1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সমান্তরাল বিনোদন সংস্কৃতির স্বরূপ সন্ধান

আরিফ জেবতিক
৭ আগস্ট ২০২০

সম্প্রতি লাইকি এর জনপ্রিয় চরিত্র অপু গ্রেফতার হওয়ার পর বিষয়টি মধ্যবিত্তের নজরে প্রথমবার এসেছে! অপুর ফলোয়ার এক মিলিয়ন! মানে দশ লাখ লোক অপুর কনটেন্ট লাইকিতে ফলো করেন৷

Instagram-Icon
ছবি: picture-alliance/xim

আমি নিশ্চিত, এই ঘটনার আগে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ অপুর নাম জানা তো দূরের কথা, লাইকি নামে যে একটি অ্যাপস আছে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত হয়তো সেটাই জানতেন না৷ সেই লাইকিতে লক্ষ লক্ষ লোক বিনোদন নিচ্ছেন, সেখানে সেলিব্রেটি তৈরি হচ্ছে, অথচ দেশের শিল্প সংস্কৃতির যে চলমান অভিভাকত্ব মধ্যবিত্ত শ্রেনী দখল করে রেখেছেন, তারা সেটার খোঁজই জানতেন না৷  টিকটক অ্যাপে মামুন নামে একজন আছেন, তার ফলোয়ারও এক মিলিয়ন৷ এরকম আরো অনেকেই আছেন৷

এই বিষয়টি খুবই অদ্ভুত৷ একটি দেশে দুটো শ্রেনী সমান্তরালভাবে বিনোদন নিয়ে যাচ্ছেন, যাদের একটি গোষ্ঠির সাথে আরেক গোষ্ঠির কোনো যোগাযোগ নেই- বিষয়টি ভাববার মতো৷ অপু- মামুন কিংবা লাইকি-টিকটক কোনো ব্যতিক্রম ঘটনা নয়; দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে একটি সমান্তরাল বিনোদন, সমান্তরাল সংস্কৃতি চর্চার যে ধারা সেটি নৃবিজ্ঞানীদের জন্য বিস্তর গবেষনার প্রয়োজন আছে৷

আজকের যে গায়িকা মমতাজকে আমরা চিনি, তিনি আমাদের মধ্যবিত্তের নজরে এসেছেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থানের সময়৷ মিডিয়া প্রথম যখন মমতাজকে নিয়ে সংবাদ প্রচার করে, ততদিন মমতাজের ৫০০ এর অধিক এ্যালবাম বেরিয়ে গেছে৷ প্রতিদিন তাঁর একটি করে এ্যালবাম প্রকাশিত হতো তখন৷ গড়ে প্রতিদিন একটি করে এ্যালবাম প্রকাশের ঘটনা থেকেই বুঝা যায় তিনি সেই সময় কী পরিমান চাহিদা সম্পন্ন শিল্পী৷ অথচ আপনি যদি নব্বই দশকের শেষের দিকের বাংলাদের বিনোদন জগত ঘেটে দেখবেন, তখন দেখবেন মমতাজের এই উথান ঘটেছে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর সম্পূর্ণ অগোচরে৷

আমার একটি ধারনা ছিল যে একেবারে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন টেলিভিশন চলে গেছে, ইন্টারনেট চলে গেছে, তখন বিনোদন ও সংস্কৃতির এই সমান্তরাল প্রবনতা দ্রুত মিলিয়ে যাবে৷ কিন্তু অপু-মামুন উপাখ্যান প্রমান করছে যে এই সমান্তরাল প্রবাহ বিন্দুমাত্র কমে নি৷

আচ্ছা, জাতীয় পর্যায়ের কথা বাদ দেই, শুধু আঞ্চলিকতাকে ঘিরেও পুরো ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা আছে৷ কয়েক বছর আগেও সিলেট শহরের কয়েকটি মার্কেট শুধু আঞ্চলিক নাটকের সিডি বিক্রির উপর দাঁড়িয়ে ছিল৷ সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় নাটক গান রেকর্ড হচ্ছে এবং সেগুলো সিডির মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে৷ ঢাকার কেন্দ্রীয় ক্যাসেট সিডি প্রকাশনা পাড়ার তুলনায় সিলেটের সেই দোকানগুলোতে বিক্রি কম ছিল বলে আমার মনে হয় নি৷

আপনি কি জানেন ‘কটাই মিয়া’ নামে একজন কৌতুক অভিনেতা আছেন যিনি কোনো গ্রামের বাজারে গিয়ে দাঁড়ালে ভিড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়! তিনি একজন আঞ্চলিক অভিনেতা যার নাটক আঞ্চলিক ভাবে সিডিতে বিক্রি হয়৷ এই লেখাটি যখন লিখছি তখন মাত্র চার দিন আগে প্রকাশিত তাঁর শেষ নাটকটি ইউটিউবে প্রায় এক লাখ লোক দেখেছেন!

