1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
দুর্নীতিবাংলাদেশ

‘সরকারগুলো বলে, সারা বছর দুর্নীতি করো, বছর শেষে বৈধতা দেবো’

শহীদুল ইসলাম
১৩ জুন ২০২৫

আওয়ামী লীগ সরকার এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ের দুর্নীতি ও দুর্নীতি রোধের উদ্যোগ নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান৷

অর্থ লেনদেনের প্রতীকী চিত্র
ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, একটি সরকার দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয়ে যাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তা প্রত্যাশা করাটা খুবই কঠিনছবি: Dreamstime/Imago

ডয়চে ভেলে: শেখ হাসিনা সরকার উন্নয়নের বয়ানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অন্তত ২৮ রকম উপায়ে দুর্নীতি করেছে বলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এই কমিটি বলেছে, অবারিত দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে একটি চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রতিবছর পাচার করা অর্থের পরিমাণ ছিল গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার। সরকার চাইলে কি এসব অর্থ পাচার ঠেকাতে পারতো?

ড. ইফতেখারুজ্জামান: সরকার চাইলে তো অবশ্যই ঠেকাতে পারতো। ঠেকাবার জন্য যে আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকার কথা, সেটি বাংলাদেশে আছে, কিন্তু প্রয়োগ হয়নি। বরং আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে অকার্যকর করে দিয়ে সেগুলোকে দুর্নীতি সহায়ক একটি জায়গায় নিয়ে অর্থ পাচার, কর ফাঁকি, বড় ধরনের দুর্নীতি করতে ব্যবহার করা হয়েছে। ক্ষমতা অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎকে এক ধরনের স্বাভাবিকতায় রূপান্তর করা হয়েছে, বিচারহীনতা দেওয়া হয়েছে। বিদেশে যে অর্থ পাচার হয়েছে এটি দুর্নীতির সার্বিক চিত্রের একটি অংশ। উন্নয়নের নামে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে, সেটির বাস্তব ফলাফল সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে চোরতন্ত্রের কর্ণধাররা সেই সুযোগ নিয়েছেন। ফলে দেশে বৈষম্য ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, তারই পরিনামে জুলাই আন্দোলন হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতের ঋণ কেলেঙ্কারি এবং ব্যাংকের মালিকানা দখলের বিষয়গুলো ব্যাপক আলোচিত হলেও সরকার অনেকটাই চুপ ছিল। সরকারের এই নীরব অবস্থানের কারণেই কি ব্যাংক খাতে এই অবস্থা তৈরি হয়েছিল? এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ভূমিকাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সরকার নীরব থাকেনি, বরং সরবে, প্রকাশ্যে এবং জনসমক্ষে ব্যাংক খাতে লুটপাট থেকে শুরু করে, ব্যাংক খাতে জালিয়াতি, প্রতারণা ও ব্যাংক ঋণের অপব্যবহারের মাধ্যমে যে অর্থ পাচার হয়েছে, রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে সেটির সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও আর্থিক খাতে লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে কী সংস্কার হবে এই পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত যারা দিতো বাস্তবে তারাই ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের জন্য কর্ণধার, তারাই এই খাতকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্র কাঠামোকে যারা দখল করেছিল, তারাই কিন্তু দুর্নীতি ও ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের মূল হোতা। ঋণ খেলাপির সংস্কৃতি যারা প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাদের সর্বোচ্চ কর্ণধার যারা, যারা ঋণ খেলাপির পাইওনিয়ার তারাই কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামো দখল করে...ব্যাংকিং খাতে লুটপাট, কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচার করেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত দুর্নীতি নিয়ে আইনি পদক্ষেপ কেন সীমিত ছিল বলে আপনি মনে করেন?

