1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘সরকার চায় না শিক্ষার মান বাড়ুক’

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৭ জুন ২০২২

ইউনেস্কো যেখানে বলছে, বাজেটের অন্তত ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে শিক্ষা খাতে৷ সেখানে আমাদের দেশে গত বছরের চেয়ে এবার বাজেটে বরাদ্দ কমেছে৷

ছবি: Getty Images

গত বছর ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ, এবার সেখানে ১ দশমিক ৮৮ শতাংশ৷কেন সরকার শিক্ষা খাতে বাজেটে বরাদ্দ কমাচ্ছে? সরকার কি শিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্ব কম দিচ্ছে? সরকার কি চায় না, শিক্ষিত মানুষ বাড়ুক? ডয়চে ভেলের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান৷

ডয়চে ভেলে : শিক্ষা খাতের মূল সংকট কি বাজেট?

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান: না৷ কোনটা আগে আর কোনটা পরে, বিষয়টা সেরকম৷ যেমন মুরগি আগে না ডিম আগে বিষয়টা এমন৷ প্রথমে আমাদের দর্শনটা ঠিক করতে হবে৷ আমরা আসলে কী চাই? শিক্ষাকে উন্নত করতে চাই কি চাই না? এই সিদ্ধান্তটা সরকারকে আগে নিতে হবে৷ তারপরে এটা বাস্তবায়নে কী বাধা সেটা দেখতে হবে৷ ২০ কোটি মানুষের দেশে আমাদের তো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই৷ আমাদের একমাত্র সম্পদ হলো মানুষ৷ এখন আমরা কি এই মানুষদের সম্পদ বানাবো কি না? এই সম্পদ বানানোর একমাত্র পথ হলো শিক্ষা৷

‘শিক্ষাখাতে মেগা প্রকল্প নিতে হবে’

This browser does not support the audio element.

সরকার কি শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্ব কম দিচ্ছে?   

আমি যদি চারদিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই সরকার চায় না শিক্ষার মানোন্নয়ন হোক৷ অর্থাৎ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ুক সেটা চায়, কিন্তু মান বাড়ুক সেটা চায় না৷ মান বাড়লে অনেক সমস্যা আছে৷ কীভাবে বললাম মান বাড়ুক চায় না? যদি চাইত তাহলে বাংলাদেশের কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদ খালি হয় সরকার খুঁজে বেড়াত একজন ভালো স্কলারকে৷ দেশে না পেলে বিদেশ থেকে নিয়ে আসত বা বাংলাদেশি যারা বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন তাদের নিয়ে আসত৷ আমরা যদি সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই এর কোনো লক্ষণ কি আছে? সরকার ভিসি বানাতে অন্ধ মানুষদের খুঁজে বেড়ায়৷ যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে তারা সেই দলকে যে অন্ধভাবে সাপোর্ট করতে পারবে তাকেই ভিসি বানায়৷ দেশে এখন ৮০০’র মতো কলেজ আছে, সেখানে অর্ধেকের বেশি অধ্যক্ষ পদ শূন্য৷ এসব কলেজে অনার্স পড়ানোর মতো কোনো শিক্ষক নেই৷ আমেরিকাতে দুই হাজারের বেশি লিবারেল আর্টস কলেজ আছে যেখানে শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা পিএইচডি৷ তারাও সাহস করে না মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়ার৷ আর আমাদের কলেজগুলোতে ৯৮ ভাগ শিক্ষক শুধু মাস্টার্স পাস৷ তারা মাস্টার্স পাস হয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি পড়াচ্ছে৷ এগুলো দেখলে মনে হয়, আসলে আমরা কি চাই আমাদের শিক্ষার মান উন্নত হোক? যদি চাইতাম তাহলে শিক্ষকতা পেশাটাকে গুরুত্ব দিতাম৷ একটা ইনডেক্সে বের হয়ে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষার মান তলানিতে৷

বিশ্ব ব়্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায় না, এটা কি শিক্ষা খাতকে অবহেলার কারণেই?