বাংলাদেশের জাতীয় টেলিভিশনের জন্য তৈরি কোনো গড়পড়তা নাটক মাত্র চার দিনে এক লাখ দর্শক অনলাইনে পাবে কী না আমার সন্দেহ আছে৷

এই বিচ্ছিন্নতা শুধু চোখের নয়, মননশীলতার অন্যান্য ক্ষেত্রেও আছে৷

কাশেম বিন আবুবাকার মারা যাওয়ার পরে জানা গেল যে এই নামে একজন লেখক ছিলেন! কাশেম বিন আবুবাকার, যিনি কখনোই আমাদের একুশে বইমেলায় স্টল সাজিয়ে অটোগ্রাফ দিতে বসেন নি, যাকে কখনোই কোনো টেলিভিশনের ক্যামেরা খুঁজে বেড়ায় নি, আমাদের বড় বড় সাহিত্য পত্রিকার পাতায় যিনি আলোচিত হননি, সেই কাশেম বিন আবুবাকার এই দেশে লেখালেখি করেই জীবন ধারন করে গেছেন৷ গড়পড়তা যে তথাকথিত জনপ্রিয় লেখকদেরকে আমরা বইমেলার উসিলায় চিনি ও কিনি, তাঁদের তুলনায় কাশেমের বইয়ের পাঠক ছিল অনেক বিস্তৃত৷ দেশে যেখানে কোনো বইয়ের পাঁচশ কপি বিক্রি হলেই বেস্টসেলা বলে রব উঠে, সেখানে কাশেমের 'ফুটন্ত গোলাপ' জাতীয় বইগুলো লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে৷ এই শ্রেনীতে আরো বেশ কিছু লেখক আছেন যারা সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন পাঠকগোষ্ঠিকে বেশ দাপটের সাথেই সার্ভ করে যাচ্ছেন৷

এই যে বিনোদনের আন্তবিচ্ছিন্নতা, এটি মূলত শ্রেনীভিত্তিক৷ মধ্যবিত্তের বিনোদন সংস্কৃতির বাইরে নিম্নবিত্ত সবসময়ই একটি আলাদা বিনোদন ভোক্তা হিসেবে ছিল, কিন্তু একেবারেই আন্তসম্পর্কহীন এই অবস্থাটা চিন্তার বিষয়৷ এই একটা উদাহরণ থেকেই বুঝা যায় যে আমাদের একই বাঙালি জাতিসত্ত্বায়, একই ভাষা এবং মোটামুটি ধর্মীয় সংস্কৃতি ( ইসলাম এখানকার একক ডোমিনেটিং ধর্ম) সত্ত্বেও শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অবস্থার কারনে জাতিসত্ত্বার মধ্যে আলাদা আলাদা স্রোত বয়ে যাচ্ছে৷ দুনিয়ার সবখানেই অর্থনীতি এবং সামাজিক অবস্থান মানুষের বিনোদন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে, সেটা ঠিক আছে কিন্তু এরকম একেবারের পরষ্পর বিচ্ছিন্নতা বোধহয় বিশ্বের আর কোনো দেশেই নেই৷

আরিফ জেবতিক, ব্লগারছবি: Arif Jebtic

আমাদের দেশে সংস্কৃতির যে শাখা প্রশাখার ভোক্তা হিসেবে মধ্যবিত্ত শ্রেনী গড়ে উঠেছে তা খুব বেশিদিন আগের নয়৷ এই ‘রাবীন্দ্রিক বিনোদন সংস্কৃতি’র চর্চায় মধ্যবিত্তরা নগরের সবগুলো হল অডিটোরিয়াম ভরিয়ে ফেললেও, দেশের সবচাইতে বড় জনগোষ্ঠি কেন এর সাথে সম্পৃক্ত না হয়ে একেবারেই নীরবে নিভৃতে আলাদা বিনোদন নিজেরাই তৈরি করে ভোগ করছে, সেটি ঘনিষ্টভাবে পর্যবেক্ষন করা দরকার৷ এর কারন খুঁজে না পেলে আমরা আগামীতে বড় সাংস্কৃতিক সংকটের মধ্যে পড়ব৷

আমাদের নগরকেন্দ্রিক বিনোদনের বাইরে দাঁড়ানো এই ভোক্তাশ্রেণী অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ এর মানে হচ্ছে আমরা সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত নই৷ কেন তাঁদের রুচির সাথে আমাদের রুচি একেবারেই মিলছে না, কোন কোন নিয়ামক এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে তা দেখার দরকার আছে৷

শিক্ষা এখানে বড় ভূমিকা রাখছে বলে আমার মনে হয় না৷ কারন একই শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে দেশের অধিকাংশ মানুষ বাস করে৷ অবকাঠামোও এখানে বড় ফ্যাক্টর নয়৷ একটা ছোট দেশ, এখানে কানেক্টিভিটিটা বেশ জড়িয়েই আছে৷ গ্রামেগঞ্জে ইলেক্ট্রিসিটি আছে, ইন্টারনেট আছে৷ একক ভাবে একটা দেশের অর্থনীতি বিনোদন ভোক্তা শ্রেনীর পরষ্পর বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে এমনটা সাদাচোখে মনে হলেও, ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়৷

কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতাটা আছে৷ প্রবল ভাবে আছে৷ এই লাইকি-টিকটক-ইমো সুপারস্টারদের আলোচনা উঠলেই হঠাৎ করে তা প্রকটভাবে চোখে পড়ে৷

আমরা শুধু বিনোদনের বিচ্ছিন্নতার কথাটাই জানলাম, এরকম আরো কত বিচ্ছিন্নতা রয়ে গেল সেই খবর বোধহয় এখনও আমরা পাইনি৷

একদিন হয়তো সেটাও পাওয়া যাবে৷

কিন্তু একটি ছোট দেশে, একই নৃতত্ত্ব, একই ভাষার সংস্কৃতিতে এরকম বিচ্ছিন্নতা আমাদের জাতিগত মননশীলতার মাঝের বড় শূন্যতাকেই চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়৷

এই শূন্যতা পূরণ না হলে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি সহ কতকিছুই যে অগোচরে দুর্বল হতে থাকবে, কে জানে!

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