সরকারি হাসপাতালে ‘প্রাইভেট চেম্বার’: ফলে সন্দিহান চিকিৎসকরাই
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩সরকারি হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসকদের ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস’ বা রোগী দেখার প্রবণতা কমাতে এই সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার৷ এতে রোগী ও চিকিৎসক দুই পক্ষই উপকৃত হবে এমনটাই সরকারের দিক থেকে ভাবা হয়েছে৷ তবে হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসকদের ‘প্রাইভেট প্রাকটিস’ কমবে কিনা, বেসরকারি ক্লিনিক বা ব্যক্তিগত চেম্বারে ডাক্তার দেখানোর উচ্চ ফি থেকে রোগীরা মুক্তি পাবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ সরকারি হাসপাতালে যে অবকাঠামো, চিকিৎসক ও নার্স আছে তাতে এই ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের৷
যা থাকবে এই ব্যবস্থায়
চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালেই ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখতে পারবেন৷ হাসপাতালে তাদের নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শেষে সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা ফি তারা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিবেন৷ এজন্য সময় দেয়া হচ্ছে দুপুর তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত৷ সেবা পেতে রোগীকে টিকিট কাটতে হবে৷ ফির একটি অংশ চিকিৎসকের সহায়তাকারী ও হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ পাবে৷
সিনিয়র চিকিৎসকের ৩০০ টাকা ফির মধ্যে তার সহায়তাকারী পাবেন ৫০ টাকা৷ বাকি ৫০ টাকা সরকারি তহবিলে জমা পড়বে৷ জুনিয়র চিকিৎসকের ১৫০ ফির মধ্যে সহায়তাকারী পাবেন ২৫ টাকা৷ বাকি ২৫ টাকা যাবে সরকারি তহবিলে৷
জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে উপজেলা পর্যায়ে ৫০টি, জেলা পর্যায়ে ২০টি, বিভাগীয় পর্যায়ে আটটি ও বিশেষায়িত পাঁচটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের ‘প্রাইভেট চেম্বার’ চালু হবে৷ উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ঠিক করা হবে রোগীর উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে৷ যেসব হাসপাতালে রোগী বেশি আসেন, সেখানে এ সেবা চালু করা হবে৷ আগামী আগস্টের মধ্যে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ‘প্রাইভেট চেম্বার' চালুর পরিকল্পনা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়৷
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়, চিকিৎসকেরা পালা করে রোগী দেখবেন৷ একজন অধ্যাপক সপ্তাহে দুই দিন, সহযোগী অধ্যাপক দুই দিন, সহকারী অধ্যাপক দুই দিন রোগী দেখবেন৷ চিকিৎসক যদি রোগীকে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন, রোগী চাইলে তা সরকারি হাসপাতালে করতে পারবেন৷ আবার বেসরকারি হাসপাতালেও করতে পারবেন৷
সরকারি হাসপাতালের প্রাইভেট চেম্বারে কী কী সেবা দেওয়া হবে, তা খসড়া নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে৷ এতে বলা হয়েছে, কনসালটেশন, ডায়াগনস্টিক, ল্যাবরেটরি, রেডিওলজি, ইমেজিং ও সার্জিক্যাল সেবা দেওয়া হবে৷
উদাহরণ বিএসএমএমইউ
২০১১ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ২৬ বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা কর্মঘণ্টা শেষে এই পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন৷ এজন্য দুপুর আড়াইটা থেকে বহির্বিভাগের বিশেষ সেবার টিকেট বিক্রি শুরু হয়৷ বিএসএমএমইউতে দুপুর ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকদের বহির্বিভাগে পালা করে রোগী দেখতে হয়৷ রোগী প্রতি ফি ২০০ টাকা৷ এর মধ্যে ১৩৫ টাকা পান চিকিৎসক, বাকি ৬৫ টাকা পান কর্মচারীরা৷ বারডেম হাসপাতালও একই পদ্ধতিতে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে৷
বিএসএমএমইউর সাকে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এটা আমরা নিজেরাই বিএসএমইউতে করে ভালো ফল পেয়েছি৷ কিন্তু এটা একটা বিশেষায়িত হাসপাতাল৷ কোনো সমস্যা হলে আমরা নিজেরাই ঠিক করতে পেরেছি৷ আমাদের চিন্তা ছিল যেহেতু এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, রোগ নির্ণয়ের সব সুবিধা আছে তাই তার সর্বোত্তম ব্যবহার করা৷ আমরা রোস্টার করে দিয়েছি কোন চিকিৎসক হাসপাতালে সপ্তাহে কতদিন প্রাইভেট প্রাকটিস করতে পারবেন৷ যাতে সবাই এটা করতে বাধ্য থাকেন৷ ফলে কম খরচে সর্বোত্তম চিকিৎসা নিশ্চিত হয়৷ কিন্তু অন্যান্য হাসপাতালে এটা কার্যকর করতে নিবিড় তদারকির দরকার হবে৷”
