দক্ষিণ এশিয়ায় হিজড়া হয়ে জন্মগ্রহণ করা একটা অপরাধের মতো৷ কেবল হিজড়া হওয়ার কারণেই তাঁদেরকে সব হারাতে হয়, পরিবারও তাঁদের ত্যাগ করে৷ গৃহত্যাগী হয়ে কষ্টে কাটানো জীবনে তাঁরা স্বপ্ন দেখেন ফের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার৷
বিজ্ঞাপন
নয়া দিল্লির মোনা আহমেদ সে রকম একটি সুযোগ পেয়েও ছিলেন৷ তবে কাঙ্ক্ষিত সেই জীবনে বেশি দিন থাকতে পারেননি৷ এ কারণে ফিরে আসেন নিজের পরিচিত দুনিয়ায়৷ ফিরে এসে ঘর হিসাবে বেছে নেন মেহদিয়ান এলাকার করবস্থানকে৷
এখানে মোনার প্রতিবেশীরা যৌনকর্মী, কবর খননকারী এবং ভিক্ষুক৷ তাঁদের জীবন জড়িয়ে আছে এই কবরের সঙ্গেই৷ তাঁরা কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকেন৷ ভেজা জামা-কাপড় শুকোতে দেয় বাইরের সমাধিস্তম্ভের বাইরের দিকে৷
কয়েক দশক ধরে মোনা এখানেই বাস করছেন৷
মোনার বন্ধু ও নারীবাদী লেখক উর্বশী বুটালিয়া বলেন, এক সময় মোনা এই অদ্ভূত এলাকাটি ছাড়তে চাইতেন৷ তাঁর ইচ্ছা ছিল, দিল্লীর কোনো একটি অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে বাস করবেন৷
প্রথমবারের মতো ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া গণনা
পাকিস্তানের আদমশুমারিতে প্রথমবারের মতো দেশের ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়াদের গণনা করা হচ্ছে৷ এমন কয়েকটি দেশের কথা এখানে থাকছে, যারা মাত্র কয়েক বছর আগে আদমশুমারিতে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়াদের অন্তর্ভুক্ত করেছে৷
ছবি: Imago/Dean Pictures
ইতিহাসে প্রথম
দীর্ঘ ১৯ বছর পর চলতি বছরের মার্চে পাকিস্তানে জাতীয় আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে৷ আর এ বছরই প্রথমবারের মতো সেখানে হিজড়াদের গণনা করা হবে৷ ৯ জানুয়ারি এক বৃহন্নলার আপিলের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের লাহোর হাইকোর্ট এ রায় দিয়েছেন৷ হাইকোর্ট পাকিস্তান সরকার এবং ন্যাশনাল ডাটাবেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষকে এই রায় কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন৷
ছবি: Imago/Dean Pictures
অধিকারের মামলা
ট্রান্সজেন্ডার ওয়াকার আলী গত বছরের নভেম্বরে আদালতে এই আবেদন পেশ করেন৷ যেখানে বলা হয়, পাকিস্তানের হিজড়া সম্প্রদায় তাদের সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত৷ তাই ৬ষ্ঠ আদমশুমারিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে হিজড়াদের অধিকার নিশ্চিত করার আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: Urooj Raza
সঠিক সংখ্যা কত?
