সমুদ্র থেকে উদ্ধারকৃত ৮ অভিবাসীকে এবার আলবেনিয়া পাঠালো ইটালি
৯ নভেম্বর ২০২৪
নৌবাহিনীর একটি জাহাজে করে অনিয়মিত অভিবাসীদের দ্বিতীয় একটি দলকে আলবেনিয়া পাঠিয়েছে ইটালি৷ দলটিতে বাংলাদেশ ও মিশরীয় আট অভিবাসী রয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার অভিবাসীদের বহনকারী ইটালির জাহাজটি আলবেনিয়ার শেনজিন বন্দরে পৌঁছায়৷ এই আট অভিবাসী উত্তর আফ্রিকা থেকে নৌকায় করে ইটালি পৌঁছান৷ ইটালির নৌবাহিনীর জাহাজ কয়েকদিন আগে তাদের সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে৷ তবে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকায় এই আটজনের মধ্যে একজনকে শনিবার ইটালিতে ফেরত আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির বার্তা সংস্থা আনসা৷
ইউরোপ মহাদেশে অবস্থান হলেও আলবেনিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত নয়৷ নতুন স্কিমের অংশ হিসেবে ইটালি অনিয়মিত অভিবাসীদের আশ্রয় আবেদন প্রক্রিয়ার জন্য দেশটির সঙ্গে চুক্তি করেছে৷ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আলবেনিয়ার দুইটি আশ্রয় কেন্দ্রে মাসে তিন হাজার অভিবাসীর আশ্রয় আবেদন প্রক্রিয়া করা হবে৷ সরকার জানিয়েছে, যাদের আশ্রয় আবেদন গৃহীত হবে তাদের ইটালিতে ফেরত আনা হবে৷ আর প্রত্যাখ্যাতদের আলবেনিয়া থেকেই নিজ দেশ ডিপোর্ট বা প্রত্যাবাসন করা হবে৷
এই স্কিমের অংশ হিসেবে অভিবাসীদের দ্বিতীয় এই দলটিকে আলবেনিয়ায় পাঠিয়েঠছে রোম৷ ইইউ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ইটালিই প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয় এমন তৃতীয় রাষ্ট্রে অভিবাসীদের আশ্রয় আবেদন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে, যার বিরোধিতা করে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো৷
আফ্রিকার উত্তর উপকূলগুলো থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে প্রতি বছরই অনেক অভিবাসী ইটালিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন৷ গত বছরের তুলনায় চলতি বছর এই সংখ্যা ৬০ শতাংশ কমেছে৷ ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সাত নভেম্বর পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৭৬৭ জন সমুদ্রপথে দেশটিতে প্রবেশ করেছেন৷
ইটালির ডানপন্থি জর্জা মেলোনির সরকার অনিয়মিত অভিবাসন রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ গত বছরের শেষ দিকে আশ্রয় আবেদন প্রক্রিয়াকরণে একটি চুক্তিতে সই করে ইটালি ও আলেবনিয়া সরকার৷
ইটালির এই স্কিমের দিকে নজর রাখছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য সরকারগুলোও৷ ইটালি সফল হলে আরো সদস্য দেশ এই পথে হাঁটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
অনিয়মিত অভিবাসন ঠেকাতে ইইউর যত পদক্ষেপ
অনিয়মিত অভিবাসীদের আগমন ঠেকাতে তৎপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ জোটগত সিদ্ধান্তের পাশাপাশি সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মতো করেও নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
অনিয়মিত পথে অভিবাসীদের ঢল
ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সংঘাত ও যুদ্ধ থেকে পালিয়ে উন্নত জীবনের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ পাড়ি জমাতে চান আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ৷ ইউরোপীয় বর্ডার অ্যান্ড কোস্ট গার্ড এজেন্সি (ফ্রন্টেক্স) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বছরের প্রথম আট মাসে মোট এক লাখ ৩৯ হাজার ৮৪৭টি অনিয়মিত সীমান্ত পারাপারের প্রচেষ্টা নথিভুক্ত করা হয়েছে৷
ছবি: Europa Press/ABACA/picture alliance
নানামুখী পদক্ষেপ
অনিয়মিত পথে আসা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঠেকাতে নানা পরিকল্পনা করছে ইউরোপের দেশগুলো৷ যুক্তরাজ্য ও ইটালি এরই মধ্যে তৃতীয় বা ইউরোপের বাইরের কোনো দেশে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের পদক্ষেপ নিয়েছে৷ তবে আদালতের বাধার মুখে তাদের পরিকল্পনা এখনো আলোর মুখ দেখেনি৷ অনিয়মিত অভিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে জার্মানি, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়ার মতো ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশেও এমন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে৷
ছবি: Attila Husejnow/ZUMA Press Wire/IMAGO
ইটালির আলবেনিয়া পরিকল্পনা
ভূমধ্যসাগর তীরের এই দেশটিতে এশিয়া ও আফ্রিকার হাজার হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী প্রতিবছর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে হাজির হন৷ ইটালির জর্জা মেলোনির নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল সরকার অভিবাসীদের এই স্রোত সামলাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ এর অংশ হিসেবে আলবেনিয়ার সাথে চুক্তি করেছে দেশটি৷ এরইমধ্যে গত ১৩ অক্টোবর সাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ১০ বাংলাদেশি ও ৬ মিশরীয়কে আলবেনিয়াতে পাঠানো হয়েছে৷
ছবি: Florion Goga/REUTERS
