সরকারি চাকরিজীবীদের মহার্ঘ ভাতা, সাধারণ মানুষের জন্য কী?
১০ মে ২০২৩কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ কীভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে টিকে থাকবে?
২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেট বরাদ্দের খাতওয়ারি চূড়ান্ত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই মহার্ঘ ভাতার প্রস্তাব তুলে ধরার সিদ্ধান্ত হয়েছে৷
সরকারি চাকরিজীবীদের বিভিন্ন সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে এই মহার্ঘ ভাতার ব্যাপারে একমত নীতি নির্ধারকরা৷ তারা বলছেন, ২০১৫ সালে নতুন পে স্কেল ঘোষণার পর পাঁচ বছর পর আবার পে স্কেল হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি৷ আট বছর হয়ে গেছে৷ সেই কারণেই এই মহার্ঘ ভাতার প্রস্তাব৷ তবে তারা এই সময়ে প্রতিবছর শতকরা পাঁচ ভাগ হারে ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন৷
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি চাকরিজীবী প্রায় ১৪ লাখ৷ তবে বিভিন্ন কর্পোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ এই সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ৷ চলতি অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা খাতে ৭৩ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা লাগছে৷ আগামী অর্থবছরে বেতন-ভাতা বাবদ ৭৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের খসড়া তৈরি করেছে অর্থ বিভাগ৷ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে এর পরিমাণ আরো ২০ ভাগ বাড়বে৷
সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাবদ মোট বাজেটের ২২-২৮ শতাংশ ব্যয় হয়৷ আর গত এক দশকে তাদের বেতন ভাতা বাবদ সরকারের খরচ বেড়েছে ২২১ ভাগ বেড়েছে৷
সর্বশেষ জনশুমারি বলছে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ৷ সেই হিসেবে সরকারি চাকরিজীবীরা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর দেড় শতাংশেরও কম৷
এপ্রিল মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৩৩ ভাগ৷ এই বছরই মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছাড়িয়েছে৷ আর খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি আরো বেশি৷ সিপিডির জরিপ বলছে, ঢাকায় চার সদস্যের পরিবারের জন্য মাসে সাধারণ খাদ্য খরচই এখন ২২ হাজার টাকা৷ সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারকে এখন তাদের মোট আয়ের ৬০ শতাংশ খরচ করতে হয় সাধারণ খাদ্যের পিছনে৷ তবে মাছ-মাংস খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিলে মাসে খরচ দাঁড়ায় সাত হাজার ১৩১ টাকা৷
আর এই সময়ে বিবিএসের দুইটি জরিপ দেশে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী, তা প্রকাশ করছে৷ বিবিএস বলছে দেশে দারিদ্র্য কমলেও আয় বৈষম্য বাড়ছে৷ সম্পদ কিছু মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে৷
আর ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব-এর ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬.৩ শতাংশ ছিল কেবল এক শতাংশ লোকের হাতে৷ দারিদ্র্যসীমার নিচের অর্ধেকের হাতে ছিল মাত্র ১৭ শতাংশ৷
বেকারত্ব বাড়ছে৷ বিবিএস বলছে, বাংলাদেশে মাত্র তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বেকারত্ব বেড়েছে দুই লাখ ৭০ হাজার৷ বিবিএস এই ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ করে ২ এপ্রিল৷
চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে দেশে মোট বেকার ছিলেন ২৫ লাখ ৯০ হাজার৷ আর গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ২০ হাজার৷
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সব শ্রেণি বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষকে সবচেয়ে বেশি চাপে রেখেছে৷ সরকারি চাকরিজীবিরা মহার্ঘ ভাতা পাবেন এটা নিয়ে বলার কিছু নাই৷ কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ যাতে দ্রব্যমূল্যের চাপের মুখে উপকৃত হয় সরকারের সেই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত৷ সরকার এই পরিস্থিতিতে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে বলছেন৷ সেটাও বিবেচনা করা প্রয়োজন৷ সাশ্রয় যেন সবার জন্য হয়৷''
তার মতে, ‘‘ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বাড়াতে সবসময় অজুহাত খোঁজেন৷ এখন সরকারি চাকুরেদের মহার্ঘ ভাতা দিলে তাদের বেতন বাড়বে৷ এই অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা আরো এক দফা দাম না বাড়িয়ে দেয়৷ সেটা হলে চাপ সাধারণ মানুষকেই নিতে হবে৷ সরকারের এটাও খেয়াল রাখা দরকার৷''
‘‘আসলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বাজারকে যৌক্তিভাবে মনিটরিং করা৷ সেটা সরকার করছে না৷ করলে দেশের সব মানুষ উপকৃত হতো,'' মনে করেন তিনি৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘‘সরকারি কর্মচারীদের এই মহার্ঘ ভাতা পাওনা হয়ে গেছে৷ কারণ পাঁচ বছর পরপর তাদের নতুন পে স্কেল পাওয়ার কথা থাকলেও তা তারা পাননি৷ কিন্তু করোনা মহামারি এবং তারপরে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে এখন দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তার প্রভাব শুধু সরকারি কর্মচারী নয়, দেশের সব শ্রেণির মানুষের ওপর পড়ছে৷''
তার কথা, ‘‘নিম্নবিত্ত এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ কষ্টে আছে৷ তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে সাপোর্ট, যে সামাজিক নিরাপত্তা পাওয়ার কথা ছিল তারা সেটা পাচ্ছে না৷ এর জন্য যে পরিমাণ কর আদায় করা দরকার ছিল রাজস্ব বোর্ড সেটা পারছে না৷ কর আদায়ে তাদের অদক্ষতা আছে৷ আবার কাদের সহায়তা প্রয়োজন তার জরিপও করতে পারেনি বিবিএস৷ প্রধানমন্ত্রী যখন ৫০ লাখ মানুষকে অর্থ সহায়তা দিতে চাইলেন তখন ৩৫ লাখের বেশি মানুষ পাওয়া যায়নি৷''
তার কথা, ‘‘দারিদ্র্য কাঙ্খিত হারে কমছে না৷ বেকারত্ব কমছে না৷ আয় বৈষম্য বাড়ছে৷ সব মিলিয়ে একটি খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে৷ সরকারি চাকরিজীবীরা মহার্ঘ ভাতা পেলেও তাতে দেশের অধিকাংশ মানুষের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মূল্যস্ফীতির অনেক কারণ আছে৷ তার মধ্যে একটি অংশের আয় বেড়ে গেলেও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যেতে পারে৷''
আগামী ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেট পেশ করা হবে৷ এবার বাজেটের আকার হবে ৭ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকার৷ চলতি বাজেট ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার৷