পাকিস্তানে ট্রান্সজেন্ডারদের সংখ্যা কত সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই৷ অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ট্রান্স অ্যাকশনের জরিপ অনুযায়ী, ১৯ কোটি মানুষের দেশ পাকিস্তানে হিজড়াদের সংখ্যা ৫ লাখ৷ ২০১২ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ট্রান্সজেন্ডারদের দেশের নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার দেয়ার আদেশ দেন, সেখানে সম্পত্তিতেও সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Hassan
বিশ্বে প্রথম নেপাল
২০১১ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো কোনো একটি দেশে আদমশুমারিতে হিজড়াদের গণনা করা হয়, সে দেশটি নেপাল৷ প্রথমবারের মতো সেখানে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়াদের নিবন্ধিত করা হয়৷
ছবি: Getty Images/P. Mathema
ভারত
২০১১ সালেই ভারতেও আদমশুমারিতে হিজড়াদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে তা নেপালের পরে৷
ছবি: AP
জার্মানি
জার্মানি প্রথম ইউরোপীয় দেশ, যেখানে ২০১৩ সালে তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দেয়া হয়৷ কোনো শিশু যদি ট্রান্সজেন্ডার হয়, তবে বাবা-মা জন্ম সনদে তৃতীয় লিঙ্গ নির্বাচন করতে পারবেন৷
ছবি: Reuters
বাংলাদেশ
বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডও ২০১৩ সাল থেকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়াদের পাসপোর্টসহ আদমশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Monirul Alam
7 ছবি1 | 7
১৯৫৫ সালে পারিবারিক বাসা থেকে পালিয়েছিলেন মোনা৷ সমাজের মূল স্রোতের বাইরে এই এলাকায় বাস করতে থাকেন৷ ভারত তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিলে ২০১৪ সালে এদের মূল ধারায় ফেরার একটা সুযোগ তৈরি হয়৷
তবে ফ্ল্যাটে ফেরার পর এটাকে তার কাছে কারাগার মনে হতে থাকে৷ মানুষে গমগম করা স্থানে থাকতেন তিনি৷ সেখানে উৎসবে হিজরাদের ঐতিহ্যবাহী নাচ হতো৷ এ ছাড়ার তাঁর কাছে অনেকেই আসতো পরামর্শের জন্য৷
তবে এই জীবন ছাড়ার পর এককালের পরম আকাঙ্ক্ষিত স্বাভাবিক জীবন আর স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না৷ পূর্বের জীবনই হয়তো তার কাছে স্বাভাবিক জীবন৷ পরিবর্তিত জীবন তাঁর কাছে কোনো আবেদনই তৈরি করতে পারেনি৷ এখানে বরং একাকীত্বই তাঁর কাছে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়৷
হিজড়াদের যমপুরী
এশিয়া-প্যাসিফিক ট্র্যান্সজেন্ডার নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মী নারায়ণ ত্রিপাঠি'র মতো অধিকার কর্মীরা তৃতীয় লিঙ্গের নারীদেরকে আড়াল থেকে বের করতে শুরু করেন৷ সমাজে এই নারীদেরকে সব সময়ই সন্দেহের চোখে দেখা হতো৷
তবে তাঁদের একটা ইতিবাচক দিক রয়েছে৷ হিন্দু শাস্ত্রে হিজড়াদেরকে ভাগ্যের প্রতীক মনে করা হতো৷ এ কারণে বিয়ে বা জন্মক্ষণে তাঁদের আশীর্বাদ নেয়া হতো৷
তবে এটা তাঁদের জীবনে খুব কম ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পেরেছে৷ ভারতে ২০ লাখের মতো এমন মানুষ রয়েছে৷ তাঁদের অধিকাংশই গরিব পরিবার থেকে এসেছেন৷
যৌবনে মোনাও অন্য হিজড়াদের মতো একজন পুরুষ গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন৷ তিনি হিজড়াদের অন্তরালের জগতকে নিয়ন্ত্রণ করেন৷ এটা হিজড়াদের অন্য রকম পরিবার৷ সেখানে আধিপত্য চলে ওই গুরুর৷ সেখানে সদস্যদের উপর নানা বিধিনিষেধ থাকে৷ তাঁরা পুলিশসহ বাইরের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না৷
শিষ্যত্ব গ্রহণকারী হিজড়াদের বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে৷ নিজ নিজ এলাকায় তাঁরা মালী, বাসার কাজের লোক, দোকানদারদের নিয়ে একটা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করে৷ তাঁদের মাধ্যমে তাঁরা বিয়ে, শিশুর জন্ম, নতুন চাকুরি, নতুন বাড়িসহ যে কোনো উদযাপনের খবর সংগ্রহ করেন৷
বৃহন্নলাদের ‘অহংকার যাত্রা’
