গ্রামীণ ব্যাংক ধ্বংসের যে কোনো উদ্যোগ দেশের মানুষই প্রতিহত করবে বলে জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ তাঁর মতে, সরকার নয়, জনগণ যা চায় তাই হবে৷ গ্রামীণ ব্যাংক কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না৷
বিজ্ঞাপন
ব্যাংকের পরিচালকরা বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষায় দেশের মানুষ তাঁদের পাশে থাকবে৷
ঢাকায় শুক্রবার সামাজিক ব্যবসা দিবস বা সোশ্যাল বিজনেস ডে'র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ স্বাভাবিক কারণেই সেই অনুষ্ঠানে গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে সরকারের এই সময়ের কিছু তত্পরতা ও সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলেন তিনি৷ জবাব দেন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও৷
গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার ৫১ ভাগে উন্নীত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়া এবং ব্যাংককে ভেঙে ১৯ টুকরা করা প্রসঙ্গে সাংবদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘যে ব্যাংক দেশের জন্য অবদান রেখেছে, সেই ব্যাংককে এভাবে ধ্বংস হতে দেওয়া হবে না৷ এটা মানুষের প্রতিষ্ঠান, মানুষই তা প্রতিহত করবে৷ সরকার কি চায় সেটা হবে না, জনগণ কি চায়, সেটাই হবে৷''
তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের নারী সদস্য এবং নির্বাচিত নারী পরিচালকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘‘আমরা আপনাদের পাশে থাকব৷ আপনাদের ব্যাংক কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না৷''
মুহাম্মদ ইউনূসের আরেকটি অর্জন
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক গ্রহণ করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ বুধবার ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল ভবনের রোটান্ডায় ইউনূসের হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন জন বোয়েনার৷
ছবি: Getty Images
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা
বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঝুড়িতে আরেকটি সম্মাননা যোগ হলো৷ বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক গ্রহণ করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা৷ তবে নিজের দেশে বর্তমানে বেশ চাপের মধ্যে আছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ইউনূস৷
ছবি: Getty Images
সম্মাননা গ্রহণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উভয় কক্ষের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল ভবনের রোটান্ডায় অধ্যাপক ইউনূসের হাতে সম্মাননা তুলে দেন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার জন বোয়েনার৷ এসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট নেতা ন্যান্সি পেলোসি (বামে)৷
ছবি: Getty Images
বাংলাদেশের মানুষকে উৎসর্গ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল গ্রহণ করার পর ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘‘সকলে আমার কাজে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন বলেই ক্ষুদ্রঋণের ধারণাটি আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত৷ আমি এ সম্মান বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্যে উৎসর্গ করলাম৷’’
ছবি: Getty Images
‘প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক’
এর আগে ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি মর্যাদাশীল সম্মাননা অর্জন করেন ইউনূস৷ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক’ পান ড. ইউনূস৷ সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী এই সম্মাননা দেওয়া হয়৷
ছবি: AP
অন্য উচ্চতায় ইউনূস
বলাইবাহুল্য, ইউনূস হচ্ছেন প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি নোবেল পুরস্কার জয়ের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি মর্যাদাশীল সম্মাননা অর্জন করেছেন৷ গোটা বিশ্বে মাত্র সাতজন জীবদ্দশায় এই তিনটি সম্মাননা পেয়েছেন৷ এরা হচ্ছেন নরম্যান বারলগ, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলা, এলি উইসেল, অং সান সু চি, মাদার টেরেসা এবং সর্বশেষ মুহাম্মদ ইউনূস৷
ছবি: AP
গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা
