উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমান অধিকারের দাবিতে লড়ছেন এক মিশরীয় নারী৷ বাবার মৃত্যুর পর এ পর্যন্ত তিনবার আদালতের দারস্থ হয়েছেন তিনি৷
পিতার সম্পত্তির সমান অধিকার পাওয়ার জন্য আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন হুদা নাসরাল্লাহ৷ ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Alleruzzo
বিজ্ঞাপন
হুদা নাসরাল্লাহ একজন খ্রিস্টান নারী৷ গত বছরের ডিসেম্বরে তার বাবা মারা যান৷ এরপর থেকে তিনি ঘুরছেন এক আদালত থেকে আরেক আদালতে৷ উদ্দেশ্য, মৃত্যুকালে যেই সম্পদ বাবা রেখে গেছেন দুই ভাইয়ের সাথে তার যেন সমান ভাগ পান তিনি৷ কিন্তু দেশটির বর্তমান আইন তা অনুমোদন করে না৷ সেখানে উত্তরাধিকার সম্পদের বণ্টন হয় ইসলামিক মোতাবেক৷
এখন পর্যন্ত আদালত দুইবার নাসরাল্লাহর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে৷ ৪০ বছর বয়স্ক এই মানবাধিকার আইনজীবী এখন দারস্থ হয়েছেন উচ্চ আদালতের৷ চলতি মাসের শেষ নাগাদ বিচারকদের এ নিয়ে চূড়ান্ত রায় দেয়ার কথা রয়েছে৷
মুসলিম আইন অনুযায়ী, মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অর্ধেক সম্পদের উত্তরাধিকার পাবে৷ কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মে ছেলে বা মেয়ে উভয়ই সমান সম্পদের ভাগ পেতে পারে, যা চাইছেন নাসরাল্লাহ৷ তিনি বলেন, ‘‘ এটা উত্তরাধিকারের বিষয় নয়, আমার বাবা লাখ লাখ টাকাও রেখে যাননি৷ কিন্তু আমার ভাইদের সমান সম্পদ দাবির অধিকার আমার রয়েছে৷''
বিভিন্ন ধর্মে উত্তরাধিকার আইন
কারো সম্পত্তির উত্তরাধিকার কে হবেন, বা তা ভাগাভাগিই হবে কীভাবে, এ সব বিষয় এখনো একেবারেই পারিবারিক পরিমন্ডলেই বিচার হয়৷ তাই এর জন্য রয়েছে পারিবারিক আইন৷ তবে এই আইন একেক ধর্মের জন্য একেকরকম৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
উত্তরাধিকার আইন
কোনো নারী বা পুরুষের মৃত্যুর পর তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে মৃতের আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের খরচ, দেনাশোধ বা মৃতব্যক্তি যদি কোন উইল সম্পাদন করে যান তবে তা হস্তান্তরের পর যে সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে তার উপর মৃতের সন্তান সন্তানাদি ও আত্মীয় স্বজনের যে অধিকার জন্মায়, তাকে উত্তরাধিকার বলে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বিভিন্ন ধর্মে উত্তরাধিকার আইন
বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য প্রায় সব ধর্মাবলম্বীর, এমনকি আদিবাসীদেরও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধি-বিধান আছে৷ যেমন, মুসলিমদের জন্য আইনটি কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী তৈরি৷ আবার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আইন আলাদা৷ সময়ে সময়ে কিছু কিছু আইন সংস্কারও করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন
মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে তিন শ্রেণির উত্তরাধিকার আছে৷ যেমন : অংশীদার, অবশিষ্টাংশ ভোগী, দূরবর্তী আত্মীয়বর্গ৷ অংশীদারগণ সব উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অগ্রাধিকার পান৷ অংশীদারদের মধ্যে স্ত্রী অন্যতম৷ পিতা, মাতা, ছেলে, মেয়ে, স্বামী ও স্ত্রী – এঁরা কেউই উত্তরাধিকার সম্পত্তি হতে বাদ যান না৷ পুত্র, কন্যা, স্বামী, স্ত্রী কিংবা অন্য অংশীদাররা কে কতটুকু সম্পত্তি পাবেন তা নির্ধারিত করা আছে৷
ছবি: Reuters/C. McNaughton
হিন্দু উত্তরাধিকার আইন
এখানে দুই ধরনের উত্তরাধিকার পদ্ধতি চালু আছে – মিতক্ষরা ও দায়ভাগ পদ্ধতি৷ বাংলাদেশে দায়ভাগ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়৷ এ আইন অনুযায়ী, যারা পিণ্ডদানের অধিকারী, তারাই যোগ্য উত্তরাধিকারী৷ পিণ্ডদানের অধিকারীদের তালিকায় থাকা ৫৩ জনের মধ্য পুত্র, পুত্রের পুত্র, পুত্রের পুত্রের পুত্র, স্ত্রী, পুত্রের স্ত্রী, পুত্রের পুত্রের স্ত্রী, পুত্রের পুত্রের পুত্রের স্ত্রীর পরে কন্যা আসেন৷ এই আইনের সংস্কারের দাবি বহুদিনের৷