বাস্তবে যেটি হয়েছে, যাদের হাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা, তারাই কিন্তু দুর্নীতির কর্ণধার। তারাই এই দুর্নীতির ফলে লাভবান। এর মধ্যে এক ধরনের ত্রিমাত্রিক যোগসাজশ হয়েছে। একদিকে রাজনৈতিক শক্তি, অন্যদিকে লুটপাটের কর্ণধার, অন্যদিকে আমলতন্ত্রের একটি বিশাল অংশের সিন্ডিকেট মিলে লুটপাট ও দুর্নীতিকে সহায়তা করেছে। এদের হাতে দায়িত্ব ছিল দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সাধারণ মানুষও জানে দুদককে রাজনৈতিকভাবে ও আমলাতান্ত্রিকভাবে জিম্মি করা হয়েছিল। ফলে, যারা সরকারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট তাদের ক্ষেত্রে কোনো দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা সরকারের বিরাগভাজন হয়েছে এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভুয়া মিথ্যা মামলা করেছে। শুধু দুদকের হাতেই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা না, রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক প্রতিষ্ঠান যাদের সার্বিকভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা, জাতীয় সংসদ থেকে শুধু করে, জাতীয় সংসদের মৌলিক দায়িত্ব শুধু আইন প্রণয়ন না, সরকারের জনগণের পক্ষে জবাবদিহি করার কথা। এই সংসদকে পলিটিক্যালি ক্যাপচার করা হয়েছিল, মনোপোলাইজ করা হয়েছিল, একচ্ছত্র ভুবন তৈরি করা হয়েছিল, যার ফলে সরকারের জবাবদিহিতা শব্দটা ডিকশনারি থেকে হারিয়ে যায়। একই অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে প্রশাসনে, আমলাতন্ত্রে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার ব্যবস্থায়।

আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চপর্যায় বা তাদের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে প্রশাসনের অনীহা বা পক্ষপাতিত্ব ছিল কি?

অনীহা বা পক্ষপাতিত্ব আচরণ তো ছিল। যাদের জবাবদিহিতায় আনার দায়িত্ব ছিল তাদের ওপর অলিখিত নির্দেশ ছিল যে হাত দেওয়া যাবে না। দুর্নীতি দমন কমিশনের শীর্ষ অবস্থান থেকে এমনও বলা হয়েছে যে, হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যারা কোনো-না-কোনো পদে জড়িত, তাদের বিচারহীনতা দেওয়া হয়েছে। ফলে দুর্নীতির বিশাল ব্যাপকতা আমরা দেখতে পেয়েছি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই জানিয়েছিলেন, তার একজন কর্মচারীর (পিয়ন) ৪০০ কোটি টাকার দুর্নীতির কারণে তাকে চাকরি থেকে বের করে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ওই কর্মচারীর বিরুদ্ধে তিনি কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। এসব ঘটনা কি অন্যদের দুর্নীতিতে অনুপ্রাণিত করে ?

এটাকে আমি স্টান্টবাজি হিসেবে দেখি। কারণ, এমন এক সময়ে তিনি এটি বলেছেন, যখন দুর্নীতি নিয়ে সরকারে ব্যাপক আলোচনা হলেও সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না, সরকার দুর্নীতির সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। যারা কোনো-না -কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে, তাদেরকে দুর্নীতির স্বাভাবিকতায় রূপান্তরের সুযোগ দেওয়া হয়। এটা নিজের মুখে বলা হলো। অন্যদিকে তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘‘আমি তাকে বের করে দিয়েছি, চাকরিচ্যুত করেছি''- সেটাই যেন তার জন্য যথেষ্ট। যিনি ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তার কিন্তু ওই চাকরি করার আর প্রয়োজন নেই। এটি সমাজকে বিভিন্নভাবে বার্তা দেয়। অন্তর্বর্তী সরকারও কালো টাকাকে বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে। সংবিধানকে লঙ্ঘন করে, সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলকভাবে ধারাবাহিকভাবে সরকারগুলো এই কাজটি করছে। অর্থাৎ, যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন বাস্তবে সরকারগুলো জনগণকে বলে যাচ্ছে-তোমরা সারা বছর দুর্নীতি করো, দুর্নীতি করে অবৈধ অর্থ রোজগার করো, বছর শেষে আমরা বৈধতা দিয়ে দেবো।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির বিচারে অভিযোগ গঠন থেকে শুরু করে বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করে দোষীদের সাজা দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট কিনা...

অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক কাজ করেছে। দুদক সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এটাকে বলতে হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে, কর্তৃত্ববাদ বিকাশের অন্যতম অনুঘটক ছিল দুর্নীতি। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য কিন্তু কর্তৃত্ববাদ। কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে দুর্নীতি যারা করে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। এখন পর্যন্ত যতটুকু দেখছি দুদকের নতুন কমিশন আগের তুলনায় অনেক সক্রিয় হয়েছে। তাদের জন্য একটি অ্যাডভানটেজও আছে, তারা যাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছেন সবাই পলাতক। তাদেরকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রাখতে হবে সেই অবস্থাটা আর নেই। এর মধ্যে আমি সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই। কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেছে দুদক একদিক থেকে সক্রিয়ভাবে পতিত সরকারের যারা অংশ, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করছে। অন্যদিকে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা ছিল, যারা ক্ষমতার বাইরে ছিল সেই মামলাগুলোকে কোনো প্রকার বাছ-বিচার করা ছাড়াই প্রত্যাহার করা হয়। এখানে একটি উপাদান কাজ করে থাকতে পারে, যাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো, তাদের দল বা তারাই তো এখন কর্তৃত্ববাদ পতনের ফলে বিজয়ী শক্তি বা তারাই তো ক্ষমতায় আসবেন বা এসে গেছেন; এই মানসিকতা থেকেও কাজ করে থাকতে পারে, এটা দুদকের দুর্বলতার একটি অংশ।

কিন্তু বাস্তবে যেটি আমি দেখতে পাই, দুদক আগের তুলনায় অনেক সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে এটি যথেষ্ট কিনা, পর্যাপ্ত কিনা, সুফল বইবে কিনা এটি কিন্তু সময়সাপেক্ষ প্রশ্নের জবাব। তার কারণ হচ্ছে, দুর্নীতির মামলার জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তদন্ত কতটুকু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে হচ্ছে, এমনভাবে করা হচ্ছে কিনা যেটি আদালতে টিকবে এবং শেষ পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলকভাবে শাস্তি হবে, এটি সময় বলবে। তবে আমি আশাবাদী কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুফল দেখা যাবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের দুইজন উপদেষ্টার ব্যক্তিগত সহকারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর দুদক তা তদন্ত করছে। গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন সমন্বয়কের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়গুলোকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

