ভারতে নতুন সরকার গঠন নিয়ে বিজেপি শিবিরে তৎপরতা এখন তুঙ্গে৷ দলীয় নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন ভাবী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ পরামর্শ নিচ্ছেন দলের বর্ষিয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আডবানির৷
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও মোদী চান শরিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গড়তেছবি: AP
বিজ্ঞাপন
নব নির্বাচিত বিজেপি সাংসদরা দিল্লির গুজরাট ভবন এবং বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং-এর বাসভবনে যাতায়াত করছেন৷ তবে মোদীর রয়েছে একেবারে নিজস্ব টিম, যারমধ্যে আছেন অরুণ জেটলি, যিনি নির্বাচনে হেরে গেলেও সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য৷ আরও আছেন দলের সাবেক সভাপতি নিতিন গডকড়ি, বর্তমান সভাপতি রাজনাথ সিং এবং উত্তর প্রদেশে মোদী তথা বিজেপির বিপুল জয়ের স্থপতি অমিত শাহ৷
মন্ত্রিসভা গঠনে নরেন্দ্র মোদী দলের বর্ষিয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আডবানির পরামর্শ নিচ্ছেনছবি: Raveendran/AFP/Getty Images
সংসদের মোট ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৮৫টি আসনের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও মোদী চান ভোট-পূর্ব শরিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ অর্থাৎ ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক অ্যালায়েন্স' সরকার গড়তে৷
মঙ্গলবার ২০শে মে বিজেপির সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদীর নাম প্রস্তাব করা হবে৷ তারপর জোটের অন্যান্য শরিক দলগুলির অনুমোদন নেয়া হবে এবং সেইমত রাষ্ট্রপতির কাছে তা পেশ করা হবে৷ শপথ গ্রহণের দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি৷
নব নির্বাচিত কিছু সাংসদ দিল্লি সংঘ পরিবারের অফিসে যাতায়াত করলে সেখান থেকে বলা হয়, সরকার গঠনে সংঘ পরিবার হস্তক্ষেপ করতে রাজি নয়৷ সরকার গঠনে তারা ‘রিমোট কন্ট্রোল' হবে না৷ তবে সরকার পরামর্শ চাইলে তা দিতে আপত্তি নেই৷ উল্লেখ্য, সংঘ পরিবারেই মোদীর রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল বাল্যকাল থেকে৷
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবিদার সুষমা স্বরাজছবি: AP
ভাবী প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর মন্ত্রিসভায় কাকে কাকে নেবেন সে বিষয়ে তিনিই যে শেষকথা বলবেন দলের কাছে তা গোপন রাখেননি৷ তাই দলের সভাপতি রাজনাথ সিং, অরুণ জেটলি, অমিত শাহ এবং নিতিন গডকড়ির মন্ত্রিসভায় যাওয়া মোটামুটি নিশ্চিত, এমনটাই সকলে মনে করছেন৷ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মোদীর পরেই শপথ নেবেন রাজনাথ সিং৷ বুঝিয়ে দেয়া হবে সরকারের দুই নম্বর ব্যক্তিটি হবেন রাজনাথ সিং৷ বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় যেমনটা ছিলেন আডবানি৷ অরুণ জেটলি হয়ত পেতে পারেন অর্থ মন্ত্রক এবং রাজনাথ সিং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক৷ বিগত সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় দলীয় নেত্রী সুষমা স্বরাজকে নিয়ে মোদীর অস্বস্তি রয়েছে৷ নির্বাচনের আগে মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করায় রীতিমত বিরোধিতা করেছিলেন সুষমা স্বরাজ৷ সেই থেকে মোদীর সঙ্গে সম্পর্কটা খুব মধুর নয়৷ এখন তিনি মোদী সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দাবিদার হয়ে জোর চাপ তৈরি করার চেষ্টা করছেন বলে শোনা যাচ্ছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, মোদীর কাছে পররাষ্ট্র দপ্তর হলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ বিদেশে মোদীর ভাবমূর্তি নিয়ে যে বিরূপ ভাব রয়েছে তা দূর করার কাজে সুষমা স্বরাজ কতটা সহায়ক হবেন, তা নিয়ে মোদীর সঙ্গে তাঁর একটা আস্থার ঘাটতি রয়ে গেছে৷ দলের প্রবীণতম নেতা লালকৃষ্ণ আডবানিকে সংসদের স্পিকার হবার অনুরোধ করা হতে পারে৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
সরকার বদলের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে মোদী সরকার কতটা সফল হবেন সেটাই আসল কথা৷ কারণ এমন একটা স্থিতিশীল সরকার গড়েও যদি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অপূর্ণ থেকে যায়, নির্বাচনি ইশতাহারে সার্বিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, অবকাঠামোর উন্নতি, বিনিয়োগ, প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার, দুর্নীতি দমন ইত্যাদির যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে তার বেশিরভাগ যদি কার্যকর করা না হয়, তাহলে মানুষ মোদী সরকারকে ছেড়ে কথা বলবে না৷
এদিকে নির্বাচনি বিপর্যয়ের পর দিল্লির কংগ্রেস সদর দপ্তরে বসে কংগ্রেস কর্ম সমিতির বৈঠক৷ পৌরহিত্য করেন সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী৷ দলের নির্বাচনি ভরাডুবির জন্য কে দায়ী, কৌশলনীতিতে কোথায় খামতি ছিল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলে৷ তবে ভোটে দলের দায়িত্ব কার্যত যার কাঁধে ছিল সেই রাহুল গান্ধীকে দল আড়াল করতে চাইছে এই বলে যে, এই বিপর্যয়ের দায়িত্ব দলের সবার৷ কিছু নেতা মুখ খুলে বলেছে কংগ্রেস কর্মসমিতির সদস্যদের মনোনীত করার বদলে দলের গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে করা উচিত৷