গ্রামীণ ব্যাংক সরকারের মালিকানায় নেয়া হলে প্রতিষ্ঠানটির ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করা হবে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম৷ তিনি মনে করেন সরকার এসব করছে রাজনৈতিক কারণে৷
বিজ্ঞাপন
গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন মনে করে ব্যাংকটি সরকারি মালিকানায় নেয়া প্রয়োজন৷ তাই তাদের রিপোর্টে ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ৫১ ভাগে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে৷ বর্তমানে এই ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ৫ ভাগ৷ যুক্তি হিসেবে কমিশন বলছে কোম্পানি আইন অনুযায়ী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারধারীদের নিয়ে বছরে একবার বার্ষিক সাধারণ সভা করা বাধ্যতামূলক৷ ব্যাংকের বর্তমানে নির্বাচিত ৫ লাখ ৪০ হাজার শেয়ারধারীকে নিয়ে বার্ষিক সাধারণ সভার আয়োজন করা অকল্পনীয় এবং ব্যয়সাপেক্ষ৷
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে ব্যাংকটি সরকারের কব্জায় চলে যাবে৷ ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা এতদিন যারা ব্যাংকের মালিক হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন তারা আর মালিক থাকবেন না৷ তিনি বলেন বাংলাদেশের ৯৯ ভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানই অলাভজনক এবং ভর্তুকি নির্ভর৷ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পেশাদারি এবং দক্ষতার চরম অভাব লক্ষ্য করা যায়৷ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো লোকসান গুনছে৷ সেখানে দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার কথা সবার জানা৷ আর সেখানে আছে দলাদলি৷ তাই গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি সফল প্রতিষ্ঠানকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হলে ব্যাংকটি ধ্বংস হয়ে যাবে৷ তাঁর আশা, কমিশন যাই সুপারিশ করুকনা কেন সরকার ব্যাংক, ক্ষুদ্র আমানতকারী এবং ঋণগ্রহীতাদের কথা চিন্তা করে আত্মঘাতী কোনো সিদ্ধান্ত নেবেনা৷
মুহাম্মদ ইউনূসের আরেকটি অর্জন
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক গ্রহণ করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ বুধবার ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল ভবনের রোটান্ডায় ইউনূসের হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন জন বোয়েনার৷
ছবি: Getty Images
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঝুড়িতে আরেকটি সম্মাননা যোগ হলো৷ বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক গ্রহণ করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা৷ তবে নিজের দেশে বর্তমানে বেশ চাপের মধ্যে আছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ইউনূস৷
ছবি: Getty Images
সম্মাননা গ্রহণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উভয় কক্ষের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল ভবনের রোটান্ডায় অধ্যাপক ইউনূসের হাতে সম্মাননা তুলে দেন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার জন বোয়েনার৷ এসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট নেতা ন্যান্সি পেলোসি (বামে)৷
ছবি: Getty Images
বাংলাদেশের মানুষকে উৎসর্গ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল গ্রহণ করার পর ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘‘সকলে আমার কাজে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন বলেই ক্ষুদ্রঋণের ধারণাটি আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত৷ আমি এ সম্মান বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্যে উৎসর্গ করলাম৷’’
ছবি: Getty Images
‘প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক’
এর আগে ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি মর্যাদাশীল সম্মাননা অর্জন করেন ইউনূস৷ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক’ পান ড. ইউনূস৷ সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী এই সম্মাননা দেওয়া হয়৷
ছবি: AP
অন্য উচ্চতায় ইউনূস
বলাইবাহুল্য, ইউনূস হচ্ছেন প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি নোবেল পুরস্কার জয়ের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি মর্যাদাশীল সম্মাননা অর্জন করেছেন৷ গোটা বিশ্বে মাত্র সাতজন জীবদ্দশায় এই তিনটি সম্মাননা পেয়েছেন৷ এরা হচ্ছেন নরম্যান বারলগ, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলা, এলি উইসেল, অং সান সু চি, মাদার টেরেসা এবং সর্বশেষ মুহাম্মদ ইউনূস৷