ছবি: DW/M. Mamun
খ্রিষ্টান উত্তরাধিকার আইন
আমাদের দেশে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রিত হয় সাকসেশন অ্যাক্ট ১৯২৫-এর মাধ্যমে৷ কোনো মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়ে একই মর্যাদার অধিকারী, অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে তারা সমান অংশ লাভ করে৷ তবে মৃত ব্যক্তি যদি সম্পত্তি অন্য কারো নামে উইল করে যান, তাহলে সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হবে না৷
ছবি: imago/Xinhua
বৌদ্ধ উত্তরাধিকার আইন
বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী হিন্দু আইন অনুযায়ী তাদের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Mia
নৃ-গোষ্ঠীদের উত্তরাধিকার আইন
বেশিরভাগ নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের প্রথা অনুযায়ী নারীদের পিতা-মাতা ও স্বামীর সম্পদের মালিকানায় উত্তরাধিকারের কোনো পদ্ধতি নেই৷ এ কারণে এ নারীরা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন৷ পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী পাস হওয়ার পরও নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা আদৌ কোনো সুফল পাবেন কিনা, তা নিয়ে তাদের মাঝে সংশয় আছে৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS.com
7 ছবি1 | 7
গত বছর তিউনিসিয়ার সরকার উত্তরাধিকার সম্পদে সবার সমান অধিকার দিয়ে একটি বিল পাস করে৷ সেখানকার মুসলিম নারীবাদিরা স্বাগত জানিয়েছে এই উদ্যোগকে৷ এরপর থেকে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন দাবি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়৷ কিন্তু অনেক দেশের ইসলামিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমান অধিকারের বিরোধী৷ যেমন, মিশরের আল-আজহার৷ তাদের দাবি, উত্তরাধিকার সম্পদের সমান বণ্টন ইসলামিক আইনবিরুদ্ধ এবং তা মুসলিম সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে৷
কিন্তু নাসরাল্লাহর মতো খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কী হবে? বর্তমানে মিশরে তাঁর মতো এক কোটি কপ্টিক নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস রয়েছে, যারা খ্রিস্টান ধর্মানুসারী৷ আইন অনুযায়ী মিশরে ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিয়ে, চার্চ নির্মাণ ও মুসলিমদের ধর্মান্তর নিষিদ্ধ৷ খ্রিস্টানদের নিজেদের বিয়ে, বিচ্ছেদসহ ব্যক্তিগত কিছু বিষয় কপ্টিক চার্চের হাতে থাকলেও উত্তরাধিকার মীমাংসার ক্ষমতা তাদের হাতে নেই৷
অবশ্য কপ্টিক চার্চগুলোও বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে যথেষ্ট রক্ষণশীল৷ যেমন, বয়স্ক আর ইসলাম ধর্মান্তরিত হওয়া, এই দুইটি কারণ ছাড়া কেউ বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন না৷ একজন কপ্টিক নারী মিশরীয় সমাজে যে দ্বিগুণ বৈষম্যের শিকার হন নাসরাল্লাহর মামলাটিতে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন করিমা কামাল নামের মিশরের এক কলামিস্ট৷ তিনি বলেন, ‘‘আপনি একটি ধর্মের আইন অন্য ধর্মের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না৷''
মিশরের একটি চার্চে বিয়ের আয়োজন৷ এক কোটি কপ্টিক খ্রিস্টানদের বসবাস রয়েছে দেশটিতে৷ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Alleruzzo
সরকারি চাকুরিজীবী নাসরাল্লাহর বাবা কায়রোর নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস এলাকায় একটি চার তলা ভবন ও কিছু ব্যাংকের জমা টাকা রেখে যান৷ নাসরাল্লাহ স্থানীয় আদালতে কপ্টিকদের বিধি অনুযায়ী এই সম্পত্তি বণ্টনের আবেদন করেন৷ তার ভাইরাও চান বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ সবার মধ্যে সমবণ্টনহোক৷ কিন্তু আদালত দুই দফা তাদের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে৷
