সাধারণ নির্বাচনের প্রায় ৪ মাস পর জার্মানিতে সরকার গঠনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে৷ দুই রাজনৈতিক শিবির মহাজোট সরকারের রূপরেখা তুলে ধরেছে৷ এবার শুধু এসপিডি দলের সদস্যদের সম্মতির অপেক্ষা৷
বিজ্ঞাপন
বুধবার সকালে জার্মানিতে প্রস্তাবিত মহাজোট সরকারের কোয়ালিশন চুক্তি চূড়ান্ত রূপ পাবার পর দুপুরে সিডিইউ, সিএসইউ ও এসপিডি দলের শীর্ষ নেতারা এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সাফল্যের ঘোষণা করেন৷ চ্যান্সেলর ও সিডিইউ দলের নেত্রী আঙ্গেলা ম্যার্কেল, বাভেরিয়ার সিএসইউ দলের শীর্ষ নেতা হর্স্ট সেহোফার ও এসপিডি নেতা মার্টিন শুলৎস একযোগে প্রস্তাবিত সরকার সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন৷
শেষ মুহূর্তে আলোচনার পরিবেশ স্পষ্ট করে দিচ্ছিলো, যে নতুন করে মহাজোট সরকার গঠন করতে দুই পক্ষের সদিচ্ছার অভাব নেই৷ সাফল্যের জন্য দুই পক্ষের উপর প্রবল চাপও কাজ করছে৷ তীরে এসে তরি ডুবলে দুই পক্ষেরই ভাবমূর্তির ক্ষতি হতো৷ সেই অবস্থায় বিকল্প হিসেবে নতুন নির্বাচনের মুখোমুখি হওয়া তাদের জন্য কঠিন হতে পারতো৷ অতএব বাকি সব বিষয়ে ঐকমত্যের পর হাতে গোনা কয়েকটি ইস্যুতে মতপার্থক্যের কারণে সরকার গড়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে দেননি দলের নেতারা৷
কোয়ালিশন চুক্তি চূড়ান্ত হবার পর মন্ত্রিসভার রূপরেখা ও মন্ত্রী পদের বণ্টনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ সেই প্রশ্নেও দর কষাকষির অবকাষ কম নয়৷ কোয়ালিশন চুক্তির মধ্যে নিজস্ব স্বাক্ষর তুলে ধরতে চায় দুই শিবিরই৷ দলের অ্যাজেন্ডা কার্যকর করতে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে মন্ত্রিত্বের দাবিতে অটল থেকেছে ৩ দলই৷ এ ক্ষেত্রে এসপিডি দলের উপর বিশেষ চাপ কাজ করেছে৷ কারণ দলের সদস্যরা ভোটের মাধ্যমে সম্ভাব্য কোয়ালিশন চুক্তি অনুমোদন না করলে মহাজোট সরকার গঠন করাই সম্ভব হবে না৷ অতএব ইউনিয়ন শিবিরকেও বাধ্য হয়ে যতটা সম্ভব ছাড় দিতে হয়েছে৷ সরকার গড়া সম্ভব হলে ছোট শরিক দল হওয়া সত্ত্বেও এসপিডি পররাষ্ট্র, অর্থ ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেতে চলেছে৷
সিডিইউ নেত্রী আঙ্গেলা ম্যার্কেল মঙ্গলবারই বলেছিলেন, সব পক্ষকে কষ্ট সহ্য করে অনেক ছাড় মেনে নিতে হবে৷ এসপিডি নেতা মার্টিন শুলৎস বুধবারকে ‘সিদ্ধান্তের দিন’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন৷ বাকি দলগুলি নতুন মহাজোটের রূপরেখার সমালোচনা করে বলছে, দুই বড় দলের বিদায়ী সরকারের স্থবিরতা অপরিবর্তিত থাকছে৷ শুধু বাড়তি অর্থ ব্যয় করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে৷
বছরের শুরু থেকে এসপিডি দলের সদস্যসংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে গেছে৷ ২৪,৩৩৯ ব্যক্তি দলের খাতায় নাম লিখিয়েছেন৷ ফলে এই মুহূর্তে মোট ৪৬৩,৭২৩ জন সদস্যের ভোটাধিকার রয়েছে৷ তবে এই সাফল্যের পেছনে দলের যুব শাখার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে৷ মহাজোটের বিরোধিতা করতেই তারা প্রচার চালিয়ে অনেক নতুন সদস্য আকর্ষণ করতে পেরেছে৷ ভোটাভুটির সময় সেই বিরোধিতার প্রতিফলন ঘটলে সম্ভাব্য মহাজোট সরকারের প্রতি সমর্থন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে৷ সেক্ষেত্রে দলের গোটা নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে৷
এসবি/এসিবি
কী চায় জার্মানির এসপিডি দল?