তারা কথা, ‘‘নিবিড় তদারকি করা না হলে সরকারি হাসপাতালে বিনা খরচে সাধারণ মানুষ যে চিকিৎসা সেবা পায় তা ব্যহত হতে পারে৷’’
সম্ভাবনা ও আশঙ্কা
রোগীরা বলছেন,এই ব্যবস্থা চালু হলে ভালো হবে বলেই মনে হয়৷ বেসরকারি হাসপাতালে যে ‘গলাকাটা ফি' নেয়া হয় তা থেকে সাধারণ মানুষ রেহাই পাবেন৷ তবে চিকিৎসকরা যদি এটাকেও সরকারি সেবার মতো করে ফেলেন তাহলে তো লাভ নেই৷ মিরপুরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জামাল হোসেন বলেন, ‘‘সরকারি হাসপতালে তো আউটডোরের টিকিট কেটে বিনামূল্যে ডাক্তার দেখানো যায়৷ বিনামূল্যে ওষুধের ব্যবস্থা আছে কিছুটা৷ কিন্তু এই ব্যবস্থায় তো কম হলেও টাকা লাগবে৷ তাতে গরীব মানুষের কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না৷ কারণ অনেকের ওই টাকা দেয়ার সক্ষমতাও নেই৷”
এই সুযোগে চিকিৎসকরা তাদের কর্মঘণ্টার সময়ই সরকারি হাসপাতালকে ‘প্রাইভেট চেম্বার' হিসেবে ব্যবহার করেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা কলাবাগানের রিকশা চালক হামিদুর রহমানের৷ তেমনটা হলে বিনামূল্যে আউটডোরে ডাক্তার দেখানোর যে সুযোগ এখন আছে তাও আর থাকবে না বলে মনে করেন তিনি৷ বলেন, ‘‘৩০০ টাকা ফি নিয়ে ডাক্তার যদি আবার সরকারি হাসপাতালের মতোই আচরণ করেন তাহলে লাভ কী?”
সাধারণত সুচিকিৎসার জন্য একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স ও পাঁচজন টেকনোলজিস্টের প্রয়োজন হয়৷ দেশে এ জনবল নেই বললেই চলে৷ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা অবকাঠামোর তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি৷ বারান্দায়ও রোগী রেখে চিকিৎসা দিতে হয়৷
সুফল নির্ভর করছে...
বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ২২ হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার রয়েছে৷ তবু প্রতি বছর অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান৷ সরকারি হাসপাতালে মানসম্পন্ন চিকিৎসার অভাব এবং বেসরকারি হাসপাতালে অত্যধিক খরচের কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে৷
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘সরকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে দেখা যাক এর ফলাফল কেমন হয়৷ বিএসএমএমইউর মতো প্রতিষ্ঠান যেখানে পর্যাপ্ত অবকাঠামো, চিকিৎসক, নার্স আছে সেখানে সফল হতে পারে৷ কিন্তু অন্য হাসপাতালে কেমন হবে তা দেখতে হবে৷ শুরু হোক তারপর দেখা যাক কতটা সুফল পাওয়া যায়৷”
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে অনেক চিকিৎসকের পদ খালি৷ হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো ও রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়৷ যদি এগুলো ঠিকমতো থাকতো তাহলে হয়তো এখনই এর সুফল সম্পর্কে বলা যেত৷”
তার মতে, ঢাকা মেডিকেলসহ দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে এমনিতেই রোগীদের দীর্ঘ লাইন থাকে৷ বিকালে আবার প্রাইভেট প্রাকটিসে লাইন ধরে সেই সুবিধা নিতে রোগীরা উৎসাহিত হবেন কিনা বা টাকা দিয়ে যে সেবা তারা পেতে চান তা পাবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে৷
তিনি মনে করেন, ‘‘সরকারি হাসপতালে এই ব্যবস্থা চালুর পর বাইরে ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস’ বন্ধ হলে একরকম ফল পাওয়া যেত৷ কিন্তু দেশে তো বেসরকারি হাসপাতাল আছে৷ সেখানেও ফি বেধে দেয়া থাকলেও তা অনেকেই মানছেন না৷ আবার কোনো সমস্যা হলে তার দায় পড়ে চিকিৎসকদের ওপর৷ সরকারি হাসপাতালে অবকাঠামোর সমস্যা, রোগ নির্ণয় ব্যবস্থার অপ্রতুলতার দায় চিকিৎসকদের ওপরই পড়বে৷ কিন্তু এটাতো আলাদা প্রশাসনের কাজ৷ রোগীদের ব্যবস্থাপত্র তারা দেবেন৷ কিন্তু টেস্টসহ অন্যান্য বিষয়ের কী হবে?”
তবে এটি সরকারের ভালো উদ্যোগ বলেই মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক৷ সুফল পেতে মনিটরিং এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনার উপর জোর দেন তিনি৷
এসব নিয়ে কথা বলার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি৷ তবে জানা গেছে, দেশের সব হাসপাতালে একসঙ্গে নয়, পর্যায়ক্রমে এই ব্যবস্থা চালু করা হবে৷ সিভিল সার্জনরা তা মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণ করবেন৷ সেই সঙ্গে যেভাবে সময় নির্ধারণ করা হবে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা তা মেনেই প্রাইভেট প্রাকটিসে বাধ্য থাকবেন৷ যে হাসাপতালে রোগ নির্ণয় ও পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে তার সুবিধা রোগীরা পাবেন৷