একটার পর একটা দুর্নীতি অনিয়মের কেলেঙ্কারি ধরা পড়ছে বাংলাদেশে। আর এসব ঘটনার সাথে যারা জড়িত তারা সবাই অপকর্ম করছে রাজনৈতিক পরিচয়ে। দলগুলো তাদের পরিচয় অস্বীকার করলেও দায় কি এড়াতে পারে?
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে এই করোনাকালেও দুর্নীতি থেমে নাই। সর্বশেষ বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতালে সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি ভুয়া করোনা টেস্টের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। কয়েকজন কর্মচারীকে গ্রেপ্তার এবং হাসপাতালটি বন্ধ করে দিলেও ওই ঘটনার মূল হোতা মো. সাহেদ এখনো পলাতক। সাহেদের সাথে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, পদস্থ কর্মকর্তা এবং তারকা সাংবাদিকদের যেসব ছবি এই ঘটনার পর প্রকাশ হচ্ছে তাতে ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা। শুধু তাই নয়, তিনি টেলিভিশন টকশো'র পরিচিত মুখ। আর রিজেন্ট হাসপাতালের কোনো বৈধ লাইসেন্স নাই ২০১৩ সাল থেকে। তারপরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওই হাসপাতালের সাথে করোনা চিকিৎসার জন্য চুক্তি করেছিল। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শনিবার এক বিবৃতিতে বলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তারা চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল। শর্ত ছিলো হাসপাতালটি লাইসেন্স নবায়ন করবে, কিন্তু করেনি।
‘‘কয়েকদিন পর আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়’’
রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের সাথে অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ দুই জনের সঙ্গেই অন্তরঙ্গ ছবি প্রকাশ হয়েছে।
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির একজন সদস্য মো. সাহেদকে এখন আওয়ামী লীগও অস্বীকার করছে। কিন্তু এই পরিচয়েই তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। টিভি টকশোতে অংশ নিয়েছেন এই পরিচয়েই।
বুধবার আটক হয়েছেন জেকেজি নামে আরেকটি স্বাস্থসেবা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী। তিনি সাড়ে ১১ হাজার ভুয়া করোনা টেস্টের হোতা। এই ঘটনায় তার স্বামী এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরী অবশ্য আগেই আটক হন। কিন্তু পুলিশ সাবরিনাকে আটক করছিল না এত দিন। তার প্রধান কারণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সাথে সুসম্পর্ক। সাবরিনা শনিবার সংবাদ মাধ্যমকে এই সুসম্পর্কের কথা এবং ভুয়া টেস্টের কথা মহাপরিচালক যে জানতেন তা প্রকাশ করেন। এর একদিনের মাথায় তিনি আটক হলেন।
বাংলাদেশে এই সময়ে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি আরেকটি আলোচিত ঘটনা। গত ২০ সেটেম্বর ঠিকাদার জিকে শামিমকে আটকের মধ্য দিয়ে যার প্রকাশ শুরু হয়। এরপর জানা যায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের নাম। প্রকাশ পায় যুবলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর নাম। আর এই জিকে শামিম ও সম্রাটের ছবি প্রকাশ পায় শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে। সম্রাট-খালেদরা গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু ওমর ফারুক চৌধুরীদের পদ থেকে সরিয়ে দেয় হয়। এর উপরে আর আইনের হাত যায়নি।
ওয়েস্টিন হোটেল কেলেঙ্কারির যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া যুবলীগের প্রভাবেই সব অপকর্ম করেছেন। তাকে গ্রেপ্তারের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রী এমপিদের সাথে তার ঘনিষ্টতা ও ছবি প্রকাশ পায়। ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে আটকের পর তাকে যুব মহিলা লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। কিন্তু তার আগে তার কোনো অপকর্মের খবরই নাকি তার দলের নেতারা জানতেন না। তাকে আশ্রয় দেয়া নেতাদের গায়ে কোনো আঁচই লাগেনি।
ভালোমন্দের স্বাস্থ্যছবি
করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার একটি করুন চিত্র সামনে এসেছে৷ তবে স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশ কিছু বিষয়ে সাফল্যও দেখিয়েছে৷
ছবি: DW/H. Ur Radhid
জনবল ও অবকাঠামো সংকট
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, একটি দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে যতজন ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনলজিস্ট, অ্যানেস্থেটিস্ট থাকা আদর্শ সেটি বাংলাদেশে নেই৷ করোনার কারণে সেই সংকট প্রবলভাবে দেখা গেছে৷ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলছেন, একজন ডাক্তারের বিপরীতে নার্স থাকতে হয় তিন জন৷ কিন্তু বাংলাদেশে আছে আধা জন৷ এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা দিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবতো আছেই৷
ছবি: bdnews24.com
দুর্নীতি
দুর্নীতি দমন কমিশনের তৈরি এক প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করা হয়৷ বলা হয়, দুর্নীতি করার জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যা পরিচালনার লোক নেই৷ ওইসব যন্ত্রপাতি কখনোই ব্যবহার করা হয় না৷ প্রতিবেদনটি গতবছর জানুয়ারিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে তুলে দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: DW
বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে অক্ষমতা
করোনার কারণে সম্প্রতি পেশ করা বাজেটে গতবছরের চেয়ে এবার স্বাস্থ্যখাতে বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে৷ এবার প্রস্তাবিত ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা জিডিপির ১.৩ ভাগ৷ গতবছর তা ছিল মাত্র ০.৮৯ ভাগ৷ তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বরাদ্দ যেমন প্রয়োজনের তুলনায় কম তেমনি অতীতে দেখা গেছে, বরাদ্দ বাস্তবায়নের হারও কম৷ ফলে স্বাস্থ্যসেবা পেতে মানুষের ভোগান্তি কমছে না৷