ছোট শরিক হয়েও জার্মানির বিদায়ী মহাজোট সরকারে যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে অনেক দলীয় সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পেরেছে এসপিডি দল৷ তবে ভোটাররা তার স্বীকৃতি দেয়নি৷ আবার মহাজোটে যোগ দিলে অনেকগুলি শর্ত চাপাতে চায় এসপিডি৷
ছবি: picture-alliance/U. Baumgarten
‘আরও ইউরোপ’
বর্তমান সংকটগুলির সমাধানের লক্ষ্যে ব্রেক্সিটের পথে না গিয়ে ইইউ-কে আরও শক্তিশালী করে তুলতে চায় জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ ইউরোপীয় স্তরে ন্যূনতম মজুরি, তরুণদের বেকারত্বের মোকাবিলা, কোম্পানিগুলির উপর অভিন্ন কর চাপানো এবং ‘কর ফাঁকির মরুদ্যান’ বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন দলের নেতা মার্টিন শুলৎস৷ ২০২৫ সালের মধ্যে ‘ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্র’ স্থাপনের স্বপ্ন দেখছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এই প্রাক্তন স্পিকার৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. Florin
শ্রমিকদের আরও অধিকার
জার্মানিতে শ্রমিক-কর্মীদের অধিকার বাড়াতে চিরকাল উদ্যোগ নিয়ে এসেছে সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ তবে সাম্প্রতিক কিছু সংস্কারের ফলে সেই ভাবমূর্তি বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছে৷ এবার বেতন ও মজুরি কাঠামো কার্যকর করা ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার দাবি জানাচ্ছে এসপিডি৷ তাছাড়া যারা পার্ট টাইম বা খন্ডকালীন কাজ করছে, তাদের ফুল টাইম বা পূর্ণ কাজের কাঠামোয় ফিরে যাবার অধিকারের স্বীকৃতি চায় এসপিডি৷
ছবি: picture-alliance/Ulrich Baumgarten
অবসর ভাতার আমূল পরিবর্তন
সমাজে সংহতির ভিত্তিতে জার্মানির অবসর ভাতা কাঠামোর আমূল পরিবর্তন চায় সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ বিশেষ করে সারা জীবন কাজ করেও শেষ বয়সে দারিদ্র্যের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চায় এসপিডি৷ অতএব সংহতির স্বার্থে অবসর ভাতার বিচ্ছিন্ন সব কাঠামোগুলিকে একত্র করার চেষ্টা চালাতে চায় তারা৷ অত্যন্ত জটিল এই ব্যবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন যে কঠিন হবে, সে বিষয়ে অবশ্য তেমন সংশয় নেই৷
ছবি: picture-alliance/S. Gollnow
বিনামূল্যে শিক্ষা
জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় অংশই সরকারি ভরতুকিতে চলে৷ তবে অবকাঠামোর কিছু দুর্বলতার ফলে সমস্যা রয়েছে৷ বিশেষ করে শিক্ষা রাজ্য সরকারগুলির এক্তিয়ারে থাকায় এ ক্ষেত্রে সার্বিক উদ্যোগ নেওয়া কঠিন৷ এসপিডি দলের দাবি, সারা দেশে বিনামূল্যে কিন্ডারগার্টেন ও সেখানে সারাদিন বাচ্চা রাখার সুযোগকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে৷ এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির আধুনিকীকরণসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগ চাই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gambarini
স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থার সংস্কার
বর্তমানে জার্মানিতে সার্বজনীন ও বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা চালু রয়েছে৷ ডাক্তারখানা ও হাসপাতালে বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমাকারীদের বিশেষ খাতির করা হয়, অন্যদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়৷ এই বিভাজন ঘুঁচিয়ে সবাইকে নিয়ে এক ‘নাগরিক স্বাস্থবিমা’ চালু করতে চায় সামাজিক গণতন্ত্রীরা৷ তবে এই প্রস্তাবের জোরালো বিরোধিতা করছে বেশ কিছু মহল৷ তাদের আশঙ্কা, এর ফলে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মানের ক্ষতি হবে৷
ছবি: Colourbox
শরণার্থী নীতি
২০১৫ সালে বিশাল সংখ্যক শরণার্থীর ঢলের কারণে জার্মানির রাজনীতি জগত উত্তাল হয়ে উঠেছে৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেল তাঁর উদার মনোভাবের জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ এসপিডি গোটা অভিবাসন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের দাবি জানাচ্ছে, যাতে আইনি পথে বিদেশিরা জার্মানিতে এসে কাজের সুযোগ পায়৷ তবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের অধিকার সঙ্কুচিত করার বিরোধী এই দল৷ আশ্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঊর্ধসীমাও মানতে নারাজ তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সন্ত্রাসী হামলা ও অপরাধ দমন করতে প্রায়ই হিমশিম খায় জার্মানির পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ৷ ফলে মানুষের মনে অসন্তোষ দেখা যায়৷ এই সমস্যার মোকাবিলা করতে এসপিডি দল আরও পুলিশকর্মী নিয়োগের দাবি জানাচ্ছে৷ সেইসঙ্গে অপরাধ প্রতিরোধ করার জোরালো উদ্যোগ চায় তারা৷ তাদের মতে, দাগী অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে গোটা ব্যবস্থায় আরও দক্ষতার ছাপ আনতে হবে৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/B. Marks
পরিবেশ সংরক্ষণ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে এককালে জার্মানি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে৷ বিকল্প জ্বালানির বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্যও এসেছে৷ কিন্তু কয়লার লাগাতার ব্যবহার, ডিজেল গাড়ি নিয়ে বিতর্কের মতো কারণে এ ক্ষেত্রে জার্মানির ভাবমূর্তি বেশ ধাক্কা খাচ্ছে৷ এমন প্রেক্ষাপটে এসপিডি বিকল্প জ্বালানির আরও ব্যবহারের উপর জোর দিতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নারী-পুরুষের সমানাধিকার
শিল্পোন্নত দেশগুলিতেও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য বাস্তব সমস্যা৷ এই তালিকায় জার্মানির অবস্থান ভালো নয়৷ একাধিক সরকার এই বৈষম্য দূর করতে শিল্প-বাণিজ্য জগতের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে৷ এবার এসপিডি দল চায়, আলাপ-আলোচনার বদলে আইন করে তাদের এই বৈষম্য দূর করতে বাধ্য করা হোক৷