হেফাজতের আন্দোলন ঘিরে ‘ধর্মীয় উন্মাদনা ও উচ্ছৃঙ্খলতা’ বন্ধ না করলে সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে বলে হুঁশিয়ার করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ অন্যদিকে, মাদ্রাসায় ‘হামলা ও জুলুম’ বন্ধের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন বাবুনগরী৷
হেফাজতের হরতালের সময় তৎপর ছিল নিরাপত্তা বাহিনীছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
বিজ্ঞাপন
হেফাজতে ইসলামের গ্রেপ্তারকৃত নেতা-কর্মীদের মুক্তি না দিলে পাল্টা কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন সংগঠনটির আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী৷
এদিকে, হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম দাবি করেছেন, গত তিন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাদের ১৭ জন নেতাকর্মী মারা গেছে৷ তবে, সরকারি তরফ থেকে ১২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে৷ নেতাকর্মীদের উপর হামলা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম নতুন করে দোয়া ও বিক্ষোভের কর্মসূচি দিয়েছে৷ সোমবার হবে দোয়া, এরপর শুক্রবার সারা দেশে তারা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে৷
‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আটজনের মৃত্যু হয়েছে’
This browser does not support the audio element.
হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের ঢাকায় অবস্থান করা নেতারা হিসেব করেই ১৭ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছেন৷ এর মধ্যে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মারা গেছে ১২ জন৷''
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রবিবার সারাদেশে হরতাল ডেকেছিল হেফাজত৷ কর্মসূচি শেষে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মহাসচিব বলেন, ‘‘এ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের ১২ জন নিহত হয়েছে৷ এছাড়া চট্টগ্রামে চারজন ও ঢাকায় একজনের মৃত্যু হয়েছে৷''
বিপুল সংখ্যক কর্মীকে গ্রেফতারের কথাও বলেন তিনি৷ তবে সাংবাদিক সম্মেলনে নিহতদের পরিচয় উল্লেখ করেননি তিনি৷
৫০ বছরেও ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র না পাওয়ার আক্ষেপ
বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থান করে নেয়ার ৫০ বছর পূর্তিতে এ দেশের অগ্রযাত্রায় মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দিত৷ কিন্তু অনেকে মনে করেন এখনো ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এখনো গন্তব্য বহুদূর৷
ছবি: picture alliance/Pacific Press Agency/B. H. Rana
‘সঠিক ইতিহাস প্রজন্ম যেন জেনে নেয়’
বরিশালের সৈয়দ আবদুল মালেক একাত্তরে যুদ্ধ করেন নয় নম্বর সেক্টরে৷ ডান পায়ে গুলি লাগে৷ এখনও স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না৷ ১৯৭৩ সালে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দেন পটুয়াখালিতে, দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে অবসরে যান সচিব হিসেবে৷ তিনি বলেন, ’’দেশের জমি কমেছে, মানুষ বেড়েছে, তবুও খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন আমরা৷ কর্মসংস্থান ও আয় বেড়েছে৷ এগুলো দেখলেই তৃপ্ত হই৷ তবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটা প্রজন্ম যেন জেনে নেয়৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘বাংলাদেশ পেয়েছি, এটাই বড় পাওয়া’
সাব-সেক্টর কমাণ্ডার মাহফুজ আলম বেগ ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের এলিট কমান্ডো৷ একাত্তরে কৌশলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন৷ স্বাধীনতার পর চাকরি জীবন শুরু করেন, সবশেষ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন৷ এখনও স্বপ্ন দেখেন দেশকে নিয়ে৷ বললেন, ‘‘বাংলাদেশ পেয়েছি, এটাই বড় পাওয়া৷ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এর চেয়ে বড় সফলতা আর কী আছে!’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এখনো হয়নি’
রমা রানী দাস ট্রেনিং নেন ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগের কাছে৷ নয় নম্বর সেক্টরের অধীনে সাতক্ষীরা, ভোমরা, আসাশুনিতে গুপ্তচরের ভূমিকা পালন করতেন৷ স্বাধীনতার পর ঝালকাঠি হরচন্দ্র সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেন৷ দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত৷ তবে রমা রানী বলেন, ‘‘স্বাধীন দেশে ভালো আছি৷ তবে অসাম্প্রদায়িক দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম৷ সেটা এখনও হয়নি৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘ধর্মনিরপেক্ষতা বাধার মুখে পড়েছে’
ডা. মোহাম্মদ সিরাজুল হক একাত্তরে ধলেশ্বরীতে জোনাল কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন৷ স্বাধীনতার পর যোগ দেন চিকিৎসা পেশায়৷ স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রথম ট্রেজারার তিনি৷ সব মিলিয়ে তৃপ্ত হলেও একটা আক্ষেপ আছে তার, ‘‘বঙ্গবন্ধু টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া মুসলমানদের নিয়েই একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে সেই ধর্মনিরপেক্ষতার দিকটা বাধার মুখে পড়েছে৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
মানুষের ‘মানুষ’ পরিচয়টাই যেন বড় হয়
সিলেটের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আহম্মদ বাবু একাত্তরে ট্রেনিং নেন আসামে৷ চার নম্বর সেক্টরে দিলখুশা চা বাগান অপারেশনে সাবমেশিন গানের গুলিতে তার বাম পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ স্বাধীনতার পর ব্যবসা শুরু করেন৷ এখন সানি স্যোলার লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি দেখতে চাই না– তুমি হিন্দু কি মুসলমান৷ দেখতে চাই, তুমি মানুষ কিনা, তুমি বাংলাদেশকে ভালবাসো কিনা, তুমি বাঙালি কিনা৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘গণতন্ত্রের নামে যেন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হয়’