ছবি: bdnews24.com/ M. Zaman Ovi
টিকাদানে সাফল্য
ছয়টি রোগের বিরুদ্ধে লড়তে ১৯৭৯ সালে ‘সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি’ কার্যক্রম শুরু হয়৷ বর্তমানে এটি ১০টি রোগের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়েছে৷ সারা দেশে বিনামূল্যে এসব টিকা দেয়া হয়৷ ২০১৮ সালে সব টিকাপ্রাপ্তির হার ছিল ৯৭.৬ শতাংশ৷ টিকাদান কর্মসূচিতে সফলতার জন্য গতবছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন’৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
শিশুমৃত্যুর হার কমেছে
জনস্বাস্থ্যবিষয়ক দেশের সবচেয়ে বড় জরিপ ‘বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ’ বা বিডিএইচএস৷ সবশেষ জরিপটি হয়েছে ২০১৭-১৮ সালে৷ এতে বলা হয়, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুহার সেই সময় ছিল প্রতি হাজারে ৪৫ জন৷ এই সংখ্যা ১৯৭৯ সালে ২০২ জন এবং ২০০৬ সালে ৬৫ জন ছিল বলে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট’-এর এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে৷
ছবি: Imago Images/Zuma/M. Hasan
গড় আয়ু বেড়েছে
গতবছর জুনে প্রকাশিত এক জরিপে ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’ বা বিবিএস জানায়, বাংলাদেশের মানুষের মোট গড় আয়ু এখন ৭২ বছর ৩ মাস৷ ১৯৬০ সালে গড় আয়ু ৪৬ বছর ছিল বলে ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
জন্মনিয়ন্ত্রণে সাফল্য
বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে নারীদের সন্তান জন্মদানের হার ১৯৭১ সালে ছয় দশমিক নয় থেকে ২০১৭ সালে দুই দশমিক শূন্য ছয়ে নেমে এসেছে৷ এই হার প্রায় ইউরোপের সমান উল্লেখ করে জন্মনিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ আফ্রিকার জন্য রোল মডেল হতে পারে বলে গতবছর মন্তব্য করেছিলেন জার্মান উন্নয়নমন্ত্রী গ্যার্ড ম্যুলার৷
ছবি: picture-alliance/AP
খরচ বাড়ছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যের পেছনে ১০০ টাকা খরচ হলে সরকারি সহায়তা পাওয়া যায় ২৮ টাকা এবং বাকি ৭২ টাকা রোগীকে বহন করতে হয়৷ ২০১২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০১২-২০৩২ সাল মেয়াদি একটি কৌশলপত্র তৈরি করেছিল৷ সেখানে ব্যক্তিগত খরচ ৩২ টাকায় (তখন ছিল ৬৪ টাকা) নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ৬৪ থেকে ৩২-এ নামার লক্ষ্য থাকলেও উলটো সেটি বেড়ে ৭২ টাকা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা এখনও নেই
সরকার স্বাস্থ্য বিমা চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে গতবছর ১৯ জুন সংসদকে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ এর অংশ হিসেবে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর, ঘাটাইল ও কালিহাতি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে স্বাস্থ্য বিমা কার্যক্রম চলছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: DW
বেশিরভাগ রোগী এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে যান না
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০১৯ সালের জুনে৷ এতে দেখা গেছে, ৫৮ শতাংশ রোগী ওষুধের দোকানদার, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, হাকিম-কবিরাজ, ওঝা, পীর, বৈদ্যসহ অন্যদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেন৷ ১৬ শতাংশ যান সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে৷ বাকি ২৬ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসা নেন৷
ছবি: DW/H. Ur Radhid
10 ছবি1 | 10
এইসব প্রতারক এবং দুর্বৃত্তরা সাপের মত খোলস বদলায় বলে মনে করেন দুর্নীতি দমনের কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। তাদের অপকর্ম করতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল প্রয়োজন হয়। কারণ বাংলাদেশে একটি ধারণা আছে ক্ষমতার সাথে যুক্ত থাকলে দুর্নীতি ও প্রতারণা সহজ হয়।
তিনি বলেন,‘‘ রাজনৈকি দলের কিছু নেতা টাকা পায়সার বিনিময়ে তাদের আবার দলে আশ্রয় দেয়। তাই এইসব প্রতারকদের সাথে যাদের ছবি প্রকাশ হয়েছে, যাদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে দেখা গেছে। তাদের বিষয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কারুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত।” তার মতে, এখন তো আর বহিরাগত বলে দায় এড়ানো যাবে না।
দুর্নীতি শেকড় গেড়ে বসা এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রাহমান কার্জন। তার মতে প্রশাসনিক দুর্নীতি কোন সরকার ক্ষমতায় তার ওপর নির্ভর করে না। এটা সব সময়ই হয়। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে যারা ক্ষমতায় থাকে তারা দুর্নীতি করতে প্রশাসনিক সুবিধা পায়। তাই প্রতারক এবং দুর্নীতিবাজরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পরিচয় কেনে অথবা সরসরি যুক্ত থাকে। তিনি বলেন, ‘‘ধরা পড়ার পর রাজনৈতিক দল তাদের অস্বীকার করে বা বহিস্কার করে। কিন্তু তাতে কিছুই হয় না। কয়েকদিন পর আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।’’
এই দুইজন বিশ্লেষকই মনে করেন, দলে পরীক্ষিত লোকদের গুরুত্ব থাকা উচিত। হাইব্রিড বা বহিরাগতরা অর্থের বিনিময়ে পদ পদবী নিলে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তবে সার্বিক দুর্নীতির যে চিত্র তা দূর করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দক্ষ করতে হবে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।