করোনায় আর্থিক ক্ষতির প্রণোদনা নিয়ে রোববার প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করবেন৷ সেখানে বিভিন্ন খাতে প্রণোদনার বিষয়গুলো স্পষ্ট করবেন৷ এখন পর্যন্ত পোশাক খাত ছাড়া আর কারো জন্যই প্রণোদনার কথা বলা হয়নি৷
বিজ্ঞাপন
এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রণোদনার পাঁচ হাজার কোটি টাকা শ্রমিকদের বেতনের জন্য ব্যয় করা হবে৷ আর এটা শতকরা দুই ভাগ সুদে ঋণ হিসেবে দেয়া হচ্ছে৷ যেসব প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে শতকরা ৮০ ভাগ উৎপাদিত পণ রপ্তানি হয়, তারাই এই প্রণোদনা পাবে৷ আর রপ্তানি খাত বলতে বাংলাদেশে প্রধানত তৈরি পোশাক খাতকেই বোঝায়৷ বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগেরও বেশি এই খাত থেকে আসে৷
কিন্তু বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষ সাড়ে ছয় কোটি৷ আর পোশাক খাতে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন৷ তাই করোনায় ক্ষতির মুখে পড়ছেন এরকম সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের জন্য এখনো কোনো প্রণোদনা বা সহায়তার কথা ঘোষণা করা হয়নি৷ তাদের সাথে তাদের পরিবারও যুক্ত৷
ড. সেলিম রায়হান
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে এই করোনায় শিল্প ও ব্যবসা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি ব্যক্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ আবার শুধু রপ্তানিমূখী নয়, দেশীয় ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পও ক্ষতির মুখে পড়বে৷ অর্থনীতির প্রায় প্রত্যেকটি খাতই ক্ষতির মুখে৷ তাই এই প্রণোদনা বা সহায়তার জন্য সার্বিক পরিবল্পনা দরকার৷ শুধু রপ্তানিমূখী শিল্পে প্রণোদনা দিলে হবে না৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সাউথ এশিয়ান টেওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (এসএএনইম)-এর নির্বাহী পরিচাল ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, ‘‘দেশীয় বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও সেবা খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নিয়ে পরিকল্পনা প্রয়োজন৷ তাদের টিকিয়ে রাখতে প্রণোদনা দিতে হবে৷ শুধু পোশাক খাতকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনা করলে হবে না৷’’
দুই বছরের একটি রিকভারি প্ল্যানের প্রস্তাব করে তিনি বলেন, ‘‘এই রিকভারি প্ল্যান অনুযায়ী, আমাদের বাজেট ও পরবর্তী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করতে হবে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘এই করোনায় গরিব মানুষ আরো গরিব হবে৷ আর যারা এখন প্রান্তিক পর্যায়ে আছেন তারাও গরিব হয়ে যাবেন৷ যারা নিম্নবিত্ত তারাও ঝুঁকিরমধ্যে পড়ে গেছেন৷ তাই সবাইকে এখন সামাজিক নিরাপত্তা নেটের মধ্যে আনতে হবে৷ আর কর, ব্যাংকিং ও বাণিজ্য খাতে সংস্কার আনতে হবে৷’’
সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন প্রণোদনার পরিকল্পনা করা দরকার ব্যাপকভিত্তিক৷ তিনি বলেন, ‘‘দেশীয় বাজারভিত্তিক এসএমই খাত, কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প, পোল্ট্রি, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, সেবা খাত, পর্যটন, হাসপাতাল, হোটেল রোস্তোরাঁ- সবাই ক্ষতিগ্রস্ত৷ তাদের দুই ধরনের প্রণোদনা দরকার৷ রিভলবিং ফান্ড আকারে স্বল্প সূদে ঋণ দেয়া দরকার, যাতে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত রাখতে পারেন, শ্রমিকদের বেতন দিতে পারেন৷ আবার রাজস্বের দিক থেকেও প্রণোদনা দেয়া যায় ভ্যাট, ট্যাক্স মওকুফ বা রেয়াত দিয়ে৷’’
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
তবে সাধারণ মাানুষকে বাঁচাতে বড় উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি৷ আর এজন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতে হবে৷ চালু থাকা ওএমএস আরো বিস্তৃত করতে হবে৷
বাংলাদেশে করোনায় অর্থনীতির ক্ষতি কী পরিমাণ হবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না৷ তবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, জিডিপির শূণ্য দশমিক ৬ ভাগ অবনমন হতে পারে৷ কিন্তু গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, করোনা কোথায় শেষ হবে তা বলা মুশকিল৷ এটা বিশ্ব অর্থনীতিতেও ব্যাপক আঘাত হানছে৷ তার প্রশ্ন, ‘‘বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে ৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ কাজ করে৷ ৮০ ভাগ রপ্তানি করে এমন পোশাক খাতে শ্রমিক আছেন ৪০ লাখ৷ তাহলে বাকি ৫ কোটি ৯০ লাখ মানুষের কী হবে?’’
