সাংবাদিক পেটানোর অভিযোগে সাংসদ গোলাম মাওলা রনিকে গেপ্তার করা হয়েছে৷ এদিকে, রনির গ্রেপ্তারে সাংবাদিকরা সন্তোষ প্রকাশ করলেও, সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার না হওয়াকে সরকারের ‘দ্বৈত নীতি’ বলে উল্লেখ করেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
গত শনিবার ঢাকায় নিজের অফিসে ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের দুই সাংবাদিক ইমতিয়াজ রনি এবং মোহসিন মুকুলকে মারধোরের মামলায় সাংসদ গোলাম মাওলা রনি আদালত থেকে পরদিনই জামিন নেন৷ কিন্তু সেই জামিন বাতিলের আবেদন জানানো হলে বুধবার দুপুরে মহানগর হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান শুনানি শেষে রনির জামিন বাতিল করে তাঁকে গ্রেপ্তারে নির্দেশ দেন৷ এরপর মাত্র দু'ঘণ্টার মধ্যেই বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বাড্ডা এলাকা থেকে রনিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷
কেন খুন হয়েছেন সাগর, রুনি?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে৷ কিন্তু আজও নিহতের পরিবার, শুভানুধ্যায়ী আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারলো না, কেন এই হত্যাকাণ্ড? এই বিষয়ে ছবিঘর দেখুন এখানে:
ছবি: DW
সেই কালোরাত
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন খুব ভোরবেলা জানা গিয়েছিল, ঢাকায় নিজের ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি৷ একই ফ্ল্যাটে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ৷
ছবি: dapd
সাগর সরওয়ার
দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করার পর ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাগর সরওয়ার (ডানে)৷ সর্বশেষ সেই টেলিভিশন চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি৷ ২০১২ সালের দশই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুন হন সাগর৷
ছবি: DW
মেহেরুন রুনি
একাধিক দৈনিকে কাজ করার পর কয়েক বছর আগে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় কাজ শুরু করেন মেহেরুন রুনি (বামে)৷ মাঝে স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি৷ এরপর ২০১১ সালে আবারো ফিরে যান নিজের কর্মস্থলে৷
ছবি: DW
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার!
১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন৷ বলাবাহুল্য, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি৷
ছবি: DW
সাংবাদিকদের আন্দোলন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও সাগর-রুনি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করে সব সংগঠন৷ খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গর্জে ওঠে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিরা৷ জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW
ব্লগারদের প্রতিরোধ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের পাশাপাশি ব্লগাররা এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে নামে৷ গত বছর এই ইস্যুতে ব্লগ ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এখনো রয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যানার৷
ছবি: DW
রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথে ব্লগারদের সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে ব্লগ লিখে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স অ্যাওয়ার্ড জয় করে আবু সুফিয়ানের বাংলা ব্লগ৷ ছবিতে আন্দোলনরত আবু সুফিয়ান৷
ছবি: DW
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা
গত অক্টোবর মাসে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ আটজনকে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান৷ বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় গত সপ্তাহে৷ ব়্যাব গ্রেপ্তারকৃতদের বলছে ‘সন্দেহভাজন’৷ আর পরিবার মনে করছে, এদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কার্যত ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পরিবার
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক বছর হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা৷ তাই তাদের পরিবার এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানিয়েছেন, তারা (ব়্যাব) তদন্তের চেয়ে হয়রানি করতে বেশি উৎসাহী৷ সাগর রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের নিরাপত্তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
জজ মিয়া নাটক চান না সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও কাঁদেন৷ তাঁর দাবি হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে হবে৷ এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার তাঁর কাছে জজ মিয়া নাটক ছাড়া কিছুই নয়৷ তাঁর মতে, এক বছরে নানা টালবাহানা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
11 ছবি1 | 11
গ্রেপ্তারের পর পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, রনিকে ঢাকা মাহানগর গোয়েন্দা বিভাগের হাজতখানায় রাখা হয়েছে৷ বৃহস্পতিবার তাঁকে আদালতে হাজির করা হতে পারে৷ ওদিকে, গ্রেপ্তার হওয়ার ঘণ্টা খানেক আগে রনি ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে বলেন যে, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার এবং আইনজীবীদের সঙ্গে পরবর্তী করণীয় নিয়ে কথা বলছেন৷ তিনি তখন বলেন, তাঁর জামিন বতিল করা হলেও আওয়ামী লীগ নেতা সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছ না৷ অথচ একই ঘটনায় ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের মালিক সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন রনি৷
গত শনিবার তোপখানার মেহরাবা প্লাজায় রনির অফিসে নির্যাতনের শিকার হন ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের রিপোর্টার ইমতিয়াজ রনি এবং ক্যামেরাম্যান মোহসিন মুকুল৷ তাঁদের দাবি, দুই কোটি টাকা ঘুস লেনদেন হতে পারে এ খবর পেয়ে তাঁরা ঐ অফিসে গিয়েছিলেন৷
এদিকে রনিকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় সাংবাদিকরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷ তবে গত ১৫ মাসেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির হত্যাকারীরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা৷ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, রনি সরকার দলীয় একজন সংসদ সদস্য, সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করায় সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য৷ কিন্তু সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না কেন? তিনি বলেন, সরকার অবশ্যই জানে সাগর-রুনির হত্যাকারী কারা৷ কিন্তু এরপরেও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না৷ তাই সরকারের এই দ্বৈত নীতির সমালোচনা করেন ইলিয়াস খান৷
সাগরের মা সালেহা মনির ডয়চে ভেলেকে বলেন, সরকার ইচ্ছা করেই সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করছে না৷ তিনি মনে করেন, তদন্তকারীরা অবশ্যই হত্যাকারীদের চিহ্নিত করেছে৷ কিন্তু সরকারের কাছের লোক হওয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না৷ নানা নাটক আর ডিএনএ পরীক্ষার নামে সময় কাটানো হচ্ছে৷ তিনি প্রশ্ন করেন, একজন সংসদ সদস্যও যেখানে সাংবাদিক নির্যাতন করে রেহাই পায় না সেখানে সাগর-রুনির হত্যাকারীরা কত শক্তিশালী যে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে? তারা সরকারের কত কাছের লোক তা জানতে চান সালেহা মনির৷