মো. সাইফুল আলম আট নম্বর সেক্টরে গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন৷ স্বাধীনতার পর আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন৷ সহকারি জজ, জেলা জজের দায়িত্ব শেষে দুদকের মহাপরিচালক হিসাবে অবসরে যান৷ তিনি বলেন, ‘‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ৷ গণতন্ত্রের নামে যেন পরোক্ষ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না পায় সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার৷ ফাইনান্সিয়াল অফেন্স, আর সেক্সচুয়াল অফেন্স কমিয়ে আনতে না পারলে সোনার বাংলা হবে না৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘তৃণমূলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে হবে’
অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন একাত্তরে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন দুই নম্বর সেক্টরে৷ নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা, উপ-উপাচার্য ছিলেন চার বছর৷ অবসরের পরও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনারারি প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন৷ বললেন, ‘‘তৃণমূলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে আনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো প্রজন্ম দেখুক’
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে করিমপুর ইয়ুথ ক্যাম্পের সঙ্গে সহকারি প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন যুদ্ধ-আলোকচিত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ রায়হান৷ পরে বাংলাদেশ ভলান্টারি সার্ভিসেস কোর-এর আলোকচিত্রী হিসেবে যোগ দেন৷ মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ও ঘটনা ক্যামেরায় ধরে রেখেছেন৷ এই আলোকচিত্রী বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো প্রজন্ম দেখুক৷ ছবি দেখে প্রজন্ম ভাবুক কত কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে আমার স্বাধীনতা পেয়েছি৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
8 ছবি1 | 8
এদিকে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শওকত আলী ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘গত তিন দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আটজনের মৃত্যু হয়েছে৷ এর মধ্যে শুক্রবার একজন, শনিবার পাঁচজন ও রবিবার দুইজন৷''
তবে, ডেইলি স্টার পত্রিকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি মাসুক হৃদয় ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘রবিবার তিনজনের মৃত্যু হয়েছে৷ নিহত তিনজনের লাশ তিনি দেখেছেন৷''
তার হিসেবে গত তিন দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নয়জনের মৃত্যু হয়েছে৷
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘‘শুক্রবার চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যু হয়েছে৷'' এছাড়া, রবিবার হরতাল চলাকালে ঢাকার সাইনবোর্ড এলাকায় সংঘর্ষের সময় একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে হেফাজত দাবি করলেও স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেনি৷ সব মিলিয়ে সংঘর্ষে ১২ জনের মৃত্যুর খবর নিরাপত্তা বাহিনী নিশ্চিত করেছে৷
প্রসঙ্গত, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় গত তিন দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর, সংঘাত ও প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রবিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘গত দুইদিন যাবত কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ধর্মীয় উন্মাদনায় চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, সরাইল এবং আশুগঞ্জে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করছে৷ যার মধ্যে উপজেলা পরিষদ, থানা ভবন, সরকারি ভূমি অফিস, পুলিশ ফাঁড়ি, রেল স্টেশন, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের বাড়িঘর, প্রেসক্লাবসহ জানমালের ক্ষতি করে যাচ্ছে৷ এ জাতীয় ক্ষতিসহ সকল প্রকার উচ্ছৃঙ্খল আচরণ বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে আহ্বান জানানো হচ্ছে৷ অন্যথায়, সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবে৷''
‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের ১২ জন নিহত হয়েছে’
This browser does not support the audio element.
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি মাসুক হৃদয় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, আবারও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন'৷ রবিবার দুপুরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ'র স্মৃতিধারক প্রতিষ্ঠানটিতে আগুন দেয় হরতাল সমর্থনকারী হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা৷ এসময় তারা পুরো সঙ্গীতাঙ্গনে ভাঙচুর চালায়৷ একটি জাদুঘর, তিনটি ক্লাসরুম, সরোদ মঞ্চ, প্রশাসনিক কক্ষ ও স্টোররুমে থাকা বাদ্যযন্ত্র, চেয়ার-টেবিল ও অন্যান্য আসবাবপত্রসহ সবকিছু ভেঙে তছনছ করে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়৷
এদিকে, মুন্সিগঞ্জে হেফাজতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় সিরাজদিখান থানার ওসি এসএম জালাল উদ্দিন গুরুতর আহত হয়েছেন৷ সংকাটপন্ন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ এছাড়াও সেখানে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন৷