আইএস ও তুরস্ক
২৮ জুলাই ২০১৫তুরস্কের বিমানবাহিনী সিরিয়ায় আইএস ও ইরাকের উত্তরে কুর্দি গোষ্ঠী পিকেকে-র ঘাঁটিতে যে হামলা চালিয়েছে, তাতে বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই৷ তবে এই ঘটনাকে ইসলামিক স্টেট সম্পর্কে সে দেশের এতকালের অবস্থানের কোনো মৌলিক পরিবর্তন হিসেবে দেখলে চলবে না৷
কারণ জিহাদি খিলাফতের সন্ত্রাসবাদীদের দমন করা এই বিমান হামলার মূল লক্ষ্য ছিল না৷ তুরস্কের সরকার বরং সিরিয়া সীমান্তে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দূর করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে৷ সে দেশের শীর্ষ নেতারা গত কয়েক দিনেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, সীমান্ত জুড়ে আইএস-এর উপস্থিতি যেমন মেনে নেওয়া হবে না, তেমন কুর্দিদের নিয়ন্ত্রণও তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়৷
তুরস্কের সিরিয়া নীতিতে সংশোধন
তুরস্ক তার বিফল সিরিয়া সংক্রান্ত নীতির নেতিবাচক পরিণতি সংশোধন করতেই বর্তমান পরিস্থিতি কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে৷ আইএস সন্ত্রাসবাদীদের বিপজ্জনক তৎপরতা তাদের এই সুযোগ করে দিয়েছে৷ তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভোতলু যে ‘জিরো প্রবলেম পলিসি' তুলে ধরেছেন, সিরিয়া তার কেন্দ্রস্থল জুড়ে রয়েছে৷ তিনি তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিকে আরও উন্মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন৷ এই বহুমুখী নীতির আওতায় তিনি সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যতটা সম্ভব সহযোগিতার পথে এগোতে চেয়েছিলেন৷ সিরিয়ার শাসক বাশার আল-আসাদের মতো আরব স্বৈরাচারী নেতার প্রতিও হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি৷
২০১১ সালের মার্চ মাসে সংখ্যাগুরু সুন্নিদের বিদ্রোহের ফলে আসাদ প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হলো৷ এর আগে অবশ্য তুরস্ক আসাদকে হিংসার পথ ছেড়ে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে আনার চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু আসাদ তৎকালীন শান্তিকামী বিরোধী গোষ্ঠীর উপর হিংসাত্মক হামলা চালাতে থাকায় তুরস্কের আক পার্টি নিয়ন্ত্রিত সরকার সিরিয়ার বিরোধীদের মদত দিতে শুরু করে৷ তবে আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার কোনো পথ না পেয়ে তুরস্ক হতাশ হয়ে পড়ে৷ এই অবস্থায় তারা আইএস-এর তৎপরতা কার্যত মেনে নিয়েছিল৷ তাই তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত পেরিয়ে অনেক আইএস যোদ্ধা অবাধে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পেরেছে৷ এটা সক্রিয় সমর্থন – নাকি দেখেও না দেখার নীতি ছিল, তা বলা কঠিন৷
প্রয়োজন বাস্তববাদী পথে উত্তেজনা প্রশমন
এবার তুরস্কই আইএস-এর খামখেয়ালি সন্ত্রাসের শিকার হয়ে পড়েছে৷ অন্তত এবার তুরস্কের নীতি-নির্ধারকদের এই প্রবণতার দায়িত্বের ভাগ স্বীকার করা উচিত৷ অবশ্য সিরিয়ার ট্র্যাজিডির দায় তুরস্কের একার নয়৷ আরব ও পশ্চিমা দেশগুলি, বিশেষ করে অ্যামেরিকার নিজেদের কৃতকার্য সম্পর্কে ভেবে দেখা উচিত৷ তাদের নিষ্ক্রিয়তার ফলেই আসাদ প্রশাসন নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর এক যুদ্ধ চালাতে পেরেছে৷
বর্তমানে সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, তুরস্কের সরকার অ্যামেরিকার সঙ্গে এক বোঝাপড়ায় এসেছে৷ আইএস-এর বিরুদ্ধে তুরস্কের আরও সক্রিয় ভূমিকার মূল্য হিসেবে ওয়াশিংটন আশ্বাস দিচ্ছে যে, রাষ্ট্র হিসেবে সিরিয়ার ভাঙনের প্রেক্ষাপটে কোনো অবস্থায় এক স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র মেনে নেওয়া হবে না৷ এছাড়া দুই দেশই নাকি সিরিয়ার উত্তরে এক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করার পরিকল্পনা নিচ্ছে, যেখানে প্রায় ২০ লক্ষ সিরীয় শরণার্থী আশ্রয় নিতে পারবে৷
এমন এক ‘বাফার জোন' সৃষ্টির ক্ষেত্রে তুরস্ককে আর্থিক ও কাঠামোগত সহায়তা দিলে ইউরোপের আখেরে লাভ হবে৷ তাছাড়া উত্তেজনা কমাতে তুরস্কের স্বার্থের বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে৷ অন্যদিকে তুরস্কের সমাজে গভীর বিভাজন দূর করতে অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রক্রিয়ায় পথে ফেরার উদ্যোগের প্রতি আরও সমর্থন দেখাতে হবে৷ ইউরোপের জন্য অপরিহার্য এই সহযোগী দেশ যাতে তিনটি ক্ষেত্রে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে, সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে৷