অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র সৈকত থেকে উদ্ধার হলো শতাব্দীপ্রাচীন জার্মান বোতল৷ সেই বোতলের ভিতরে মিলেছে সমুদ্র গবেষণার চমকপ্রদ সব তথ্য৷ বোতলটি নিয়ে আসা হয়েছে হামবুর্গে৷
বিজ্ঞাপন
মহাসাগরের প্রকৃতি কেমন? কোনদিকে স্রোত? সেই স্রোতের বেগই বা কত? এসব প্রশ্ন নতুন নয়৷ বহুকাল ধরে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন বিজ্ঞানীরা৷ অনেক তথ্য পাওয়া যায়, আবার অনেক কথা জানাও যায় না৷ অজানা তেমনই এক আশ্চর্য তথ্য জানা গেল এতদিন পর৷ একটি বোতলেরকারণে৷
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রায় অচেনা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলেন টনিয়া ইলম্যান৷ হঠাৎই বালির মধ্যে প্রায় ডুবে থাকা একটি বোতল দেখতে পান তিনি৷ টনিয়া জানতেন, খুব বেশি মানুষ ওই সমুদ্রসৈকতে যান না৷ তাহলে কে ফেলে গেল ওই বোতল? নিছকই কৌতূহলের বশে বোতলটি কুড়িয়ে নেন তিনি৷ দেখেন, বহু পুরনো ওই বোতলটির ভিতরে সন্তর্পণে রাখা আছে একটি ফর্ম৷ বাড়ি নিয়ে গিয়ে সেই ফর্ম শুকনো করেন টনিয়া৷ দেখেন জার্মান ভাষায় কিছু লেখা রয়েছে ভিতরে৷ কাল বিলম্ব না করে টনিয়া বোতলসুদ্ধ ফর্মটি অস্ট্রেলিয়ার একটি জাদুঘরে নিয়ে যান৷
সাগরের মায়াপুরী
ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞদের মতে সমুদ্রের পাঁচটি স্থানকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত৷ অবশ্য সাগরের অতলে এই স্থানগুলিতে দর্শক সমাগম হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই!
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Courtesy Chris Burville
সাগরের গভীরে, জলের তলায় এক আশ্চর্য জগৎ
সাগরের পানির নীচে পাঁচটি স্থানকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেবার সুপারিশ করেছেন ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞরা৷ এই সব স্থানের বাসিন্দাদের সৌন্দর্য অকল্পনীয়; সেই সঙ্গে রয়েছে অপরিসীম জীববৈচিত্র্য; এছাড়া পরিবেশ বিপন্ন হলে, তার চিহ্নও ধরা পড়ে এখানে৷
ছবি: Kevin Raskoff/NOAA/Wikipedia
‘‘হারানো শহর’’
অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে ৮০০ মিটার জলের তলায় ভূপৃষ্টের ফাটল থেকে আগুন, গরম লাভা ও গ্যাস বেরিয়ে আসছে৷ ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের অন্য কোথাও এ ধরনের একটি আশ্চর্য পরিবেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট নামে পরিচিত প্রাকৃতিক চিমনিগুলি থেকে সম্ভবত ১ লক্ষ ২০ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে গ্যাস নির্গত হচ্ছে৷ সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় চিমনিটির নাম রাখা হয়েছে পোসাইডন৷ উচ্চতা ৬০ মিটারের বেশি৷
ছবি: Woods Hole Oceanographic Institute and Charles Fisher, Pennsylvania State University
কোস্টা রিকার থার্মাল ডোম
প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ৫০০ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘের এই এলাকাটিকে ‘‘সাগরের মরুদ্যান’’ আখ্যা দিয়েছেন ইউনেস্কোর বিজ্ঞানীরা৷ এখানে যেমন টুনা মাছ কিংবা শুশুক, তেমনই হাঙর বা তিমি মাছ পাওয়া যায়৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে এলাকার সবচেয়ে বড় বাসিন্দা নীল তিমিকে৷ বিশেষভাবে বিপন্ন সামুদ্রিক কচ্ছপ লেদারব্যাক টার্টলরাও এখান দিয়ে যায়৷
ছবি: picture alliance/WILDLIFE
হোয়াইট শার্ক কাফে
সাদা হাঙরের কফিহাউস? হ্যাঁ, মেরিন বায়োলজিস্টরা সত্যিই এই নাম দিয়েছেন৷ জায়গাটা কিন্তু খোলা সমুদ্রে, উত্তর অ্যামেরিকা আর হাওয়াই দ্বীপের মাঝামাঝি৷ হোয়াইট শার্ক নামধারী হাঙরদের ভিড় লেগে থাকে এখানে, হয়তো জলের বিভিন্ন স্রোত তাদের ভালো লাগে বলে৷
ছবি: Pterantula (Terry Goss) via Wikimedia Commons
সারগাসো সি
স্বয়ং কলম্বাস নাকি ১৮৯২ সালে তাঁর প্রথম সমুদ্রযাত্রার সময় এই দৃশ্য দেখেছিলেন৷ বার্মুডার দ্বীপগুলোকে ঘিরে রয়েছে এই সারগাসো সাগর৷ সারগাসো নামটি এসেছে সার্গাসুম নামধারী ভাসন্ত সামুদ্রিক শ্যাওলা থেকে৷ সার্গাসুম-কে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘ভাসন্ত সোনালি ক্রান্তীয় অরণ্য’৷ এই ‘অরণ্যে’ বহু জীব ও প্রাণীর বাস৷ ইউরোপীয় ও অ্যামেরিকান বানমাছেরা শুধু এখানেই ডিম পাড়ে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Courtesy Chris Burville
অ্যাটলান্টিসের পাড়
ভারত মহাসাগরের এই জলমজ্জিত দ্বীপটি নাকি লক্ষ লক্ষ বছর আগে সাগরে ডুবে গিয়েছিল – এই কি তাহলে কিংবদন্তীর অ্যাটলান্টিস মহাদেশ? সাগরের ৭০০ থেকে ৪,০০০ মিটার নীচে চড়াই-উৎরাই, সৈকৎ কিংবা উপহ্রদ, সবই পাওয়া যায় – সেই সঙ্গে বড় বড় অ্যানেমনি, সুবিশাল স্পঞ্জ ও প্রবাল৷
ছবি: The Natural Environment Research Council and IUCN/GEF Seamounts Project C/O Alex D Rogers
সারা পৃথিবীর, গোটা মানবজাতির সম্পদ
পাঁচটি স্থানই সাগরের জলভূমির আন্তর্জাতিক অংশে, কোনো বিশেষ দেশের তাঁবে নয়৷ তার খারাপ দিকটা হল এই যে, এই ধরনের এলাকা সুরক্ষিত বা সংরক্ষিত করা কঠিন৷ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আখ্যা দেওয়াটা তার একটা পন্থা হতে পারে৷
7 ছবি1 | 7
পরীক্ষা করে দেখা যায়, ১৮৮৬ সালের ১২ জুন ওই বোতলটি সমুদ্রে ফেলা হয়েছিল একটি জার্মান জাহাজ থেকে৷ ভিতরের ফর্মে লেখা আছে কত ডিগ্রি অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ থেকে ওই বোতল জলে ফেলা হয়েছে৷ নাবিকের নাম, পরীক্ষকের নাম সবই লেখা আছে সেখানে৷ ফর্মের উল্টোদিকে বলা হয়েছে, বোতলটি পাওয়া মাত্র যেন হামবুর্গের সমুদ্র গবেষণাকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷
১৮৮৬ সালে বার্ক শিপ পাউলা নামের একটি জাহাজ কার্ডিফ থেকে মাকাসারের দিকে রওনা হয়েছিল৷ সেই জাহাজ থেকেই বোতলটি ফেলা হয়৷ বস্তুত, সেই সময় জার্মান সমুদ্র বিজ্ঞানী জর্জ ফন নিউমায়ার একটি গবেষণা করছিলেন৷ বিভিন্ন অঞ্চলের সমুদ্রে বোতল ফেলে তিনি পরীক্ষা করছিলেন মহাসাগরীয় স্রোত এবং বেগ৷ বোতল ফেলার পর বেশ কিছু উদ্ধারও হয়েছিল ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে৷ তা থেকে একটি ধারণাতেও পৌঁছেছিলেন তিনি৷ তবে বহু বোতলই নিখোঁজ হয়ে যায়৷ এর আগে ১৯৩৪ সালে ডেনমার্কেও এ ধরনের একটি বোতল পাওয়া গিয়েছিল৷ এবার পাওয়া গেল অস্ট্রেলিয়ায়৷
জার্মান গবেষকেরা জানিয়েছেন, বোতলের ফর্মে থাকা সমস্ত তথ্য সেই সময় পাউলা জাহাজের নাবিকের দেওয়া তথ্যের ফাইলের সঙ্গে মিলে গিয়েছে৷ ওই বোতল এবং ফর্ম কিছুদিনের মধ্যেই দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে৷ হামবুর্গের মহাসগারীয় জাদুঘরে ওই ধরনের আরো কিছু বোতলও রাখা আছে বলে জানা গিয়েছে৷
সমুদ্রসুন্দরী জেলিফিশ
জেলিফিশের বেশ দুর্নাম আছে৷ বেশিরভাগ মানুষই একে ঘেন্না করেন, অনেকে আবার ভয়ও পান৷ কিন্তু এই সামুদ্রিক জীবটি আসলে ভয়ঙ্কর সুন্দর৷ এবং সাগরজুড়ে ভেসে বেড়াতে তাদের মস্তিষ্কেরও প্রয়োজন পড়ে না৷
ছবি: Stefan Ebersberger
মস্তিষ্কই নেই? তাতে কি!
প্রায় ৫০ কোটি বছর ধরে সাগরের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে জেলিফিশ৷ কোথায় যাচ্ছে, কোনদিকে যাচ্ছে, তা বোঝার জন্য যে বুদ্ধিটুকু থাকা দরকার, তাও নেই তাদের৷ থাকবেই বা কিভাবে? বুদ্ধির জন্য মস্তিষ্ক তো থাকতে হবে! জেলিফিশের তাও নেই৷ তবে তাদের জটিল স্নায়ুতন্ত্র মস্তিষ্ক ছাড়াই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷
ছবি: picture alliance/Photoshot
সাগরের মেডুসা
গ্রিক পুরাণের এক পিশাচির নাম মেডুসা, চুলের বদলে যার মাথা ভর্তি সাপ৷ জেলিফিশও দেখতে অনেকটা সেরকম৷ মূল শরীর থেকে কিলিবিল করে বের হয়ে এসেছে সাপের মতো কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ৷ এজন্য তাদের বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে মেডুসোজোয়া৷
ছবি: picture alliance/dpa/A. Heimken
হাত-পাওয়ালা ছাতা
আমরা অনেকেই জানি যে, মানুষের শরীরের ৬৩ শতাংশ পানি৷ এবার চিন্তা করে দেখুন, একটা জেলিফিশের শরীরের ৯৯ শতাংশই পানি৷ তাদের শরীরের একটা বড় অংশ দেখতে ছাতার মতো৷ এর সাথে থাকে হাত-পায়ের মতো শত শত কর্ষিকা৷ কিছু কিছু জেলিফিশের ক্ষেত্রে এই কর্ষিকাগুলো কয়েক মিটার লম্বা হয়ে থাকে৷ শিকার ও খাবার আহরণের জন্য জেলিফিশ এই কর্ষিকাগুলো ব্যবহার করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Zankl
