সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোটভাগ
৫ মার্চ ২০১৪২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেসের জোটের কাছে বামফ্রন্টের শোচনীয় পরাজয় এবং পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পর থেকেই রাজ্য বাম নেতৃত্বের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন দীর্ঘদিনের বামপন্থি নেতা এবং মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা৷ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্বাচনি লড়াইয়ের অক্ষমতাকে কটাক্ষ করে রেজ্জাক মোল্লার সেই বিখ্যাত মন্তব্য – ‘‘হেলে ধরতে পারে না, কেউটে ধরতে গেছে'' – রাজ্য-রাজনীতিতে রীতিমত হাসির খোরাক করেছিল বামফ্রন্টকে৷ তবে সেটাই প্রথমবার নয়, তার আগে সিঙ্গুরের কৃষিজমি টাটাদের গাড়ি কারখানার জন্য ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্তের তিনি কিছুই জানতেন না, ভূমি ও ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী হিসেবে তাঁর সঙ্গে কোনো আলোচনাই করা হয়নি বলে প্রকাশ্যে মন্তব্য করে মুখ্যমন্ত্রী ও সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন রেজ্জাক সাহেব৷
কিন্তু যে বিতর্কিত মন্তব্য করার জন্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলো, তা আরও গভীর অর্থবহ, যার ফল সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য৷ রেজ্জাক মোল্লা হঠাৎই বলে বসলেন, সিপিআইএম-এর মতো আপাত ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদারমনস্ক হিসেবে পরিচিত দলেও বর্ণবৈষম্য রয়েছে৷ যে কারণে দলের উপরের তলায় কেবলই ব্রাক্ষ্মণ, কায়স্থ বা বৈদ্য, অর্থাৎ উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রাধান্য৷ তাঁরাই সাধারণত নেতা হন, তাঁদের কথাতেই দল চলে৷ সংখ্যালঘু বা দলিত শ্রেণির নেতাদের কথা দলে গুরুত্ব পায় না৷ নির্বাচনি বিপর্যয়ের পর দলের প্রথম সারির নেতাদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা এক কথা, কিন্তু কোনো বামপন্থি দলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর৷ সেটাও এমন এক সময়ে যখন লোকসভা ভোটের আগে বামপন্থিরা নিজেদের শক্তি সুসংহত করার চেষ্টা করছে৷
ফল সিপিআইএম রাজ্য কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন রেজ্জাক মোল্লা৷ কিন্তু বিন্দুমাত্র অনুশোচনার চিহ্ন না দেখিয়ে তিনি বললেন, অত্যন্ত স্বাগত এই সিদ্ধান্ত৷ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গড়ে ফেললেন নিজের নতুন দল ‘সামাজিক ন্যায়বিচার মঞ্চ' এবং ঘোষণা করলেন, সংখ্যালঘু এবং দলিত মানুষদের স্বার্থরক্ষায় লড়বে তাঁর দল৷ জানালেন, তাঁর লক্ষ্য হলো পশ্চিমবঙ্গে একজন সংখ্যালঘু মুখ্যমন্ত্রী এবং এমন একজন উপ-মুখ্যমন্ত্রী, যিনি দলিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করবেন৷
রেজ্জাক মোল্লা স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিলেন, যদিও সামনে লোকসভা নির্বাচন, কিন্তু তাঁর নজরে পাখির চোখ আসলে ২০১৬ সালে নির্ধারিত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন৷ তাঁর এই মঞ্চ গড়ার কিছুদিনের মধ্যেই মুখ খুললেন বিতর্কিত প্রাক্তন আইপিএস অফিসার নজরুল ইসলাম, যিনি দীর্ঘদিন ধরেই এই রাজ্যে সংখ্যালঘু শ্রেণিকে বঞ্চনার অভিযোগ করে আসছেন৷ বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে একাধিক বইও প্রকাশ করেন নজরুল ইসলাম, যার মধ্যে একটি বই সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া নিয়েও বিস্তর জলঘোলা হয়৷
সদ্য একটি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে নজরুল ইসলাম আবারও তাঁর পুরনো সব অভিযোগ তোলেন এবং বলেন, রেজ্জাক মোল্লা যা বলছেন, সবই সত্যি কথা৷ তবে শুধু বামফ্রন্টের আমলেই নয়, এই পরিবর্তনের সরকারের সময়ও সংখ্যালঘু আর দলিতদের কিছুমাত্র উন্নতি হয়নি৷ নিজের বক্তব্যের স্বপক্ষে যুক্তি সাজিয়ে লেখা তিনটি নতুন বইও এই সঙ্গে প্রকাশ করেছেন নজরুল ইসলাম, যাতে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংখ্যালঘু-প্রীতিও আদতে কত অসার৷ রেজ্জাক মোল্লার বক্তব্য যদি বামফ্রন্টকে অস্বস্তিতে ফেলে থাকে, তা হলে নজরুল ইসলামের মন্তব্য তৃণমূল সরকার এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অস্বস্তিতে ফেলবে৷ কারণ, চিরকাল বামপন্থিদের সমর্থক সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়ের ভোটব্যাংকে ভাঙন ধরিয়েই ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসতে সফল হয়েছিলেন মমতা৷ পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু এবং দলিতদের ভোট প্রায় ৪৭ শতাংশ৷
এই পরিস্থিতিতে রেজ্জাক মোল্লা বা নজরুল ইসলাম, অথবা সংখ্যালঘুদের একাংশের নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরি, গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে যাঁর সঙ্গে তৃণমূলের রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হয়েছে, তাঁদের অবস্থানের সাপেক্ষে রাজ্যের ভোটারদের যদি সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজন হয়, তা হলে সবথেকে বেকায়দায় পড়বে তৃণমূল৷ এর প্রভাব সবথেকে তাড়াতাড়ি দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা আসনগুলির ভোটে৷ এই রাজ্য থেকে যত বেশি সম্ভব লোকসভা আসনে জেতার স্বপ্ন তৃণমূলের অধরাই থেকে যাবে৷ এর সঙ্গে বাড়তি অস্বস্তি হলো, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি৷ কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় জনতার ঢলই শুধু নয়, কুশলী মোদী তাঁর বক্তৃতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একটি কথাও না বলে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, লোকসভার ভোট বিজেপিকেই দেওয়া উচিত, যারা একক শক্তিকে কেন্দ্রে সরকার গড়ার ক্ষমতা রাখে৷ আর কে না জানে, ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তনের জোয়ারে বিজেপি সমর্থকদের বড় অংশের ভোট গিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে!