ভারতে সমকামিতা এখন অবৈধ৷ কারণ গত বছরই সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতা বৈধ আইনের বিপক্ষে রায় দেয়৷ চলচ্চিত্র পরিচালক সোনালি বোস এবার ‘মার্গারিটা, উইথ আ স্ট্র’ ছবিতে তুলে ধরেছেন উভকামিতা বা বাইসেক্সুয়ালিটি৷
বিজ্ঞাপন
সমকামিতা সাধারণত ভারতীয় নাগরিক সমাজ ও সরকারের কাছে একটি নিষিদ্ধ বিষয়৷ ভারতে সমকামিতা নিয়ে সাধারণ আলোচনার সুযোগ কম৷ যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সমকামিতার প্রতি ভারতীয়দের মনোভাবে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ বিশেষত, ভারতের সংবাদমাধ্যম এবং বলিউডেও সমকামিতার প্রদর্শন ও আলোচনার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে৷
সোনালি বোসের বিশ্বাস, তাঁর পরিচালিত নতুন ছবি ‘মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র' ভারতীয় সমাজের চিরায়ত মনোভাবে কিছুটা প্রভাব ফেলবে৷ চলচ্চিত্রটিতে সমকামিতা ও উভকামিতা বিষয়টি ভালোভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে৷
সেপ্টেম্বর মাসে টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে এই মুভিটি প্রদর্শন হয়৷ ছবিটির কাহিনি ‘সেরিব্রাল পলসি'-তে আক্রান্ত এক কিশোরীর গল্প নিয়ে৷ মেয়েটি তার নিজের যৌনতার বিষয়টি নিয়ে দ্বিধান্বিত৷ এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল পরিবারের একটি মেয়ের ক্ষেত্রে যা হয়, সেটাই পরিচালক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন৷
পরিচালক সোনালি বোস যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন এবং নিজেকে ‘বাইসেক্সুয়াল' বা উভকামী হিসেবে উল্লেখ করেছেন৷ তিনি জানান, এই মুভি পরিকল্পনার কাজটি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই এসেছে৷ এসেছে নিজের ‘সেক্সুয়ালিটি'-র প্রসঙ্গ এবং তাঁর এক আত্মীয়ের কথা, যাঁর সেরিব্রাল পলসি আছে৷
৪৯ বছরের সোনালি বিশ্বাস করেন, তাঁর মুভিতে এমন কিছু বিষয় উঠে এসেছে যা ৩৭৭ ধারা নিয়ে বিতর্ককে উসকে দেবে৷ সুপ্রিম কোর্টের সমকামিতাবিরোধী রায়ে বলা হয়েছে যে, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার রক্ষা নীতির পরিপন্থি৷
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাথে টেলিফোন সাক্ষাৎকারে সোনালি জানান, তিনি জানেন যে মুভিটি মুক্তির পর কট্টরপন্থিদের রোষের মুখে পড়বেন৷ তবে মানুষ যখন ছবিটি দেখবে, আলোচনা করবে এবং তাঁকে প্রশ্ন করবে – তার জন্য প্রস্তুত তো বটেই, উৎসুকও তিনি৷
ইউরোপে সমকামীদের অধিকার
সমকামীদের বিয়ে এবং সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের৷ ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ তবে পূর্ব ইউরোপের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ বিস্তারিত দেখুন এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফ্রান্স
সমকামীদের বিয়ে এবং সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার দিতে সরকারি পরিকল্পনার সমর্থনে গত রবিবার প্যারিসে হাজির হন লাখো মানুষ৷ কিছুদিন আগে অবশ্য সেখানে সমকামীদের বিয়ের বিপক্ষে লাখো মানুষ সমবেত হয়৷ এই ইস্যু নিয়ে বেশ উত্তপ্ত সেদেশ৷ বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চ এবং ডানপন্থি বিরোধী দল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলঁদকে এই আইন করা থেকে বিরত রাখতে চাইছে৷
