1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সম্মুখযুদ্ধের বীর সৈনিক যশোরের মমতাজ

৭ মে ২০১১

রাজাকাররাও রেহাই পায়নি তাঁদের হাত থেকে৷ মেয়েদের জন্য অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে মেয়েদের উৎসাহিত করেছেন তাঁরা৷ অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন পাক সেনাদের উপর৷

১৯৭১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগমছবি: Momtaz Begum

‘‘সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি ভারত থেকে অস্ত্র বহন করে আমরা দেশের মধ্যে পৌঁছে দিতাম৷ কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে নৌকায় করে অস্ত্র নিয়ে যেতাম৷ সারারাত ধরে নৌকায় অস্ত্র বহন করতাম৷ নৌকায় অনেক সময় সাপ উঠতো৷ সাপগুলোকে ছুরি দিয়ে কেটে ফেলতাম৷ একদিন অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছি এমন সময় পাঁচ-ছয় জন রাজাকার আমাদেরকে পথের মধ্যে অস্ত্রসহ ধরে ফেলে৷ আমরা তিন জন ছিলাম৷ দুই জন মেয়ে আর এক জন ছেলে৷ রাজাকাররা আমাদেরকে নিয়ে তাদের ঘাঁটিতে যাচ্ছিল৷ আমরা সারাক্ষণ ভাবছি কী করা যায়৷ ওরা সংখ্যায় বেশি৷ তার উপর ওরা তো বাঙালি৷ ফলে সাঁতারও জানে৷ এভাবে যেতে যেতে এক পর্যায়ে নদীর ঘাটে নৌকা ভিড়ল৷ এসময় সেখানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দলকে আমরা পেয়ে যাই৷ তারা দূরে থেকে দেখে আমাদেরকে চিনতে পেরে অনুসরণ করছিল৷ সুবিধামতো জায়গায় পৌঁছেই আমাদের ছেলেরা রাজাকারদের উপর হামলা করে৷ এসময় রাজাকারদের কাছে অস্ত্র থাকলেও তারা পাল্টা গুলি ছোঁড়ার সুযোগ করে উঠতে পারেনি৷ তারা হতভম্ব হয়ে পালানোর চেষ্টা করে৷ ঠিক এসময় আমি একজন রাজাকারের পাঞ্জাবি ধরে ফেলি৷ ফলে সে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়৷ তখন আমি তাকে এমন মার মেরেছিলাম যে আমি আর কখনই কাউকে এতোটা মারিনি৷ এরপর আমাদের ছেলেরাও এসে বেয়নেট দিয়ে তাকে মারতে মারতে সেখানেই মেরে ফেলে৷'' এভাবেই ডয়চে ভেলের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের সাহসী ভূমিকার কথা বললেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম৷

যশোর শহরে ১৯৫৩ সালের ২৫ আগস্ট জন্ম মমতাজ বেগমের৷ বাবা অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন এবং মা রওশন আরা বেগম৷ রাজনৈতিক ও সংগ্রামী পরিবারেই বেড়ে ওঠেন মমতাজ৷ তাঁর নানা পাকিস্তান আমলে সাংসদ ছিলেন৷ বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পরও আমৃত্যু সাংসদ হিসেবে সমাজসেবা করেছেন তিনি৷ এছাড়া মমতাজ বেগমের বাবা এবং নানা দু'জনই বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাথে জড়িত ছিলেন৷ ফলে সেই ছোট্টকাল থেকেই মিছিল-মিটিং'এ দুই ভাইয়ের সাথে হাজির থাকতেন মমতাজ৷ এমনকি স্কুলে পড়া অবস্থায় ১৯৬৫ সালের আন্দোলনেও সামনের সারিতে ছিলেন তিনি৷

বীর মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগমছবি: Momtaz Begum

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ এর নির্বাচনের সময়ও রাজপথে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন মমতাজ৷ এছাড়া নাচ-গানেও পটু ছিলেন তিনি৷ তাই আন্দোলন-সংগ্রামে বিপ্লবী সংগীত পরিবেশন করে জনতার মাঝে উদ্দীপনা-উৎসাহ জোগাতেন এই সাহসী প্রতিভা৷ এরপর মুক্তিযুদ্ধের আগে নিউক্লিয়াস নামে যে গোষ্ঠী তৈরি হয় সেখানেও সদস্য ছিলেন তিনি৷ ফলে যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই নিউক্লিয়াস এর সদস্য হিসেবে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ নেন মমতাজ৷ এসময় তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন৷

