বাংলাদেশের উত্তরে পঞ্চগড় জেলায় এক হিন্দু ধর্মগুরুকে হত্যা করা হয়েছে৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা নাকোচ করে দেয়া হয়৷ এদিকে গবেষকরা বলছেন, ‘আইএস যে জড়িত নয়, তা প্রমাণ করা কঠিন'৷
বিজ্ঞাপন
রবিবার সকালে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে সন্তগৌরীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে (৫০) গলা কেটে হত্যা করা হয়৷ গৃহত্যাগী এই ধর্মগুরুকে হিন্দু ভক্তরা মহারাজ বলে সম্বোধন করতেন৷ হত্যার পর প্রতিরোধের মুখে পড়ে দুবৃত্তরা গুলি করলে মঠের এক নারীসহ আরো দু'জন গুরুতর আহত হন৷ শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, পুলিশ এরমধ্যে তিনজনকে আটক করেছে৷ এদের মধ্যে দু'জন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি-র সদস্য এবং অন্যজন ইসলামি ছাত্র শিবিরের স্থানীয় নেতা৷
নূর খান
জানা গেছে, হামলাকারীরা হামলার সময় ‘কতল' শব্দটি ব্যবহার করে৷ প্রতিরোধ করতে মঠের একজন এগিয়ে গেলে হামলাকারীরা পিস্তুল উঁচিয়ে বলে, ‘‘তোর গুরুজিকে কতল করা হয়েছে, ঐ ঘরে যাবি তো তোকেও কতল করব৷''
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মোট তিনজন হামলাকারী ছিল এবং তারা এসেছিল মোটর সাইকেলে৷ রংপুরে গত বছর জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যা, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা এবং ঢাকার আশুলিয়ায় তল্লাশি চৌকিতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডেও তিনজন মোটর সাইকেল আরোহী অংশ নেয়৷
এ সব ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু, ভিন্ন ধর্মীয় মানুষ এবং স্থাপনায় হামলা ও হত্যার ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে৷ দু'জন বিদেশি নাগরিককে হত্যা ছাড়াও ২৩ অক্টোবর পুরনো ঢাকার হোসেনি দালানে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলায় দু'জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হন৷ ১৮ নভম্বের র্দুবৃত্তরা দিনাজপুরে খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ডা. পিয়ারো পারোলারি সামিওকে হত্যার চেষ্টা করে৷ ২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মুসলমানদের একটি মসজিদে ঢুকে নামাজরতদের উপর গুলি চালানো হলে মুয়াজ্জিন নিহত এবং তিনজন আহত হন৷ ১০ ডিসেম্বর রাতে দিনাজপুরে কাহারোল উপজেলার জয়নন্দ গ্রামে ইসকন মন্দিরে ধর্মসভা চলাকালে গুলি ও বোমা বিস্ফোরণে দু'জন আহত হন৷ ২৫ ডিসেম্বর ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর দিন রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত হন৷
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক এবং জঙ্গি বিষয়ক গবেষক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হত্যা এবং হামলার ধরনই বলে দেয় যে তারা দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়৷ আমার মনে হয়, এরা বড় ধরনের কোনো হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যার আগে এগুলো তাদের ড্রেস রিহার্সল৷''
তিনি বলেন, ‘‘হামলাকারীরা যে জঙ্গি তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ তবে তারা যে আইএস নয়, তা প্রমাণ করা কঠিন৷ বাংলাদেশে আইএস ভাবাদর্শের জঙ্গি আছে৷ তারা ধরাও পড়েছে৷ সরকার অবশ্য রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে আইএস-এর বিষয়টি স্বীকার করতে চাইছে না৷''
নূর খানের কথায়, ‘‘কোনো কিছু গোপন করে সমাধান হয় না৷ রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা না করে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করে সরকারকে এইসব জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে৷''