‘সুন্দরবন বাঁচাও' – এই দাবিতে আধাবেলার হরতাল ডেকেছিল তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি৷ কিন্তু হরতাল চলাকালে পুলিশি হামলা হলে, তার প্রতিবাদে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন সংগঠনের সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ৷
বিজ্ঞাপন
সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে পূর্ব ঘোষিত এই হরতাল কর্মসূচি পালন করা হয় বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত৷ হরতাল চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশেপাশের এলাকা, শাহবাগ, আজিমপুরে সকাল থেকেই হরতালের সমর্থকরা অবস্থান নেন৷ যান চলাচলে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন কেউ কেউ৷ হরতালের সমর্থনে বেশ কয়েকটি স্থানে মিছিলও করতে দেখা যায়৷ তবে এ সমস্ত এলাকাতে আগে থেকেই অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল৷
হরতালকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে শাহবাগে জলকামান ও টিয়ারশেল ব্যবহার করে পুলিশ৷ এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের বেশ কিছু নেতাকর্মী আহত হন৷ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ সকাল থেকেই হরতাল সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করতে দফায় দফায় টিয়ার গ্যাস ছোড়ে এবং জলকামান ব্যবহার করে৷
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
এদিকে হরতাল চলাকালে শাহবাগ থানার সামনে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের ক্যামেরাম্যান আব্দুল আলীম ও রিপোর্টার এহসান বিন দিদারকে মারধর করে পুলিশ৷ পরে অবশ্য এর জন্য দায়ী শাহবাগ থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক এরশাদকে সাসপেন্ড করা হয়৷
পল্টন, প্রেসক্লাব ও শাহবাগ এলকাতেই হরতাল সমর্থকদের তৎপরতা বেশি ছিল৷ তাই প্রেসক্লাব ও শাহবাগ এলকায় যানবাহন চলাচল ছিল বন্ধ৷
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘‘সরকারের নৈতিক পরাজয় হয়েছে৷ তাই তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশি হামলা চালিয়েছে৷ আটক করেছে অন্তত ১৫ জনকে৷ এখনো শাহবাগ থানায় পাঁচজনকে আটক রাখা হয়েছে৷''
তিনি জানান, ‘‘আমরা আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখবো৷ সরকার কোনোভাবেই জনদাবি উপেক্ষা করতে পারবে না৷ সরকারকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে আসতেই হবে৷ আমরা আট বছর ধরে আন্দোলন করে আসছি৷ যুক্তি-তর্ক এবং তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সরকারকে সে কথা বলেছে৷ কিন্তু তারপরও সরকার গোঁয়ারতুমি করছে৷''
সুন্দরবনের পাশে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবিতেই ‘সুন্দরবন বাঁচাও' নামে এই হরতাল কর্মসূচি পালন করা হয়৷ বিএনপি, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, ছাত্রদলসহ কয়েকটি সংগঠন বিবৃতি দিয়ে এই হরতালে সমর্থন জানায়৷
বন্ধু, এ বিষয়ে আপনার কি কিছু বলার আছে? তাহলে লিখুন নীচের ঘরে৷
সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া
বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকার, বিশেষ করে গরিবদের তো আরো বেশি দরকার৷ তারপরও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা হবে মর্মান্তিক৷ একদিকে দেশের-দশের প্রয়োজন, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্জয়ের ভয়৷ কী বলছে দেশের মানুষ?
ছবি: picture-alliance/dpa/Pacific Press/M. Hasan
মোশাহিদা সুলতানা, শিক্ষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতুর মতে, সুন্দরবনের পাশে এত বড় একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ তাঁর মতে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আছে৷
ছবি: DW
সায়েম ইউ চৌধুরী, পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষক
৪০ বারেরও বেশি সুন্দরবনে গেছেন সায়েম৷ তিনি জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ পুকুরের মাছ, গাছপালা, প্রাণী – সব মারা পড়ে৷ এ রকম ছোট একটা সার কারখানার দুর্ঘটনা থেকে আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার সক্ষমতা যেখানে নেই, সেখানে এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা হলে আমাদের সরকার কী-ই বা করার থাকবে?
ছবি: DW
মারুফ বিল্লাহ, স্থানীয় বাসিন্দা
মারুফ বিল্লাহর জন্ম রামপালেই৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি সুন্দরবনকে ধ্বংস হতে দেখে আসছেন৷ আর এখন সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ধ্বংসের আরেক পায়তারা করছে সরকার৷ তিনি জানান, সিডর আর আইলার পরে আমরা দেখেছি ঐ জনপদকে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছিল সুন্দরবন৷ এখন যদি আমরাই তাকে মেরে ফেলি, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? তাই তাঁর প্রশ্ন, জীবন আগে, নাকি বিদ্যুৎ আগে?
ছবি: DW
সাইমুম জাহান হিয়া, শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমুম জাহান হিয়া মনে করেন, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন৷ এর পাশে বিশাল আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে যে কখনো কোনো দুর্ঘটনা হবে না – এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে, এটা ঠিক, তবে সেটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়৷
ছবি: DW
হাসিব মোহাম্মদ, শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব মোহাম্মদ কয়েকবার সুন্দরবনে গেছেন৷ আসলে এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র তাঁকে সবসময় টানে৷ তাই এ বনের কোনোরকম ক্ষতি করে তিনি এর কাছাকাছি রামপালের মতো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না৷ গত বছরের কয়েকটি ছোট ছোট জাহাজ সুন্দরবনে ডোবার পর যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বেড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাও বাড়বে৷
ছবি: DW
মিমু দাস, শিক্ষার্থী
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মিমু দাসও মনে করেন, সুন্দরবনের এত কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা ঠিক হবে না৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করবে৷ মিমু বিদ্যুৎকেন্দ্র চান, তবে সেটা অন্য কোথাও৷
ছবি: DW
আদনান আজাদ আসিফ, মডেল ও অভিনেতা
মডেল ও অভিনেতা আদনান আজাদ আসিফ একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারও৷ কয়েক বছর ধরে সময় পেলেই তিনি সুন্দরবনে ছুটে যান৷ বিশ্বের সবেচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল৷ তাঁর মতে, সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস৷ আর এমনিতেই নানা কারণে এখানে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে৷ তাই এর কাছাকাছি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো প্রকল্প করে এ বনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না৷
ছবি: DW
আমিনুর রহমান, চাকুরিজীবী
ঢাকার একটি পরিবহন সংস্থায় কাজ করেন আমিনুর রহমান৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার৷ তাই বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে দেশের জন্য ভালোই হবে৷ তাছাড়া তিনি শুনেছেন যে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিই করবে না৷
ছবি: DW
আব্দুল আজীজ ঢালী, মধু চাষি
সুন্দরবনে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধু আহরণ করেন সাতক্ষীরার আব্দুল আজীজ ঢালী৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বনের সঙ্গে থাকতে চান তিনি৷ সুন্দরবনে থাকলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না আব্দুল আজীজ৷
ছবি: DW
ভবেন বিশ্বাস, মাছ শিকারি
ভবেন বিশ্বাসের জীবিকার অন্যতম উৎস সুন্দরবন৷ উদবিড়াল দিয়ে এ বনে তিনি মাছ ধরেন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ তাঁর বাবা ও ঠাকুরদাদার এ পেশা এখনো তিনি ধরে রেখেছেন৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এ খবর তিনি শুনে থাকলেও, এর ভালো বা খারাপের দিকগুলো – কিছুই জানা নেই তাঁর৷ তবে সুন্দরবনকে তিনি ভালোবাসেন, খুব ভালোবাসেন৷