নাসরাল্লাহ জানান, অনেক কপ্টিক পুরুষও নিজেদের লাভের জন্য ইসলামিক আইন সমর্থন করে৷ যক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক আহমেদ জাকি বলেন, ‘‘উত্তরাধিকার ধর্মীয় আইনের বাইরের একটি বিষয়৷ এটা আমরা যেই সমাজে বাস করি তার প্রেক্ষিতেই বিবেচনা করা উচিত৷'' তাঁর মতে, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্পদে সমান অধিকার দেয়া হলে মুসলিমরাও একই দাবি তুলতে পারে৷ রাষ্ট্র এ নিয়ে ভয় পায় বলেও মনে করেন তিনি৷
নাসরাল্লাহর আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত আছেন গিরগিস বেবাওয়ি৷ গত দুই বছরে তিনি এমন ডজন খানেক মামলা নিয়ে লড়েছেন, হেরেছেন প্রতিটিতে৷ তবে তার আশা, মিশরের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালত এবার বিষয়টির মীমাংসা ভিন্নভাবে করবে৷
এফএস/এসিবি (এপি)
কেমন আছেন এশিয়ার নারীরা?
এশিয়ার দেশগুলো গত কয়েক বছরে নারী অধিকার সূচকে উন্নতি করলেও, অনেক দেশের নারীরা এখনো বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ ছবিঘরে দেখে নিন, এশিয়ার দেশগুলোতে নারী অধিকারের তুলনামূলক চিত্র৷
ছবি: NDR
আফগানিস্তান
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পতন ঘটানোর পর দেশটিতে নারী অধিকার বিষয়ে বেশ অগ্রগতি দেখা গেছে৷ তবে সম্প্রতি আফগান সরকারের সাথে তালেবানদের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় দেশটিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আবারও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/R. Conway
ইরান
দেশটির নারী ফুটবল দল গঠনের বিষয়টি দেখে বোঝা যায় যে, ইরানে নারীর সমানাধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে৷ তবে সমাজের সকল স্তরে নারীদের সমানাধিকার রক্ষায় এখনো সংগ্রাম করতে হচ্ছে মানবাধিকার কর্মীদের৷ নাসরিন সুটুডেহ নামের এক নারী আইনজীবী দীর্ঘদিন ধরে নারীদের বাধ্যতামূলক হিজাব প্রথা বাতিলের বিষয়ে লড়াই করছিলেন৷ সম্প্রতি দেশটির আদালত তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়৷
ছবি: Pana.ir
বাংলাদেশ
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, নারী অধিকার সূচকে ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে ভালো ছিল৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
পাকিস্তান
দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে৷ ছবিতে উজমা নাওয়াজ নামে পাকিস্তানের প্রথম নারী গাড়ি-কারিগরকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/S.S. Mirza
ভারত
নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অনেকটাই এগিয়েছে ভারত৷ সম্প্রতি নারীদের রাস্তায় বাইক চালানোর বিষয়টি দেখে দেশটিতে নারীদের অবস্থার বিষয়ে ধারণা পাওয়া যেতে পারে৷ তবে দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে অনেক নারীকেই যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়৷ সম্প্রতি নারীরা মি’টু আন্দোলনের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে৷
ছবি: Imago/Hindustan Times
ইন্দোনেশিয়া
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইন্দোনেশিয়া গত কয়েক বছরে বেশ অগ্রগতি অর্জন করলেও এখনো নারীদেরকে নিপীড়নমূলক শরিয়া আইনের মুখোমুখি হতে হয়৷ যেমন, দেশটির আচেহ প্রদেশ নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক হিজাব পরিধান আইন প্রণয়ন করেছে৷
ছবি: Imago/C. Ditsch
শ্রীলংকা
এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকায় নারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে৷
ছবি: Imago/Photothek
চীন
দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল ভোগ করছে নারীরা৷ তবে দেশটির পুরুষদের তুলনায় শিক্ষা ক্ষেত্রে এখনও সমান উপস্থিতি নেই নারীদের৷