এই মাছ, মাছ নয়
নাম জেলিফিশ হলেও, এরা কিন্তু মোটেও ফিশ বা মাছ নয়৷ জীববিজ্ঞানিরা তাদের বিশ্লেষণ করে অন্তর্ভূক্ত করেছেন স্নিডারিয়া পর্বে৷ এই পর্বের অন্যান্য জীবদের মধ্যে আছে প্রবাল এবং এনেমোন নামের এক ধরনের সামুদ্রিক শিকারি ফুল৷
ছবি: picture-alliance/Geisler-Fotopress
দৈত্যাকার জেলিফিশ
বেশিরভাগ জেলিফিশই সাদা এবং স্বচ্ছ হয়৷ কিন্তু আছে কিছু ব্যতিক্রমও৷ এশিয়ান নমুরা জেলিফিশ খুব একটা রঙচঙে না হলেও, আকারে হয়ে থাকে বিশাল৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২ মিটার ব্যাসের এক একটি জেলিফিশের ওজন ২০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে৷
সবসময় সমুদ্রের স্রোতের সাথে ভেসে চলায় বিজ্ঞানীরা জেলিফিশকে প্ল্যাঙ্কটন হিসেবেই বিবেচনা করেন৷ নিজে থেকে কোথাও যাওয়া জেলিফিশের কাজ না৷ মাঝে মাঝে অবশ্য ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি তুলতে পারে জেলিফিশ৷ তবে যে কোনো ছোট আকারের পোকাও এর চেয়ে জোরে হাঁটতে পারে৷
ছবি: picture alliance/Photoshot
বিষাক্ত সুন্দরী
জলে ভেসে বেড়ানোর সময় রঙিন জেলিফিশকে দেখতে অসাধারণই লাগে৷ কিন্তু এদের অনেকেরই আছে ভয়ঙ্কর কর্ষিকা৷ ছবির লায়নস মেইন জেলিফিশ কর্ষিকা দিয়ে বিষ ঢুকিয়ে শিকারকে মেরেও ফেলতে পারে৷ প্ল্যাঙ্কটন, শ্যাওলা, ছোট ছোট কাঁকড়া এবং মাছের পোনা আছে জেলিফিশের খাবারের তালিকায়৷
ছবি: cc-by-sa/Kip Evans
আগুনের মতো জ্বলুনি
লায়নস মেইন জেলিফিশের সংস্পর্শে মানুষের চামড়ায় আগুনের মতো জ্বলুনি হয়৷ লাল লাল ফোসকাও পড়ে চামড়ায়৷ এই জেলিফিশের বিষ অবশ্য প্রাণঘাতী না৷ কিন্তু বক্স জেলিফিশ বা সি ওয়াসপ জেলিফিশের ক্ষেত্রে তা এতটা জোর দিয়ে বলা যায় না৷ প্রাণিজগতে সবচেয়ে বিষধরদের একটি এই জেলিফিশ৷
ছবি: picture-alliance/R. Wilms
স্পেশাল ইফেক্ট
সামান্য এই জেলিফিশেরও আছে অসামান্য ক্ষমতা৷ পেলাগিয়া নকটিলুকা নামের এক ধরনের জেলিফিশ সাগর উত্তাল হলে উজ্জ্বল আলো ছড়ায়৷ এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় বায়োলুমিনেসেন্স৷ অসাধারণ, তাই না?
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/H. Goethel
জেলিফিশও ঘুমায়!
জেলিফিশের কোনো মস্তিষ্ক নেই, নেই কোনো হৃদয়ও৷ কিন্তু তারপরও তারা ঘুমায়৷ অবাক কাণ্ড না? বিজ্ঞানীরা বলছেন ছবির এই ক্যাসিওপিয়া নামের জেলিফিশটি দিনের বেশিরভাগ সময়ই সাগরের তলদেশে কাটায়৷ রাতের সময়টা তারা ঘুমিয়ে কাটায় বলেও জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা৷ এমনকি মানুষের মতোই তাদের জেগে উঠতেও সময় লাগে বেশ কিছুক্ষণ৷