ছবি: Reuters
নেদারল্যান্ডস
ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের পরিস্থিতি মিশ্র৷ নেদারল্যান্ডস হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম দেশ যেখানে সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বৈধ ঘোষণা করা হয়৷ ২০০১ সালের এপ্রিল থেকে সেদেশে এই আইন কার্যকর আছে৷
ছবি: AP
বেলজিয়াম
২০০৩ সালের জুন মাসে নেদারল্যান্ডসের প্রতিবেশী দেশ বেলজিয়ামে সমলিঙ্গের মধ্যে বিবাহ বৈধ করা হয়৷ প্রথম দিকে সেদেশে বিদেশিদের মধ্যে এ ধরনের বিবাহে খানিকটা জটিলতা ছিল৷ কিন্তু ২০০৪ সালের অক্টোবর থেকে সকল দেশের নাগরিকদের এই সুবিধা দেওয়া হয়৷ এক্ষেত্রে যে কোনো একজনকে কমপক্ষে তিন মাস বেলজিয়ামে থাকতে হবে৷ ২০০৬ সাল থেকে সমকামী পুরুষ এবং নারীকে সন্তান দত্তক নেওয়ার সুবিধাও প্রদান করা হয় বেলজিয়ামে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্পেন এবং পর্তুগাল
খোসে লুইস রোদ্রিগেজ সাপাতেরো-র সমাজতন্ত্রী সরকারের মেয়াদকালে পৃথিবীর তৃতীয় দেশ হিসেবে স্পেন সমকামীদের মধ্যে বিয়ে বৈধ করে৷ ফ্রান্সের মতো সেদেশেও ক্যাথলিকদের শক্ত অবস্থান রয়েছে৷ তা সত্ত্বেও ২০০৫ সালের জুলাই মাসে স্পেনে এ ধরনের বিয়ে বৈধ করা হয়৷ ২০১০ সাল থেকে পর্তুগালও একই পথের পথিক হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আইসল্যান্ড
আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইওয়াহানা সিগুরডোটির এবং তাঁর সঙ্গিনী ইওহিনা লিওসডোটির সমকামীদের বিয়ে বৈধ ঘোষণার পর প্রথমেই সেই সুযোগ নিয়েছেন৷ সিগুরডোটির হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম মেয়ে সমকামী রাষ্ট্রপ্রধান৷ ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি৷ এরপর ২০১০ সালে সেদেশে সমকামীদের বিয়ে বৈধ করা হলে সঙ্গিনী লিওসডোটিরকে বিয়ে করেন সিগুরডোটির৷
ছবি: Getty Images
স্ক্যান্ডিনেভিয়া
সমকামীদের অধিকারের বিষয়ে আইনিভাবেই সচেতন স্ক্যান্ডিনেভিয়া৷ সুইডেনে ২০০৯ সালে সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বৈধ করা হয়৷ পুরুষ এবং নারী সমকামী যুগল সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে সেদেশে কোনো বাধা নেই৷ নরওয়ে ২০০৮ সালে এ সংক্রান্ত এক বিল অনুমোদন করেছে৷ ২০১২ সালের গ্রীষ্ম থেকে ডেনমার্কেও সমকামীদের বিয়ে বৈধ করা হয়েছে৷ ফিনল্যান্ডও এ ধরনের বিয়েকে বৈধতা প্রদানের পথে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুক্তরাজ্য
এই ছবিটি গত শতকের ৮০-র দশকের৷ এতে দেখা যাচ্ছে, সমকামীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করছেন একদল মানুষ৷ এরপর অনেকদিন পেরিয়েছে৷ যুক্তরাজ্যে সমলিঙ্গের পুরুষ বা নারী যুগল সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি রয়েছে৷ ২০০৫ সাল থেকে রয়েছে এই প্রথা৷ তবে চার্চে সমলিঙ্গের নারী বা পুরুষ বিয়ে করতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জার্মানি
