ধুলায় মলিন রবীন্দ্রনাথ!
২১ মার্চ ২০১৪আত্মবিস্মৃত বাঙালি৷ নিজের ইতিহাস, নিজের ঐতিহ্য আর গর্বকে তারা যথাযোগ্য মর্যাদায় রক্ষণাবেক্ষণ করতে জানে না৷ নয়ত কালিম্পংয়ের ঐতিহাসিক গৌরীপুর হাউস আজ পোড়ো বাড়ির চেহারা নিত না! এবং সে নিয়ে কারও কোনো দায় নেই, দায়িত্বও নেই৷ গৌরীপুর হাউসের যাঁরা মালিক, কলকাতার সেই রায়চৌধুরী পরিবার কিন্তু বহুবার জানিয়েছেন, আজকের দিনে কালিম্পংয়ের মতো জায়গায় প্রায় প্রাসাদতুল্য ওই দোতলা বাংলো বাড়ির সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে তাঁরা অপারগ৷ সরকার যদি চায়, অথবা অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যদি আগ্রহী থাকে গৌরীপুর হাউসকে একটি রবীন্দ্র সংগ্রহশালায় পরিণত করতে, তা হলে তাঁরা সাগ্রহে রাজি আছেন৷ অথবা বাড়িটি একটি হেরিটেজ হোটেলেও রূপান্তরিত করা যায়৷ তা হলেও অন্তত রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত ইমারতটি রক্ষা পায়!
কিন্তু কিছুই হয়নি৷ বিশাল এলাকাজুড়ে বাগান এবং তার গাছগাছালির মাঝে অপরূপ বাড়িটিকে দূর থেকে পুরো ভূতের বাড়ির মতো মনে হয়৷ পিচ বাঁধানো পাকা রাস্তা থেকে গৌরিপুর হাউস পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তাটিও এবড়োখেবড়ো, রাশি রাশি শুকনো পাতায় ঢাকা৷ চতুর্দিকে এমন আগাছা যে দিনের বেলাতেও সে রাস্তায় হাঁটতে গা ছমছম করে৷ আর বাড়ির সামনে পৌঁছে তার চেহারা দেখলে চোখে জল আসার উপক্রম হয়৷ সদর দরজা বন্ধ কিন্তু বাড়ির প্রায় সব জানালা হয় ভাঙা, নয় দুহাট করে খোলা৷ তার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি মারলে দেখা যায় একেবারে বেবাক খালি, আসবাবহীন, ধুলোয় ঢাকা ঘর৷ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কোনো সামগ্রী, কোনো আসবাবপত্র সেখানে থাকার স্রেফ কোনো সম্ভাবনাই নেই!
ইতিহাসের নির্মম রসিকতাই বলতে হবে, গৌরীপুর হাউসের গায়ে এক খণ্ড মর্মর ফলকে বলা আছে – ‘‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে জন্মদিন কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন৷'' অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৮০তম জন্মদিন কাটিয়েছিলেন এই বাড়িতে! এবং তথ্য বলছে, নিজের লেখা জন্মদিন কবিতাটি তিনি টেলিফোনে আবৃত্তি করেছিলেন, যা সরাসরি সম্প্রচার করে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কলকাতা দপ্তর ‘‘আকাশবাণী''৷ কালিম্পংয়ের সঙ্গে কলকাতার টেলিফোন যোগাযোগেরও নাকি সূচনা হয়েছিল সেই সঙ্গে৷ সেই ইতিহাস, সেই গুরুত্ব স্বীকৃতি পেয়েছে ধূলামলিন এক মর্মর ফলকে৷ দায়িত্ববোধের সেখানেই ইতি৷
প্রায় একই অবস্থা হতো কালিম্পংয়ের অদূরে মংপুতে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য বাড়িটির, যদি না দু'জন মানুষ থাকতেন৷ প্রথমজন হলেন মংপুর শতাব্দীপ্রাচীন সিঙ্কোনা কারখানার এক কর্মী শিশির রাউথ, যিনি প্রায় স্বেচ্ছায় বাড়িটির দেখভাল এবং পাহারার দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন৷ যিনি স্রেফ রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং আত্মীয়তা থেকে একা হাতে আগলে রেখেছেন এখনও সযত্নে রক্ষিত যাবতীয় রবীন্দ্রস্মৃতি৷
রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠজন অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কন্যা মৈত্রেয়ী দেবী থাকতেন মংপুর এই বাংলো বাড়িতে৷ তাঁর স্বামী মনমোহন সেন ছিলেন মংপুর সিঙ্কোনা কারখানার প্রধান ‘কেমিস্ট'৷ রবীন্দ্রনাথের একান্ত অনুরক্ত এবং গুণগ্রাহী মৈত্রেয়ী দেবীর অনুরোধেই রবীন্দ্রনাথ মংপুর এই বাড়িতে থাকতে আসেন৷ ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চার বার, প্রতিবার অন্তত মাস দেড়েক-দুয়েকের জন্য রবীন্দ্রনাথ এসে এখানে থাকতেন৷ এখানে তিনি বহু কবিতা-গান লিখেছেন৷ তাঁর বহু স্মৃতি আছে এই বাড়িতে, যা মৈত্রেয়ী দেবী লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ'' বইতে৷ এছাড়া আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত শোওয়ার খাট, লেখার ডেস্ক, রংয়ের প্যালেট, বায়োকেমিক ওযুধের শিশি এবং দুষ্প্রাপ্য বহু ছবি৷ শিশির রাউথ প্রায় একক চেষ্টায় সযত্নে গুছিয়ে রেখেছেন সব, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছবিগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ তাদের পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর উদ্যোগী হয়েছিলেন মংপুর এই ঐতিহাসিক বাংলো বাড়িটি সংস্কারের৷ তাঁর নির্দেশেই বাড়িটির মেরামতি এবং নতুন রং হয়েছিল, বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরে এসেছিল৷ এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্ভুল বুঝেছিলেন যে এই বাড়িটি যদি ফের ব্যবহারযোগ্য করে না তোলা যায়, তা হলে আবার এটি জীর্ণ হয়ে পড়বে৷ তিনিই সেই দ্বিতীয় মানুষ, যিনি রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য বাড়িটির রক্ষায় আন্তরিকতা দেখিয়েছেন৷ বছর তিনেক আগে কথা হয়েছিল, রবীন্দ্র গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে বাড়িটিকে৷ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীরই পরামর্শ ছিল সেটা৷ কিন্তু যথারীতি সরকারি দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে গিয়েছে সেই সদিচ্ছা৷