একটি সরকার দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয়ে যাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তা প্রত্যাশা করাটা খুবই কঠিন। আমরা দেখেছি ৫ আগস্ট কর্তৃত্ববাদের পতনের পর থেকেই সারা দেশে দলবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মামলা বাণিজ্য, দখল বাণিজ্য শুরু হয়েছে৷ এটা অব্যাহত ছিল এবং এখনো আছে। বহুবিধ শক্তি কিন্তু একই ‘ব্যবসার' মধ্যে জড়িত। এর মধ্যে আছে যাদের কথা বললেন যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের একাংশ বা নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিকশিত হচ্ছে, তাদের একাংশ৷ যদি তাই হয়, তারা কিন্তু আমলতন্ত্রের এস্টাবলিস্টের যে রোল মডেল, সেই মডেলকে অনুসরণ করছে৷ পদোন্নতির জন্য, পদায়নের জন্য যে ধরনের অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে সেটি কিন্তু আসলে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ। এই যে আমাদের সময়ের সংস্কৃতি একটি দলীয়করণ থেকে সরিয়ে আরেকটি পেশাগত দলীয়করণ প্রতিস্থাপন হয়েছে। যেসব উপদেষ্টাদের এপিএসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাস্তবতাটা হচ্ছে এটি সংঘটিত হয়েছে। সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের অনুমোদন বা তাদের নির্দেশনায় দুদক কাজ শুরু করেছে, অনুসন্ধান শুরু করেছে। কান টানলে যেন মাথা আসে। এরকম অবস্থানে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ নিজের মতো করে এককভাবে এ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হতে পারে না। এর মধ্যে যোগসাজশ আছে, মাথা যেন আসে, সেটি দেখার দায়িত্ব দুদকের। কর্তৃত্ববাদী জঞ্জালেও ওপর অনেক জটিল পরিস্থিতিতে সরকার পরিচালিত হচ্ছে। এই অবস্থায় কিন্তু বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রমে সরকারকে লিপ্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থের দ্বন্দ্বপ্রসুত সিদ্ধান্ত, অনেক ক্ষেত্রে পরিচিত, আত্মীয়-স্বজনকে নিয়োগ-পদোন্নতি দেওয়া, বিভিন্ন প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর পরের দিন সেটি বাতিল করা, সমন্বয়হীনতা ছিল। যার ফলে এটা সুশাসনের মৌলিক উপাদানগুলো প্রতিষ্ঠা করার পর্যাপ্ত সময় ও কৌশলও সরকারের হাতে দেখিনি, যে কারণে এ ধরনের অনিয়মগুলো সংঘটিত হয়েছে।

দেশবাসী আশা করবে অন্ততপক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় যেটি হওয়ার কথা ছিল একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। যদি পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন তারা, যেটা ভবিষ্যতের জন্য অনুকরণীয় বিষয় হবে। যে অনুসন্ধান হচ্ছে, যেখানে যেন জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়, যাতে করে ভবিষ্যতে মাইলফলক হয়ে থাকে।

কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখিনি: ইফতেখারুজ্জামান

This browser does not support the audio element.

দুর্নীতি প্রতিরোধে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দুদক কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে? দুর্নীতি দমনে এখন অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করতে পারছে কি?

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার চট করে ছয় মাস বা এক-দু বছরে করে ফেলতে পারবো- সেটি আশা করা কঠিন। কারণ, দুদকের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুদকের কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি সংস্কারের জন্য দুদক সংস্কার কমিশন কাজ করেছে। এই সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো যদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং সেটির প্রতিফলন কাজে-কর্মে ঘটে, তাহলে কিন্তু আমরা আশা করতে পারবো দুদক সত্যিকার অর্থে কার্যকর হবে। এখনো পর্যন্ত দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করছে এটি বলার মতো তথ্য আমার কাছে নেই। দুদক এখন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রভাবে প্রভাবান্নিত। দুদকের অভ্যন্তরে অনেকই আছেন যারা বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত।

দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ এখন পর্যন্ত আমরা দেখিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য নিয়ে যেগুলো বাস্তবায়ন প্রয়োজন সেগুলো নিয়ে ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে। কিন্তু বেশির ভাগ সুপারিশ দেওয়া হয়েছে যেগুলো স্বল্পমেয়াদে করা সম্ভব। এই তালিকা ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। কাজেই আমরা সুযোগ হারাচ্ছি। তারপরেও আমি বলবো যে, আমি আশাবাদী হতে চাই। যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদেই দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের বাস্তব সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

দুর্নীতি দমনে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে আপনি আশার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে আগের সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছে এই সরকার। বর্তমান সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

এত অল্প সময়ের মধ্যে এটা মূল্যায়ন করাটা কঠিন। এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচন হলে যে সময় আছে, দুদকের পরিপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করা কঠিন। কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাবনা আছে, যেগুলো তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব। কিছু কিছু প্রস্তাবনা আছে, যেগুলো তিন মাসও লাগবে না, সেগুলো কোনো-না-কোনো কারণে এখনো ‘ফ্রোজেন' আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্যই সংস্কার চায়, কিন্তু যে প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে না অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধে, এটা তারা উপলব্ধি করতে পারছে না। শুধু দুদক নয়, প্রশাসনিক, পুলিশ, বিচার বিভাগ সংস্কারেও এটি আছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক অঙ্গনে যত দিন পর্যন্ত বাস্তবে জুলাই আন্দোলনের মূল চেতনাকে ধারণ করে বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করা না হবে, তত দিন পর্যন্ত আমরা যতই সংস্কারের কথা বলি না কেন সেই সংস্কার বাস্তব সংস্কার অধরা থেকে যাবে।

সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একসঙ্গে কাজ না করলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া কি সম্ভব?

