সাংবাদিক দম্পতি সাগর- রুনি হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর হয়ে গেলেও এখনো কোনো অপরাধী ধরা পড়েনি৷ সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মুনির মনে করেন, ‘‘সরকার ইচ্ছা করলে (অপরাধীদের) অনেক আগেই বের করতে পারতো৷ এখনো ইচ্ছা করলে পারে৷’’
বিজ্ঞাপন
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোর রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজারবাগের বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি৷ ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বেঁচে আছে তাঁদের একমাত্র শিশু পুত্র মাহির সরওয়ার মেঘ৷ কিন্তু গত পাঁচ বছরেও পুলিশ মামলার তদন্তে কেনো অগ্রগতির খবর দিতে পারেনি৷ অপরাধীদের চিহ্নিত বা আটকও করতে পারেনি৷ গতকাল ৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলার তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয়ার কথা থাকলেও তদন্তকারী সংস্থা র্যাব তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে৷ আর এ কারণে আদালত তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি মহিউদ্দিন আহমেদকে ২১ মার্চ তলব করেছেন৷
সরকার ইচ্ছা করলে অনেক আগেই বের করতে পারতো: সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মুনির হতাশা নিয়েই ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার আশা করেছিলাম পুলিশ কোনো অগ্রগতির খবর দেবে৷ আমি নিশ্চিত ভেবে ছিলাম সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ব্যাপারে তথ্য দেবে র্যাব৷ কিন্তু আদালতে তারা কেনো খবর দিতে পারেনি৷ যা আমাকে হতাশ করেছে৷ কিন্তু আমি কখনোই আশা ছাড়বো না৷ আমি আমার ছেলের খুনিদের দেখতে চাই৷ আমৃত্যু আমি বিচারের দাবি করেই যাবো৷’’
তিনি জানান তদন্তে অগ্রগতি না থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তারা মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘কয়েকদিন আগে তদন্ত কর্মকর্তা বাসায় এসে আমার খোঁজ খবর নিয়েছেন৷ আমি তদন্তের অগ্রগতির খবর জানতে চাইলে শুধু বলেছেন, আপনার ছেলে তো শহীদ৷ অবশ্যই কিছু হবে৷’’
সালেহা মনির বলেন,‘‘সরকার ইচ্ছা করলে (অপরাধীদের) অনেক আগেই বের করতে পারতো৷ এখনো ইচ্ছা করলে পারে৷ আমার মনে হয়, এখনো তারা ধরা পড়বে, বিচার হবে৷ নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার বিচার হলে আমার সন্তানের হত্যার বিচার হবে না কেন?’’
তদন্ত কর্মকর্তা এখন আর যোগাযোগ করেন না: রুনির ভাই
বিচার কেন হচ্ছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সেটা আমারও প্রশ্ন৷ আমার মনে হয়, কোথাও এটা প্যাঁচ বা গিট্টু আছে, সেটা কি আমি জানি না৷’’
প্রয়াত সাংবাদিক মেহেরুন রুনির ভাই নওশের রোমান তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তদন্ত কর্মকর্তা এখন আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না৷ ফলে মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতি সম্পর্কে আমরা জানিনা৷ আমরা আশাহত৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, তাঁর কাছে তদন্তের অগ্রগতির কোনো খবর নাই, তখন আমরা বিচারের আশা করব কিভাবে?’’
সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ এখন ক্লাস ফোর-এ পড়ে৷ নওশের জানান, ‘‘মাহির এখন অনেকটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে৷ তবে বাবা-মায়ের ছবি দেখলে বা কোনো ঘটনা মনে পড়লে মাঝে মাঝে সে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে৷’’
‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ বাংলাদেশে এখন একটি অতি উচ্চারিত শব্দযুগল৷ বিচার হচ্ছে না কিংবা বিচারের অপেক্ষায় আছে এমন কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: dapd
ব্লগার হত্যা
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এরপর একে একে হত্যার শিকার হন ব্লগার নীলাদ্রী নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের কোনোটির বিচারে ‘উল্লেখযোগ্য’ অগ্রগতি না হওয়ায় সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান৷
ছবি: Privat
সাংবাদিক দম্পতি হত্যা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়৷ গত চার বছরে এই মামলার তদন্ত থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ হয়ে র্যাব-এর হাতে পৌঁছেছে৷ গত মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রত্যেক হত্যাকাণ্ড তদন্তের মাধ্যমে তার বিচার করতে পেরেছি৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড অন্য কথা৷ ওটা এখানে না আসাই ভালো৷’’
ছবি: DW
ধর্ষণের বিচার
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৬৬০ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ অথচ কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
ত্বকী হত্যা
নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ হত্যা করা হয়৷ হত্যার দুদিন পর শীতলক্ষ্যার একটি খালে তার লাশ পাওয়া যায়৷ রাষ্ট্রের অনিহা থাকায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার থমকে আছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেন রফিউর রহমান রাব্বি৷ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাংসদ শামীম ওসমানের পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Facebook/Taqi.Mancha
তনু হত্যা
চলতি বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়ার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ উঠেছিল৷ দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি উঠেছিল৷ কিন্তু এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷ তবে তদন্তকাজ চলছে৷
ছবি: Twitter
শিল্প কারখানায় দুর্ঘটনা
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারশ’র বেশি মানুষের প্রাণ যায়৷ এর মধ্যে বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক ছিল৷ তিন বছরেরও বেশি সময় পর গত জুলাইতে এই ঘটনায় করা হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়৷ ঢাকার এক অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ বছরে উল্লেখ্যযোগ্য শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮টি৷ এর কোনোটিরই বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি৷ প্রতিবেদনটি পড়তে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নীচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ ঘটনার দিনই তাঁর ভাই গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন৷ এই অভিনেতা খুন হওয়ার পর চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও এখনও মামলার বিচার শুরু করা যায়নি৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: bdnews24.com
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন৷ এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা – দু’টিই হবিগঞ্জে দায়ের হলেও পরে সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়৷
ছবি: Facebook/Justice-for-Shah-AMS-Kibria
হতাশ রামুর ক্ষতিগ্রস্তরা
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালিয়ে ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক৷ ঐ ঘটনার চার বছর পরও মামলা গতিশীল না হওয়ায় হাতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা৷ পিপি মমতাজ আহমদ সম্প্রতি বলেন, এই হামলার ঘটনায় দায়ের করা ১৯টি মামলায় ইতোমধ্যেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: AFP/Getty Images
নারী নির্যাতনের মামলা ৫,০০৩টি, রায় ৮২০টির
২০১৫ সালে প্রকাশিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ বলছে, গত নয় বছরে দেশের নয়টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২,৩৮৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নেন৷ এই ঘটনাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে এ সব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫,০০৩টি৷ রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের৷ শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার ০.৪৫ শতাংশ৷