২০১৩ সালের নভেম্বরে তৃতীয় লিঙ্গে হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশের হিজড়ারা এবার ঢাকায় প্রথমবারের মতো ‘প্রাইড মার্চ’ করেছেন৷ এতে অন্তত এক হাজার হিজড়া অংশ নেন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
প্রাইড মার্চ
বাংলাদেশের হিজড়া সম্প্রদায় ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায় প্রথমবারের মতো ‘হিজড়া প্রাইড ডে’ উদযাপন করেন৷ স্বীকৃতি পাওয়ার পর হিজড়ারা এই প্রথম ‘প্রাইড মার্চ’ করলেন৷ এই সমাবেশে অন্তত এক হাজার হিজড়া অংশ নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Monirul Alam
স্বীকৃতির বর্ষপূর্তি
গত বছর ১০ নভেম্বরে বাংলাদেশের হিজড়ারা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে মন্ত্রিসভার স্বীকৃতি পায়৷ তার এক বছর পূর্তিতে এই সমাবেশের আয়োজন করেন তাঁরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Monirul Alam
আনন্দ-উচ্ছ্বাসে উদযাপন
জাতীয় পতাকা নিয়ে এই হিজড়ার উচ্ছ্বাস প্রমাণ করে বর্ষপূর্তির উৎসব উদযাপনে কতটা খুশি তিনি৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
অধিকার প্রাপ্তি
এই স্বীকৃতির ফলে তাদের অধিকার ফিরে পান হিজড়ারা৷ পান তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচয় দেয়ার অধিকার, সেই সাথে সব সরকারি নথিপত্র এবং পাসপোর্টে নিজেদের লিঙ্গ উল্লেখ করার অধিকার৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
মেহেদী উৎসব
বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে মেহেদী উৎসবের আয়োজন করেছিলেন হিজড়ারা৷ অনেককেই দেখা যায় মেহেদী উৎসবে যোগ দিতে৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
হিজড়াদের সংখ্যা
সাধারণ হিসেবে দেশে প্রায় ১০ হাজার হিজড়া রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷ কিন্তু হিজড়াদের নেতা আবুল হোসেন ডয়চে ভেলেকে গত বছর জানিয়েছিলেন, সারা দেশে তাঁদের সংখ্যা ৪০ হাজারের কম হবে না৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
বঞ্চনার কাহিনি
এর আগে লিঙ্গের স্বীকৃতি না থাকায় হিজড়ারা বেঁচে থাকার তাগিদেই কখনো পুরুষ আবার কখনো নারীর পরিচয় ধারণ করতেন৷ আর তাঁদের শুধু বঞ্চনা নয়, নির্যাতনেরও শিকার হতে হতো৷ এমনকি তাঁরা মারা গেলে তাদের জানাজা বা সত্কার নিয়েও হতো জটিলতা৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
7 ছবি1 | 7
খবর পাওয়ার পর তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, অর্থাৎ হিজড়ারা সেখানে গিয়ে টাকা আদায় করেন৷ বিয়ের জন্য নব দম্পত্তিকে ২০ হাজার রূপি দিতে হয়৷ নয়তো তাঁরা জনসম্মুখে নিজেদের জামা-কাপড় খুলে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেন৷ ব্যক্তি ও উপলক্ষ্যভেদে এই টাকা ১ লাখ রূপিও হতে পারে৷
আশীর্বাদের কাজটা হিজড়াদের উঁচু শ্রেণির লোকজনই করে থাকে৷ বাকিদের যৌনকর্মী, ভিক্ষুক হয়েই জীবন কাটাতে হয়৷
মেহদিয়ান এলাকার অধিবাসীরা আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ দখলদার৷ তাঁরা তাঁদের সম্পত্তির জন্য নামজারি করতে পারেন না৷ যদিও দশকের পর দশক ধরে বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে৷
আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ হলেও কর্তৃপক্ষ প্রতিরোধের ভয়ে এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করে না৷
মধ্য আশির দশকে মোনা এখানে একখণ্ড জমি নেন৷ সেখানেই এখন তাঁর একটি ঘর রয়েছে৷
তবে তাঁর ঘরের দরজা সব সময়ই খোলা থাকে৷ এমনকি ঘরে ডাকাতির পরও তিনি এই নিয়ম থেকে সরে আসেননি৷ যে কেউ চাইলেই যে কোনো সময় তাঁর ঘরে যেতে পারেন৷
বুটালিয়া বলেন, দরজা কখনো বন্ধ হয় না৷ দরজা ধাক্কা দিলেই ভেতরে ঢোকা যায়৷ তখন হয়তো তিনি নিজের বিছানায় ঘুমিয়ে আছেন৷ কিন্তু এরপরও যে কেউ ঘরে গিয়ে টিভি দেখতে পারে৷ এটা তাঁর কাছে একেবারেই স্বাভাবিক৷ যতদিন তিনি বেঁচে আছেন ততদিনই হয়তো এটা চলবে৷