সরকারি স্কুলের ভবিষ্যৎ কী?
১৮ জানুয়ারি ২০১৯পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ বাহিনীতে নিয়মিত কনস্টেবল এবং হোমগার্ডের বিকল্প হিসেবে ‘গ্রিন পুলিশ’, বা ‘সিভিক পুলিশ’ নিয়োগ করে সুফল পাওয়া গেছে৷ একদিকে যেমন স্থানীয় ছেলে-মেয়েদের এক ধরনের কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করা যাচ্ছে, তেমনই ন্যুনতম পারিশ্রমিকে এই সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়েই পুলিশের অনেক কাজ করিয়ে নেওয়া যাচ্ছে৷ কিছুটা সেই মডেলেই রাজ্যের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সরকারি স্কুলগুলিতে ‘ইন্টার্ন’ শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ করার কথা ভাবছে সরকার৷ সম্প্রতি রাজ্য সচিবালয় নবান্নে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অধ্যক্ষদের সঙ্গে এক বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ সেই বৈঠকে এই ইন্টার্ন নিয়োগের প্রস্তাব পেশ করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ কারণ হিসেবে বলেন, তাঁর সরকারের ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের সুবাদে এখন স্কুলছুট কমেছে, ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে৷ কিন্তু সেই তুলনায় যথেষ্ট শিক্ষক-শিক্ষিকা পাওয়া যাচ্ছে না৷ বিশেষ করে গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলিতে কেউ যেতে চায় না বলে শিক্ষকের অভাব থেকেই যাচ্ছে৷ সেই অভাব পূরণ করতে পারে এই ইন্টার্ন ব্যবস্থা৷ স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায় পাস করা ছাত্র-ছাত্রীদের দু'বছর মেয়াদের ভিত্তিতে এই নিয়োগ দেওয়া হবে৷ তার জন্য তাঁরা প্রাথমিক স্কুলের ক্ষেত্রে মাসে ২০০০ টাকা এবং মাধ্যমিক স্কুলের ক্ষেত্রে ২৫০০ টাকা ভাতা পাবেন৷
শিক্ষকের অভাব পূরণ করতে এই ব্যবস্থা হয়ত মন্দের ভালো৷ এতে একদিকে যেমন স্থানীয় ছেলে-মেয়েদের একটা সাময়িক কর্মসংস্থান হবে, তেমনি পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নিয়োগের আর্থিক দায় থেকে অব্যাহতি মিলবে সরকারের৷ কিন্তু এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে সামগ্রিক স্কুল শিক্ষার ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে? দু'রকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে৷ বড় একটা অংশ মনে করছেন, শিক্ষাক্ষেত্রে এমন ধরনের সাময়িক উদ্যোগ আদতে হাস্যকর এবং অকার্যকর৷ স্কুলে মিড ডে মিল থেকে শুরু করে সাইকেল দেওয়া, জুতো দেওয়ার মতো উদ্যোগ জনকল্যাণমূলক প্রকল্প হিসেবে খুবই ভালো এবং লোকপ্রিয়, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু স্কুলে নিয়ে যেতে পারলেই যে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা হবে, সমাধানটা এত সহজ নয়৷ কারণ, পড়ানোর জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষিত শিক্ষক৷ তার বদলে যদি সদ্য স্নাতক হওয়া ছেলে-মেয়েদের দিয়ে কাজ চালানো হয়, তাহলে শিক্ষার মান পড়ে যেতে বাধ্য৷ সেক্ষেত্রে একটু সচেতন বাবা-মায়েরাই সরকারি স্কুল, বাংলা মাধ্যম স্কুলগলির পঠন-পাঠনের মানের ওপর ভরসা হারাবেন৷ এবং যে প্রবণতা সমাজের সর্বস্তরে এখন প্রকট, যে নিজেদের আর্থিক সাধ্য অতিক্রম করে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানকে পাঠানো, তারই আরো বাড়াবাড়ি হবে কি না, এ সন্দেহও অনেকেই পোষণ করছেন৷
এমনও হতে পারে যে সরকার স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা এবং তার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের প্রথাটাই তুলে দিতে চাইছে! এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্কুলশিক্ষক সৌরভ মুখোপাধ্যায়৷ হাওড়া জেলার ডোমজুড়ের ওয়াজিপুর মহাকালতলা হাই স্কুলের শিক্ষক সৌরভ একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকও বটে৷ তিনি নিজের লেখালেখির মাধ্যমে বরাবরই মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রচারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন৷ এই সচেতনতার প্রসারে সৌরভ এক অক্লান্ত যোদ্ধা৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘‘এসএসসি-কে সম্ভবত এবার বন্ধ করে দেওয়ার একটা পরিকল্পনা চলছে৷ এরকম চলতে থাকলে কিছুদিন পর দেখা যাবে... যেমন সিভিক পুলিশেই ছয়লাপ হয়ে যাচ্ছে, কনস্টেবল-হোমগার্ড কমে যাচ্ছে, সেরকম শিক্ষক নিয়োগও কমে যাবে৷ শেষ পর্যন্ত যেটা দাঁড়াবে, সেটা হচ্ছে সরকারি ব্যবস্থার যে বাংলা মাধ্যম শিক্ষা, সেটা আস্তে আস্তে উঠে যাবে৷ আমার দীর্ঘদিন ধরেই মনে হচ্ছে স্কুলশিক্ষার গতিবিধি দেখে, অন্তত এই সরকার আসার পর, যে স্কুলগুলোকে তুলে দেওয়ার একটা ছক নিয়ে কাজকর্ম হচ্ছে কোনো কোনো মহলে৷’’
একজন স্কুল শিক্ষকের এই আশংকা হয়ত সর্বাংশে সত্যি হবে না৷ কিন্তু শিক্ষকের বিকল্প হিসেবে ইন্টার্ন নিয়োগের এই সরকারি প্রস্তাব কার্যকর হলে প্রাথমিক স্কুলশিক্ষারও যে শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যিকরণ হবে না, যা হয়েছে উচ্চশিক্ষায়, বিশেষত ইঞ্জিনিয়ারিং-ডাক্তারির ক্ষেত্রে, যেমনটা হয়েছে চিকিৎসার ক্ষেত্রে— সেটা খুব জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না৷