এই প্রশিক্ষণ করার সময়ই মার্চ মাসের ২ তারিখে আ স ম আব্দুর রবের পাঠানো স্বাধীন বাংলাদেশের নমুনা পতাকা পান৷ সেই নমুনা অনুসারে সারারাত জেগে স্থানীয় এক দর্জির বাসায় বসে গোপনে ২২ টি পতাকা তৈরি করেন৷ পরের দিন যশোর ঈদগাহ চত্বরে পতাকা উত্তোলন করা হয়৷ এরপর নতুন পতাকা নিয়ে মিছিল করছিলেন তাঁরা৷ সেই মিছিলে পাকিস্তানি সেনারা গুলি বর্ষণ করে৷ এসময় গুলিতে নিহত হন চারুবালা কর৷ তাঁর লাশ নিয়ে আবারো মিছিল করেন তাঁরা৷ এরপর ২৩ মার্চ যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে নতুন পতাকা উত্তোলন করেন৷ এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই বিডিআর-এর সাথে ভূগর্ভস্থ গোপন ঘর তথা ট্রেঞ্চ খুঁড়তেন মমতাজ এবং তাঁর সঙ্গীরা৷ ফলে রাজাকার এবং পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর কালো তালিকায় আগে থেকেই নাম ছিল মমতাজ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের৷

২৬ তারিখ শহরের বাড়ি ছেড়ে গ্রামে চলে যান তাঁরা৷ বাড়ি থেকে রওয়ানা দেওয়ার মাত্র কিছুক্ষণ পরেই এসে হাজির পাক সেনারা৷ কিন্তু বাড়িতে কাউকে না পেয়ে বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পাক সেনারা৷ যুদ্ধের সময় স্বামী হারানো বড় বোনের করুণ কাহিনী তুলে ধরেন মমতাজ৷ তিনি বলেন, ‘‘বড় বোন আমাদের বাসায় ছিলেন৷ তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন৷ তাঁকে সাথে নিয়েই আমরা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি৷ ২৫ মার্চ বেতন উঠানোর জন্য খুলনায় গিয়েছিলেন আমার দুলাভাই৷ কিন্তু আর ফিরে আসেননি৷ অথচ আমার বোন এখন পর্যন্ত তাঁর পথ চেয়ে আছেন৷ যুদ্ধের সময় আমার বোনের বয়স মাত্র ১৯ বছর ছিল৷ অথচ তিনি আর বিয়ে করতে রাজি হননি৷ তিনি শুধু বলেন, সে ফিরে আসবে এবং সে ফিরে আসলে তাকে কী জবাব দেবে তোমরা৷ এখন আমার বোন অসুস্থ এবং মৃতপ্রায়৷ অথচ এখনও তিনি বলেন, সে ফিরে আসবে৷''

গ্রামের বাড়ি থেকেই যশোর শহরে এসে এসে বিভিন্ন অপারেশনে যোগ দিতেন মমতাজ৷ যশোর জেলখানা ভেঙে কয়েদিদের বের করে এনে তাদের নিয়ে অপারেশন চালিয়েছেন৷ এরপর পরিস্থিতির শিকার হয়ে তিন দিন তিন রাত পায়ে হেঁটে বৃষ্টিতে ভিজে ভারত পাড়ি দেন মমতাজ৷ সেখানে ছেলেদের সাথে মেয়েদেরকে প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়নি৷ তাই মেয়েদের জন্য পৃথক প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে বিভিন্ন এলাকা এবং শরণার্থী শিবির ঘুরে ঘুরে আরো অনেকগুলো মেয়ে সংগ্রহ করেন মমতাজ এবং তাঁর অপর সহযোদ্ধা৷ এরপর মেয়েদের জন্য গোবরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়৷ সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে সশস্ত্র হয়ে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েন পাক সেনাদের উপর৷ পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখযুদ্ধ করেন৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সমাজ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম৷

প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই

সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