তিনি মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতে এখনই বড় বরাদ্দ প্রয়োজন৷ তা না হলে ক্ষতি আরো বাড়বে৷ তাই তার প্রস্তাব, এই বাজেটে বিভিন্ন খাতে অনেক অব্যবহৃত অর্থ আছে, সেই অর্থ স্বাস্থ্য এবং সামাজিক খাতে ব্যয় করা হোক৷ আর আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে৷
২০ মার্চের ছবিঘর দেখুন...
অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে কোন দেশ কী করছে
করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে৷ প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হওয়াসহ আছে সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কা৷ তবে উন্নত দেশগুলো এই পরিস্থিতি সামলাতে বিভিন্ন আর্থিক ব্যবস্থাও নিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Jordan
জার্মানি
সব ধরনের কোম্পানি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ১১০ কোটি ডলারের ঋণ দিচ্ছে জার্মান সরকার৷ দুর্যোগকালীন এই পরিস্থিতি সামাল দিতে মোট ৮০ হাজার কোটি ডলারের তহবিল রয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্বচ্ছলতা বজায় রাখতে দেয়া হচ্ছে কর-ছাড়৷ দেরিতে ঋণ পরিশোধে গুণতে হবে না জরিমানা৷ প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে দেয়া হবে সাড়ে ১৪ কোটি ইউরো৷
অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দিতে ২১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছে স্পেন৷ ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানি, কর্মী আর আর্থিক অস্বচ্ছলদের সুরক্ষায় এই অর্থ ব্যয় করা হবে৷ এর মধ্যে শুধু সামাজিক নিরাপত্তায় খরচ করা হবে প্রায় ৬৪ কোটি ডলার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AAB. Akbulut
পর্তুগাল
১৮ মার্চ থেকে ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে পর্তুগাল৷ এখন পর্যন্ত এক হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা ‘প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার৷ এরমধ্যে ৩২২ কোটি ডলার পর্যটন, বস্ত্র, কাঠসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণ সহায়তা হিসেবে দেয়া হবে৷ ৫৩৬ কোটি ডলার আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে কর সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে৷
ছবি: Reuters/M. F. Lopes
ফ্রান্স
প্রায় পাঁচ হাজার কোটি ডলার সহায়তা তহবিলের প্রকল্প হাতে নিয়েছে ফ্রান্স সরকার৷ এর বড় একটি অংশ দেয়া হবে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে৷ রেস্টুরেন্ট, দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কোয়ারান্টিনের কারণে যেসব কর্মী কাজে যোগ দিতে পারছেন না, তাদের জন্য কয়কশ’ কোটি ডলার ব্যয়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Marin
যুক্তরাজ্য
করোনা ভাইরাসের কারণে ১৪৫০ কোটি ডলারের জরুরি আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে যুক্তরাজ্য৷ জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা এবং সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লোকসান মেটাতে এই টাকা দেয়া হবে৷ পাশাপাশি খুচরা ব্যবসা এবং পর্যটন শিল্পের জন্য ৪০ হাজার কোটি ডলারের ঋণ তহবিলও রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/empics/PA Video
যুক্তরাষ্ট্র
সম্প্রতি ১০ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের একটি সহায়তা প্যাকেজের অনুমোদন দিয়েছে সেনেট৷ স্বাস্থ্য বিমা ছাড়াই করোনার পরীক্ষা করানো, স্কুলগামী শিশুদের জন্য খাবার সরবরাহ, কর্মীদের ১০ দিনের অসুস্থতাজনিত এবং কিছু ক্ষেত্রে ১২ সপ্তাহের বেতনসহ ছুটির পেছনে এই টাকা ব্যয় হবে৷ পাশাপাশি এক ট্রিলিয়ন ডলারের আরেকটি প্রণোদনা প্যকেজের জন্য আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন৷
ছবি: Reuters/L. Millis
ক্যানাডা
ক্যানাডার জন্য পাঁচ হাজার ৬৪০ কোটি ডলারের সহায়তা দেয়ার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো৷ এই অর্থ দেশটির জিডিপির তিন শতাংশ ৷ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর-ছাড়, কর্মীদের বেতন, সমাজে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ব্যয় হবে এই অর্থ৷
ছবি: picture-alliance/empics/M. Sudoma
অস্ট্রেলিয়া
১১০০ কোটি ডলারের আর্থিক প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার৷ ৬৫ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষকে এককালীন ৪৫১ ডলার করে দেয়া হবে এই তহবিল থেকে৷ পাশাপাশি এক লাখ ২০ হাজার শিক্ষানবিশ চাকুরিজীবী এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতেও খরচ করা হবে এখান থেকে৷ অন্যদিকে অর্থনীতিকে সচল রাখতে ঋণের সুদহার কমিয়ে দিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Carrett
তুরস্ক
করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ১৫৪০ কোটি ডলারের ব্যয় পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে তুরস্ক৷ ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা’ শিরোনামের এই প্যাকেজটির আওতায় মোট ২১ টি খাতে খরচ করা হবে৷ এর মধ্যে অবসরকালীন ভাতা বৃদ্ধি, ব্যবসা সহযোগিতা, মূল্য সংযোজন কর হ্রাসসহ খুচরা, ইস্পাত, গাড়ি ও পর্যটন শিল্পে আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে৷