বিশ্ব ব়্যাংকিংয়ে যেতে হলে দেখতে হবে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব়্যাংকিংয়ে আছে সেগুলো কেমন? তাদের বাজেট কেমন? তারা কেমন শিক্ষক নিয়োগ দেয়? নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা কেমন? তাদের ছাত্ররা কেমন পরিবেশে থাকে? কেমনভাবে তারা খাওয়া দাওয়া করে? এগুলো৷ আমাদের দেশে শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তলানিতে৷ যার জন্য শিক্ষার মানও তলানিতে৷ ৩৬ হাজার ছাত্রের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট হওয়া উচিত ন্যূনতম সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা৷ আর আমাদের ৫১টা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাজেট দেওয়া হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা৷ তাহলে শিক্ষার মান কিভাবে ভালো হবে? গত বছর শিক্ষায় ২ দশমিক ০৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল৷ এবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এক দশমিক ৮৮ শতাংশ৷ তাহলে শিক্ষার বাজেট কমল না? যদিও সরকার বলছে, টাকার অংকে এটা বেড়েছে৷ বাড়তি টাকাটা কি জন্য? টাকার মান তো কমেছে৷ ফলে টাকা তো বাড়াতে হবেই৷ তাছাড়া নতুন একটা শিক্ষাক্রম চালু করছে, সেটা জন্য পাইলট প্রজেক্টসহ আনুষঙ্গিক কাজে অতিরিক্ত টাকার দরকার হবে৷ বাড়তি টাকা তো ওর মধ্যেই চলে যাবে৷ ইউনেস্কো বলছে, জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দিতে হবে৷ সেখানে আমরা এবার বাজেট তা আরও কমিয়ে দিয়েছি৷

সরকার কেন শিক্ষা খাতের বাজেট কমাচ্ছে?

এই প্রশ্নের উত্তর তো সরকারই দিতে পারবে৷ আমরা ধারণা করতে পারি৷ আমার মনে হয়, মানুষ বেশি শিক্ষিত হলে প্রতিবাদী হবে৷ মানুষ তার সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে যাবে৷ শিক্ষিত মানুষ যে কোনো সরকারের জন্য বোঝা৷ সরকার চায় সবাই তার সহমত পোষণ করুক৷ বেশি দাবি দাওয়া যেন না করে৷ চোখ কান যেন না খুলে যায়৷ তারা কর্মী হোক, কামলা হোক, কিন্তু শিক্ষিত যেন না হয়৷ উন্নত বিশ্বে শিক্ষকদের ফ্রি টাইম দেওয়া হয়৷ যেন তারা বেশি করে গবেষণা করতে পারে৷ ফ্রি টাইমে শিক্ষকেরা আইডিয়া কনসিভ করে৷ সেটাই মোস্ট ক্রিয়েটিভ টাইম৷ আর আমাদের রেজাল্ট তৈরিসহ কেরানিগিরি করতে হয়৷ শিক্ষকদের এতভাবে ব্যস্ত রাখলে ক্রিয়েটিভ কাজ হবে না৷ আবার যোগ্য শিক্ষকও আমরা নিয়োগ দিচ্ছি না৷ আবার যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে গেলে যোগ্য বেতনও আমরা দিচ্ছি না৷ ফলে পুরো সিস্টেমটাই এমন নষ্ট সিস্টেমে পরিণত হয়েছে৷

আমরা কি শিক্ষাখাতের সংকটগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছি?

পারার ইচ্ছে কি কারও ছিল? আমার মনে হয়, পারার ইচ্ছেই কারও নেই৷ এখন তো ইন্টারনেটের যুগ, সবকিছুই চাইলেই দেখা যায়৷ ভারতের আইআইটি, যেটা বিশ্ব ব়্যাংকিংয়ে ১৭২ তম অবস্থান৷ এটা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও ভালো৷ ওইখানে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বোর্ড চলে যায় আমেরিকায়৷ সেখানে তারা শিক্ষকদের অফার করে, যুক্তরাষ্ট্রে আপনি যে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন, ভারতে আসেন তার চেয়ে বেতন, সুবিধা, সম্মান সবকিছু বেশি দেব৷ ভালো শিক্ষককে হান্ট করে নিয়ে আনতে হয়৷ একটা ভবন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বাড়ে না, ভালো শিক্ষক দিয়ে বাড়ে৷ 

দেশের উন্নয়নে মেগা প্রকল্প না, শিক্ষাখাতে বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন?

আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকলে আমি শিক্ষাখাতে মেগা প্রকল্প নিতাম৷ শুরু করতাম একেবারে প্রাইমারি স্কুল দিয়ে৷ আপনি নরডিক কান্ট্রিগুলো দেখেন, সেখানে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে বেশি৷ সেখানে অনেকের পিএইচডি পর্যন্ত আছে৷ কারণ বাচ্চাদের ডিল করার জন্য অনেক ধৈর্য্য লাগে৷ আপনি ইউরোপ বা আমেরিকার যে কোনো একটা স্কুলে যান, দেখবেন কত বড় খেলার মাঠ, ভবন কি সুন্দর পরিবেশ৷ মানুষ উন্নত না হলে দেশ উন্নত করবে কারা? আমাদের দেশের যত সমস্যা উন্নত মানুষ না থাকার কারণে৷ একাবিংশ শতাব্দিতে এসেও আমরা ঢাকা শহরে যানজট নিয়ন্ত্রণে স্বয়ংক্রিয় বাতির ব্যবস্থা করতে পারিনি৷ এতে বোঝা যায় আমরা শিক্ষায় কোন জায়গায় আছি৷

শিক্ষাখাতে বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার হলে কি কিছুটা উন্নতি হতে পারে?

সঠিক ব্যবহার করার মতো যোগ্য মানুষদের তো আমরা নিয়োগ দেই না৷ আগে তো ঠিক করতে হবে, আমরা চাই কিনা৷ এখন যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তাদের মাধ্যমে যদি বরাদ্দ বাড়ানো হয় তাতেও কোন লাভ হবে না৷ এখানে শিক্ষাখাতে মেগা প্রকল্প নিতে হবে পাশাপাশি যোগ্য লোকদেরও নিয়োগ দিতে হবে৷ অযোগ্য লোকদের হাতে বরাদ্দ বেশি দিলে তলাবিহীন ঝুড়ির মতো হবে৷ উপর দিয়ে দেবেন আর নিচ দিয়ে বের হয়ে যাবে৷

আমাদের যে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হতে যাচ্ছে, সেটা কি ঠিক আছে?

নতুন যে শিক্ষাক্রম হচ্ছে, সেখানে বলা হয়েছে শিক্ষকেরা ৬০ ভাগ ক্রম মূল্যায়ন করবেন৷ এখন বলেন, আমাদের দেশে গ্রামে বা শহরে কোনো স্কুলের শিক্ষক কি ক্রম মূল্যায়নের জন্য সেই পরিমাণ যোগ্য? ওই এলাকার এমপি, মন্ত্রী বা সরকার দলীয় কোনো নেতা বা আর্থিকভাবে প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তির ছেলে বা মেয়েকে কম নম্বর দেওয়ার ক্ষমতা কি কোনো শিক্ষকের আছে? তদবির অমান্য করার ক্ষমতা কি আমাদের শিক্ষকদের আছে? এই মূল্যায়নের আগে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে৷ সৃজনশীল শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে চালু করার কারণে যে ডিজাস্টার হয়েছে, এখানেও একই ধরনের ডিজাস্টার হবে৷

সার্বিকভাবে শিক্ষার উন্নয়নে কী করা যেতে পারে?

সবাই মিলেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা শিক্ষাকে একটা আলাদা জায়গায় রাখব৷ ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির পার্ট হবে না৷ শিক্ষার মান বাড়াতে চাইলে বাজেট বাড়াতে হবে৷ ছাত্রদের তাদের মতো করে চলতে দিতে হবে৷ তাদের ন্যূনতম থাকা খাওয়ার পরিবেশ দিতে হবে৷ যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিতে হবে৷ শিক্ষকদের আলাদা উন্নত বেতন স্কেল দিতে হবে৷ যাতে ওই শিক্ষক যেখানে শিক্ষকতা করেন তার বাইরে অন্য কোথাও খণ্ডকালীন পড়ানো বা কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হবেন না৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