক সমাজমাধ্যমে বাজে মন্তব্য শুধু শিক্ষাবঞ্চিত শ্রেণি করছে এমন নয়, শিক্ষিত শ্রেণিও করছে৷ তাই বাজে কথা বলা কিংবা কটূক্তি করার জন্য এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে অপ্রস্তুত পরিস্থিতির দায় আছে বলে মনে করেন সমকালে বাংলাদেশের অন্যতম বেস্টসেলার লেখক সাদাত হোসাইন৷ ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগকে তিনি বলেন, ‘‘প্রস্তুত হওয়ার আগেই সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের হাতের মধ্যে চলে এসেছে৷ প্রস্তুতি বলতে আমি বলছি- আমরা কোথায়-কখন-কোন কথাটা বলব, কীভাবে বলব- সে বিষয়টায় আমাদের কিন্তু একটা প্রাথমিক সেন্সিবিলিটি থাকা দরকার৷ ধরেন আপনার কোনো একটা ছবি আমার পছন্দ হচ্ছে না৷ আমি ধরে নিলাম সেই ছবিটা আমার পছন্দ হচ্ছে না৷ সেইটা বলার অধিকার আমার আছে৷ কিন্তু সেই যে আমার অপছন্দ হচ্ছে, সেই অপছন্দের একটা ধরণ থাকা উচিত৷ যে ধরণটা হচ্ছে অন্যকে আহত করবে না৷ কিন্তু তাদের মধ্যে এই পরিমিতবোধ বা পরমতসহিষ্ণুতার জায়গা একদমই নেই৷’’
সাইবার বুলিং ও আত্মহত্যা
অনলাইনে হয়রানি বা সাইবার বুলিংয়ের কারণে অনেকেই হতাশায় ভোগেন৷ এদের একটি অংশ হতাশা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷
জাপানের ২২ বছর বয়সি হানা কিমুরা একজন পেশাদার কুস্তিগীর ছিলেন৷ এছাড়া নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় রিয়েলিটি টিভি শো ‘টেরাস হাউস’-এ অভিনয় করেছেন তিনি৷ এ বছরের ২৩ মে আত্মহত্যা করেন কিমুরা৷ অনলাইনে টেরাস হাউসের দর্শকদের ক্রমাগত সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় আত্মহত্যা করার আগে বেশ কয়েকটি টুইট করেছিলেন তিনি৷ কিমুরার টুইটগুলোতে আত্মহত্যার আভাস ছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Pizzoli
সল্লি
দক্ষিণ কোরিয়ার ২৫ বছর বয়সি সল্লি একজন অভিনেত্রী, গায়িকা ও মডেল ছিলেন৷ মেয়েদের বিখ্যাত কে-পপ ব্যান্ড ‘এফ (এক্স)’-এর সাবেক সদস্য ছিলেন তিনি৷ তবে তার আরেক পরিচয় তিনি ‘নো-ব্রা’ আন্দোলনের একজন সমর্থক ছিলেন৷ অর্থাৎ, মেয়েদের বক্ষবন্ধনী না পরার পক্ষে ছিলেন সল্লি৷ এ কারণে তাকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে৷ এসবের কারণে হতাশায় ভুগে গতবছর অক্টোবরে আত্মহত্যা করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/Yonhap
খু হারা
দক্ষিণ কোরিয়ার কে-পপ ব্যান্ড ‘খারা’র সদস্য খু হারা গতবছর নভেম্বরে আত্মহত্যা করেন৷ তিনিও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন৷ তার সাবেক প্রেমিক বিনা অনুমতিতে ধারণ করা তাদের যৌন মিলনের ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিলে মামলা করেছিলেন খু হারা৷ এরপর ঐ ভিডিও প্রকাশিত হলে অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তিনি৷ ভালো বন্ধু সল্লির মাসখানেক পর আত্মহত্যা করেন খু হারা৷
ছবি: picture-alliance/YONHAPNEWS AGENCY
অ্যামান্ডা টড
ক্যানাডার ১৫ বছর বয়সি টড সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে ২০১২ সালে আত্মহত্যা করে৷ তার আগে ইউটিউবে সে একটি ভিডিও পোস্ট করে৷ অ্যামান্ডা জানায়, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভিডিও চ্যাট করতে গিয়ে একজনে সঙ্গে তার পরিচয় হয়৷ একসময় সে তাকে তার খোলা বুক দেখাতে রাজি করায়৷ এরপর সেই ছবি বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়৷ পরে তা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশও করা হয়৷ এই ঘটনায় অ্যামান্ডাকে কয়েকবার স্কুল বদল করতে হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রুকাইয়া রূপা
পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার স্কুল শিক্ষার্থী রূপা (১৬) গত বছর আগস্টে আত্মহত্যা করে৷ পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রের উল্লেখ করে প্রথম আলো জানায়, তামিম খান (১৮) নামে একজন রূপাকে তার সঙ্গে প্রেম না করলে আপত্তিকর ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়৷ রূপার বাবার দাবি, তার মেয়ের ছবি ফটোশপ করে তামিম বিভিন্নজনের কাছে ছড়িয়েছে৷ তাই তার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে৷
ছবি: Klicksafe/M. Kusch
অ্যামি ‘ডলি’ এভারেট
১৫ বছরের অস্ট্রেলীয় এই শিক্ষার্থী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করে৷ এরপর অস্ট্রেলিয়ায় সাইবার বুলিং নিয়ে আলোচনা শুরু হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Akubra Hats
১০ বছরের মারিয়ান
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার মেসা শহরের দশ বছর বয়সি মারিয়ান হার্নান্দেজ রোখাস সম্প্রতি আত্মহত্যা করেছে৷ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে সে এ কাজ করেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় দৈনিক ‘দ্য অ্যারিজোনা রিপাবলিক’ জানিয়েছে৷ মোবাইলে তাকে নানারকম বার্তা পাঠিয়ে হয়রানি করা হতো বলে জানিয়েছে রোখাসের বন্ধুরা৷
ছবি: picture-alliance/empics/P. Byrne
প্যারিস জ্যাকসন
মাইকেল জ্যাকসনের মেয়ে প্যারিস জ্যাকসন তার চেহারা নিয়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন৷ সে কারণে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন বলে ২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘বাকস্বাধীনতার বিষয়টি ভালো৷ কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের জাতির জনকেরা যখন সংশোধনী (সংবিধানে) রচনা করছিলেন তখন সামাজিক মাধ্যমের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেননি৷’’
ছবি: Getty Images/N. Barnard
বিজয়লক্ষ্মী
তামিল অভিনেত্রী বিজয়লক্ষ্মী সম্প্রতি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন৷ তামিল নায়ক কাম রাজনীতিবিদ সীমানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনেছিলেন তিনি৷ তার অভিযোগ, সীমান তাকে বিয়ের অঙ্গীকার করেছিলেন৷ আত্মহত্যার জন্য বিপি ট্যাবলেট খেয়েছেন জানিয়ে ২৬ জুলাই রাতে ফেসবুকে ভিডিও প্রকাশ করেন বিজয়লক্ষ্মী৷ তিনি অভিযোগ করেন, সীমানের দলের লোকেরা কয়েকমাস ধরে অনলাইনে তাকে হয়রানি করেছে৷ সেজন্য তিনি প্রচণ্ড চাপ অনুভব করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশ পরিস্থিতি
গতবছর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ইউনিসেফের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে ৩২ শতাংশ সাইবার হয়রানির মুখে পড়ছে৷ এদিকে, গতবছর সেপ্টেম্বরে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশুক চাকমা জানান, ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে৷