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে এবং তার মাধ্যমে কিছু সুফল হয়তো আমরা দেখবো, কিন্তু সেটি অবশ্যই প্রত্যাশা অনুযায়ী যথেষ্ট না। তার কারণ হচ্ছে, প্রতিরোধ এখনো আছে। সরকারের হাতে দায়িত্বের পাশাপাশি যে ক্ষমতা আছে, সেটাও কিন্তু ক্ষমতার যে সূত্র সরকারের পেছনের শক্তি করা সেটি দেখতে হবে। তারা কতটুকু বাস্তব সংস্কারের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ, সেটিও দেখতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনায় যারা আছেন, তাদের পেশাগত যে অভিজ্ঞতা-দক্ষতা সেটিও কিন্তু আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, আমলাতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকের নেই। যে কারণে দুর্নীতি প্রতিরোধ বা প্রতিকারমূলক পদক্ষেপগুলো আমরা প্রত্যাশিত পর্যায়ে দেখিনি। যদিও কিছু কিছু সুফল আমরা আশা করছি, দেখতে পারছি। দুর্নীতি প্রতিরোধ বা দুর্নীতি দমনের বিষয়টি কিন্তু ছয় মাস, এক বছর বা সামনের ছয় মাস বা নির্বাচনের আগে সম্পন্ন হয়ে যাবে- এটা ভাবটা খুবই অবাস্তব। ভাবতে হবে নির্বাচনের পরে কী হবে।

বাংলাদেশের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র টিআইবি বরাবরই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে দুর্নীতি রোধে কোন পদক্ষেপগুলো নেওয়া জরুরি বলে আপনি মনে করেন?

চারটি উপাদান এখানে গুরুত্বপূর্ণ এবং একে অপরের সম্পূরক। প্রথমটি রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এটি সবাই বলেন কিন্তু পৃথিবীতে কোনো দৃষ্টান্ত নেই। যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের যদি সদিচ্ছা না থাকে এবং সেই সদিচ্ছা প্রয়োগ করার মতো সৎ সাহস না থাকে, তাহলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। এটি শুধু যারা ক্ষমতায় থাকবে সেই রাজনৈতিক দল নয়, যারা ক্ষমতার বাইরে থাকবে তারাও কিন্তু অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, যারা দুর্নীতি করবেন, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে, তারা সরকারের হোক আর সরকারের বাইরের হোক, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, উচ্চ পর্যায়ের আমলা বা নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারী হোক, ব্যক্তির পরিচয় এবং অবস্থান নির্বিশেষে বিচারের আওতায় আনতে হবে, দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে- দুর্নীতি পেলে শাস্তি পেতে হয়। যে অপরাধ করে শাস্তি পেতে হয় না, সেই অপরাধ বিকশিত হয়- দুর্নীতির ক্ষেত্রে এ কথাটি প্রযোজ্য।

তৃতীয়ত-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য, যারা দুর্নীতি করেন তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে দুদকসহ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে অন্যান্য যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোকে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে, যাতে করে দুর্নীতি প্রতিরোধক ও প্রতিকারমূলক একটি রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়ে তা স্থায়ী হয়। চতুর্থত, এমন একটি সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে, দুর্নীতি নিয়ে কথা বললে শাস্তি পেতে হয় না, হয়রানির স্বীকার হতে হয় না। গণমাধ্যমকেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে হবে এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। 

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