ছবি: AP
গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা
গরিব মানুষ বিশেষ করে নারীদের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার জন্য ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন মুহাম্মদ ইউনূস৷ আধুনিক ক্ষুদ্রঋণের জনক বলা হয় তাঁকে৷ গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্রঋণকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন তিনি৷ ক্ষুদ্রঋণের এই ধারণা অধ্যাপক ইউনূসকে গোটা বিশ্বেই সম্মানজনক পরিচিতি এনে দিয়েছে৷
ছবি: AP
শান্তিতে নোবেল জয়
২০০৬ সালের যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয় করেন অধ্যাপক ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক৷ সেবছরের ডিসেম্বরে নরওয়ের রাজধানী অসলো’র টাউন হলে এই সম্মাননা গ্রহণ করেন অধ্যাপক ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি তসলিমা বেগম৷
ছবি: AP
রাজনীতির ইচ্ছা এবং বিড়ম্বনা
শান্তিতে নোবেল জয়ের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশের ঘোষণা দেন অধ্যাপক ইউনূস৷ তবে এই সিদ্ধান্ত থেকে দ্রুতই সরে আসেন তিনি৷ কিন্তু অনেকেই মনে করেন, রাজনীতিতে নামার এই বাসনার কারণে পরবর্তীতে অনেক রাজনীতিবিদের চক্ষুঃশূল হন তিনি৷
ছবি: AP
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ‘বিদায়’
শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বেশ খানিকটা চাপের মধ্যে রয়েছেন৷ বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে অব্যাহতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক৷ এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়েছেন ইউনূস৷ এখন (১৮.০৪.১৩) পর্যন্ত ব্যাংকটিতে নতুন কোন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ সম্ভব হয়নি৷
ছবি: dapd
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ?
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনো অধ্যাপক ইউনূসকে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে স্বীকার করেননি৷ তবে একথা বহুদিন ধরে চালু যে, অধ্যাপক ইউনূসের উপর কোন কারণে নাখোশ শেখ হাসিনা৷ যেকারণে চলতি সরকারের মেয়াদে নিজ দেশ বিভিন্ন ইস্যুতে চাপে আছেন মুহাম্মদ ইউনূস৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
কমিশনের সুপারিশে গ্রামীণ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে কেবল নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেখে স্থানীয় পর্যায়ে গ্রামীণ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে৷ এর মানে হলো তারা স্থানীয় পর্যায়ে সব সিদ্ধান্ত নেবে৷ লাভ লোকসানের দায়ও থাকবে স্থানীয় শাখার উপর৷ আর স্থানীয় পর্যায়ে নতুন সংগঠন নিবন্ধনও করা যাবে৷ এই সুপারিশে মূলত গ্রামীণ ব্যাংকের মূল কাঠামোই ভেঙে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছে৷
এ প্রসঙ্গে ড. ইসলাম বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান কাঠামোতে কোনো ত্রুটি শনাক্ত করতে পারেনি কমিশন৷ আর প্রচলিত কাঠামোতেই ব্যাংক ভালোভাবে চলছে৷ তাই নতুন ধরণের কাঠামোর কথা বলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ তিনি বলেন সুপারিশে পল্লি বিদ্যুত সমিতির মতো স্থানীয় পর্যায়ে যে সমিতি গঠন করার কথা বলা হয়েছে তা আর্থিক খাতে কার্যকর নয়৷ আর পল্লি বিদ্যুত সমিতি হলো গ্রাহকদের সমিতি৷ তারা নিয়ন্ত্রক নয়৷ কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের আলোকেই প্রতিষ্ঠান চলে৷ তাই গ্রামীণ ব্যাংককে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন সত্ত্বায় ভাগ করার যে সুপারিশ তা গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবেনা৷
ড. ইসলাম মনে করেন গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন সরকারের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে সুপারিশ করেছে৷ আর এইসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে ৮৪ লাখ গ্রাহকের এই ব্যাংক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে৷ মনে রাখতে হবে গ্রাহকদের প্রায় সবাই দরিদ্র নারী৷ এই জনগোষ্ঠীকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া সরকারের উচিত হবেনা৷