গরিব মানুষ বিশেষ করে নারীদের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার জন্য ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন মুহাম্মদ ইউনূস৷ আধুনিক ক্ষুদ্রঋণের জনক বলা হয় তাঁকে৷ গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্রঋণকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন তিনি৷ ক্ষুদ্রঋণের এই ধারণা অধ্যাপক ইউনূসকে গোটা বিশ্বেই সম্মানজনক পরিচিতি এনে দিয়েছে৷
ছবি: AP
শান্তিতে নোবেল জয়
২০০৬ সালের যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয় করেন অধ্যাপক ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক৷ সেবছরের ডিসেম্বরে নরওয়ের রাজধানী অসলো’র টাউন হলে এই সম্মাননা গ্রহণ করেন অধ্যাপক ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধি তসলিমা বেগম৷
ছবি: AP
রাজনীতির ইচ্ছা এবং বিড়ম্বনা
শান্তিতে নোবেল জয়ের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশের ঘোষণা দেন অধ্যাপক ইউনূস৷ তবে এই সিদ্ধান্ত থেকে দ্রুতই সরে আসেন তিনি৷ কিন্তু অনেকেই মনে করেন, রাজনীতিতে নামার এই বাসনার কারণে পরবর্তীতে অনেক রাজনীতিবিদের চক্ষুঃশূল হন তিনি৷
ছবি: AP
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ‘বিদায়’
শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বেশ খানিকটা চাপের মধ্যে রয়েছেন৷ বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে অব্যাহতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক৷ এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়েছেন ইউনূস৷ এখন (১৮.০৪.১৩) পর্যন্ত ব্যাংকটিতে নতুন কোন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ সম্ভব হয়নি৷
ছবি: dapd
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ?
যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনো অধ্যাপক ইউনূসকে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে স্বীকার করেননি৷ তবে একথা বহুদিন ধরে চালু যে, অধ্যাপক ইউনূসের উপর কোন কারণে নাখোশ শেখ হাসিনা৷ যেকারণে চলতি সরকারের মেয়াদে নিজ দেশ বিভিন্ন ইস্যুতে চাপে আছেন মুহাম্মদ ইউনূস৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
এখানেই শেষ নয়৷ অর্থমন্ত্রীর এক বক্তব্যের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘‘আমাকে সরিয়ে দেয়ার পর যদি ব্যাংক ভালো চলে, তবে গ্রামীণ ব্যাংককে নষ্ট করে দেয়ার দরকার নেই৷''
বিশ্বের ৩০টি দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে ঢাকায় সামাজিক ব্যবসার এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে ইউনূস সেন্টার৷ ড. ইউনূস জানান, এই অনুষ্ঠানে আসা বিদেশি মেহমানরা গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে উদ্বিগ্ন৷
এদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালকদের একজন তাহসিনা খাতুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য তিনিসহ ব্যাংকের পরিচালকরা সবাই শুনছেন৷ তাঁরাও সামাজিক ব্যবসার সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন৷ ড. ইউনূসের বক্তব্য তাঁদের আরো সাহসী করেছে, অনুপ্রেরণা দিয়েছে৷ তাঁরা কোনোভাবেই তাঁদের ব্যাংক অন্য কারুর হাতে তুলে দেবেন না৷ দেবেন না ব্যাংকের কাঠামো পরিবর্তন করে ব্যাংককে টুকরো টুকরো করতে৷ তিনি বলেন, তাঁরা ব্যাংকের পরিচালক এবং সদস্যরা ঐক্যবদ্ধ আছেন এবং থাকবেন৷ তাহসিনা খাতুন জানান, এই ব্যাংক রক্ষায় শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, সারা বিশ্বের মানুষ তাঁদের সঙ্গে থাকবেন বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন৷
তাঁরা গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষায় কোনো আন্দোলনে যাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তাহসিনা খাতুন বলেন, সরকারের পদক্ষেপের উপরই নির্ভর করবে তাঁরা কি করবেন৷ সরকার ইতিমধ্যেই বলেছে, ব্যাংকের কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হবে না৷ এতে তাঁরা কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন৷ তবে ব্যাংকের শেয়ার নিয়ে সরকারের অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়৷ সরকারের স্পষ্ট অবস্থান জানার পরই তাঁরা এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন৷