যুক্তরাজ্যের রুয়ান্ডা পরিকল্পনা
অনিয়মিত পথে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নিতে চাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার সাথে চুক্তি করেছিলেন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক৷ তবে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার মুখে এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞায় শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে যায় ওই চুক্তি৷
যুক্তরাজ্য ও ইটালির মতো তৃতীয় কোনো দেশে অনিয়মিত অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আবেদন যাচাই-বাছাই নিয়ে নিজেদের পরিকল্পনার কথা জানায় ইউরোপের আরেক দেশ অস্ট্রিয়া৷ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোকে উৎসাহী করতে আলোচনা শুরুর কথাও জানান দেশটির চ্যান্সেলর কার্ল নেহামের ৷ ইউনিয়নের ১৪টি দেশ এই পরিকল্পনায় সমর্থন দেয়৷
ছবি: JOHN THYS/AFP
কঠোর অবস্থানে ডেনমার্ক
অ-নথিভুক্ত অভিবাসীদের আবেদন যাচাই-বাছাই তৃতীয় কোনো দেশে করার কথা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশ ডেনমার্কও ভাবছে৷ এই লক্ষ্যে অস্ট্রিয়ার সাথে মিলে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চিঠিও দিয়েছে দেশটি৷
প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের ডিপোর্ট করা বা নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বদলে আফ্রিকার দেশ উগান্ডায় পাঠানোর কথা ভাবছে নেদারল্যান্ডস৷ ১৬ অক্টোবর দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক মন্ত্রী টেলিভিশন চ্যানেল এনওএস-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের অভ্যর্থনা শিবিরে স্থান দেবে উগান্ডা৷ সেখানে তাদেরকে আর্থিক ক্ষতিপূরণও দেয়া হবে৷
ছবি: Remko de Waal/ANP/IMAGO
সীমান্ত নজরদারিতে জার্মানি
১৬ সেপ্টেম্বর থেকে নয়টি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে থাকা সব স্থল সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে জার্মান পুলিশ৷ ছয় মাসের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেশটি অনিয়মিত অভিবাসন ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়৷ এই সিদ্ধান্তের আলোকে লুক্সেমবুর্গ, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্ক সীমান্তে জার্মান পুলিশ নজরদারি শুরু করছে৷ এর আগেও সীমান্তে এমন কড়াকড়ি শুরু হয়েছিল৷
ছবি: Christoph Hardt/Panama Pictures/IMAGO
ভিন্ন চিন্তা ফ্রান্সের
ফ্রান্স অবশ্য ইটালি বা যুক্তরাজ্যের মতো কোনো পরিকল্পনা করছে না বলে জানা গেছে৷ দেশটির প্রধানমন্ত্রী মিশেল বার্নিয়ের এরই মধ্যে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ তবে ফ্রান্স সরকার অভিবাসীদের ট্রানজিট দেশগুলোর সঙ্গে, অর্থাৎ যেই পথ ধরে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা যাত্রা করেন ওই দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চায়৷
ছবি: Christopher Furlong/Getty Images
টিউনিসিয়ার সাথে ইউরোপের চুক্তি
অনিয়মিত পথে অভিবাসন থামাতে যাত্রা পথেই তাদেরকে আটকে দিতে চায় ইইউ৷ এই লক্ষ্যে উত্তর আফ্রিকার দেশ টিউনিশিয়ার সাথে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে ইউনিয়ন৷ চুক্তি অনুযায়ী, ইইউর সহযোগিতায় ঝুঁকিপূর্ণ এসব যাত্রা আটকে দিতে কাজ করছে টিউনিশিয়ার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ চলতি বছর ইইউ-র সঙ্গে যৌথ সহযোগিতার ফলে টিউনিশিয়ার উপকূলরক্ষীরা অভিবাসীদের বহনকারী প্রায় ২৪ হাজার নৌকা আটকে দিয়েছে৷
ছবি: Hasan Mrad/ZUMA Wire/IMAGO
10 ছবি1 | 10
আদালতের সঙ্গে বিরোধ
ইটালি সরকারের এই স্কিম বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আদালত৷
অক্টোবরে প্রথমবারের মতো ১০ বাংলাদেশি এবং ছয় মিশরীয়কে উদ্ধারের পর আলবেনিয়ার শেনজিন বন্দরের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়৷ কিন্তু দেশটির আদালত এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রায় দেয়৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ বা মিশর নিরাপদ দেশের তালিকাভুক্ত না হওয়ায় তাদের ফেরত আনার নির্দেশও দেন বিচারকেরা৷ যে কারণে তিনদিনের মাথায় ঐ অভিবাসীদের ইটালিতে ফেরত আনতে বাধ্য হয় সরকার৷
আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় ২১ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে নতুন ডিক্রি জারি করে মেলোনি সরকার৷ এ বছরের জুনে সরকার ঘোষিত ১৯টি নিরাপদ দেশের তালিকাকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যার মধ্যে মিশর ও বাংলাদেশকেও রাখা হয়েছে৷
কিন্তু এই ডিক্রি পরীক্ষা করে দেখতে ইউরোপীয় বিচার আদালতকে অনুরোধ জানিয়েছে বলোনিয়ার আদালত৷
এদিকে প্রথম রুলের পরে ইটালির প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনেছেন আদালতের বিরুদ্ধে৷ অন্যদিকে উপপ্রধানমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনি বিচারকদের ‘কম্যুনিস্ট' বলে অভিহিত করেন৷
সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য হুমকির মুখে বলে অভিযোগ করেছে বিরোধীরা৷