২০০১ সাল থেকে সমলিঙ্গের যুগলের রেজিস্ট্রেশন বৈধ করেছে জার্মানি৷ এই প্রক্রিয়ায় জার্মানিতে বিয়ের সুযোগ সুবিধার অনেকটাই পান সমকামীরা৷ কিন্তু যৌথভাবে সন্তান দত্তক নেওয়া কিংবা পূর্ণ আয়কর সুবিধা এখনো পায়না সমকামী দম্পতিরা৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, জার্মানির ৬৬ শতাংশ জনসাধারণই সমকামীদের বিয়ের পক্ষে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পূর্ব ইউরোপ
তবে ইউরোপের পর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ সেখানকার সমাজে সমকামী নারী বা পুরুষকে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়না৷ লিথুনিয়া, পোল্যান্ডের মতো লাটভিয়াতেও বিষমকামী দম্পতির মতো সমান অধিকার পায় না সমকামী দম্পতি৷ পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ জনগণই সমকামীদের বিয়ের বিপক্ষে৷
ছবি: Reuters
রাশিয়া
রাশিয়ার সংসদ সম্প্রতি শিশুদের মাঝে ‘সমকামীদের প্রচারণা’ নিষিদ্ধ করেছে৷ আর আগেই অবশ্য সেন্ট পিটার্সবুর্গের (ছবিতে) মতো বিভিন্ন শহরে সমকামিতাকে উৎসাহ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ নতুন এই আইনের ফলে সমকামীদের অধিকার বিষয়ক প্রচারণা রাশিয়ায় অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং আয়োজকদের জরিমানা হবে৷ বলাবাহুল্য, রাশিয়াতে সমকামীদের বিয়ে বৈধ নয়৷
ছবি: Dmitry Lovetsky/AP/dapd
10 ছবি1 | 10
‘মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র' ছবিতে দেখানো হয়েছে লায়লা নামের একটি মেয়েকে, যে সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হয়েও অন্য এক নারীর প্রেমে পড়ে৷ তার প্রেমে পড়ার ঘটনাটিকে নানা দিক থেকে ছবিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন সোনালি৷
সোনালি এই মুভির চিত্রনাট্য নিয়ে গত দুই বছর চিন্তা-ভাবনা করেছেন৷ তিনি জানান, ‘‘ছবিতে মেয়েটির মা লায়লার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন – এমনটা দেখানো হয়েছে৷ টরন্টো ফেস্টিভালে সিনেমাটি দেখার পর অনেক ভারতীয় আমার কাছে এসে ছবিটির প্রশংসা করেছেন৷ আমি জানি তাদের চিন্তায় এটা আঘাত করতে পেরেছে৷''
আগামী বছরের প্রথমেই ভারতে মুক্তি পাবে ছবিটি৷ সোনালি জানান, এর আগে সমকামিতা নিয়ে যেসব বা যে ধরণের চলচ্চিত্র ভারতে মুক্তি পেয়েছে, তার সবগুলোই রোষের মুখে পড়েছে, বিক্ষোভ হয়েছে এবং পরে সেগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
ছবিটিতে লায়লার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কালকি কোচলিন৷ তিনি বলেন, ‘‘ছবিটিতে সমকামিতা নয় বরং বাইসেক্সুয়ালিটি বা উভকামিতা দেখানো হয়েছে৷ এখন এ নিয়ে কোনো বিক্ষোভ হবে কিনা, তা আমার জানা নেই৷ তবে এ নিয়ে কারো যদি প্রশ্ন থাকে তবে আমরা তাঁদের সাথে কথা বলতে আগ্রহী৷''
পরিচালক জানান, মুভিটি করার জন্য কারো সহায়তা পাননি তিনি৷ তাই ব্যাংক ঋণ নিয়ে নিজের পকেট খালি করে সিনেমাটি বানিয়েছেন৷ তবে এর জন্য কোনো আক্ষেপ নেই তাঁর৷ তিনি এখন ভারতে মুভিটি মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনছেন৷ ''