ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনা কঠিন। কিন্তু সিলেবাসে রাজনৈতিক মতাদর্শ গুঁজে দেওয়া সহজ।
বিজ্ঞাপন
ভারতের স্কুলিশিক্ষার ক্ষেত্রে একাধিক বোর্ড আছে। প্রতিটি রাজ্যের যেমন নিজস্ব শিক্ষাবোর্ড আছে, তেমনই আছে কেন্দ্রীয় শিক্ষাবোর্ড। এদেশে রাতারাতি সিলেবাস বদলে ফেলা সহজ নয়। আবার খুব কঠিনও নয়।
নব্বই সালের কথা মনে পড়ছে। আমরা তখন স্কুলছাত্র। দেখতাম, বাড়িতে বাবা-জেঠুদের বন্ধুরা, পরিচিতরা নিয়মিত আসছেন এবং গভীর বৈঠকে বসছেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই খবরের কাগজে হেডলাইন-পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রম থেকে তুলে দেওয়া হচ্ছে ইংরেজি। খুব ভুল না করলে, সম্ভবত অষ্টম শ্রেণি থেকে ইংরেজি পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে দিকে দিকে তখন পক্ষে বিপক্ষে সভা চলছে। আমাদের বাড়িতেই দুইটি বিতর্ক সভার আয়োজন করা হয়েছিল বলে মনে পড়ে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরা সেখানে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা করেছিলেন।
খুব সহজে কি সেই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল? বলাই বাহুল্য, না। স্কুলের সিলেবাস কী হবে, তা ঠিক করার জন্য নির্দিষ্ট কমিটি থাকে। গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাবিদেরা সেখানে থাকেন। বহু আলোচনা, বাইরে থেকে মতামত গ্রহণ করেই সিলেবাসের কাঠামোগত পরিবর্তন করা হয়। ইংরেজি তুলে দেওয়া তেমনই এক কাঠামোগত পরিবর্তন ছিল। এবং এই ধরনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত সরকারের শিলমোহর লাগে। সরকার সবুজ সংকেত দেওয়ার পরেই তা শিক্ষাব্যবস্থায় লাগু হয়। ৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গে সেই কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছিল। যদিও খুব বেশিদিন তা চলতে পারেনি। কিছু বছরের মধ্যেই সেই কাঠামোর ফের পরিবর্তন করা হয়। এখনো মনে পড়ে, সরকারের সেই পরিবর্তন নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। সিলেবাস কমিটির বেশ কিছু সদস্যও ওই পরিবর্তন মেনে নিতে পারেননি।
অতি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার স্কুল শিক্ষার কাঠামোয় বেশ বড় রকমের পরিবর্তনের প্রস্তাব এনেছে। পরীক্ষাব্যবস্থা, প্রশ্নের ধরন, সিলেবাসের চলন-- এই সবকিছু নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে সেই প্রস্তাবে। নিউ এডুকেশন পলিসি বা ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি নামে পরিচিত ওই প্রস্তাব নিয়েও তীব্র বিতর্ক হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের এই নতুন শিক্ষানীতিআসলে শিক্ষাব্যবস্থাকে গেরুয়াকরণের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্র তা মানছে না। কেন্দ্রীয় শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে নতুন শিক্ষানীতি চালু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গসহ বহু রাজ্যই এখনো তা গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশের শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতি
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল৷ বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খুদা এর প্রধান ছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খুদাকে চেয়ারম্যান করে দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল৷ কুদরত-ই-খুদা কমিশন নামে পরিচিতি পাওয়া এই কমিশন ১৯৭৪ সালে রিপোর্ট পেশ করেছিল৷ এতে শিক্ষার সবস্তরে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা চালু এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল৷
ছবি: Imago/epd
উল্লেখযোগ্য সুপারিশ
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বড় ধরনের পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিল কুদরত-ই-খুদা কমিশন৷ প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক শিক্ষার মেয়াদ নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করার সুপারিশ করেছিল৷ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি চার বছর মেয়াদি সম্মিলিত ডিগ্রি কোর্স এবং এক বছরের মাস্টার্স কোর্স চালুর সুপারিশ করা হয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
কমিটি গঠন
কুদরত-ই-খুদা কমিশনের সুপারিশের আলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও সিলেবাস প্রণয়নের জন্য অধ্যাপক সামছুল হুদাকে প্রধান করে ১৯৭৬ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল৷ কমিটি ১৯৭৬, ১৯৭৭ এবং ১৯৭৮ সালে সাত খণ্ডে সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেছিল৷ সুনির্দিষ্টভাবে একমুখী ও সমরূপ মাধ্যমিক শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের সুপারিশ করেছিল ঐ কমিটি৷
ছবি: Md Rafayat Haque Khan/Eyepix/IMAGO
মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৮২
এরশাদ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. আবদুল মজিদ খানের নেতৃত্বাধীন শিক্ষা কমিশন ১৯৮২ সালে একটি শিক্ষা নীতি প্রস্তাব করেছিল৷ এতে প্রথম শ্রেণি থেকে বাংলার সঙ্গে আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি ভাষা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়৷ এছাড়া যারা ৫০ শতাংশ ব্যয় বহন করতে পারবে, ফল খারাপ হলেও তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল৷ কিন্তু পরে তীব্র আন্দোলনের কারণে কমিশনের কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি৷
ছবি: Md Rafayat Haque Khan/Zuma/picture alliance
মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৭
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর মফিজউদ্দীন আহমদকে প্রধান করে ১৯৮৭ সালে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়৷ তাদের রিপোর্টে তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি কোর্স এবং দুই বছরের মাস্টার্স কোর্স প্রবর্তন এবং ডিগ্রি কলেজগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের সুপারিশ করা হয়৷ এছাড়া বড় জেলা, বিভাগীয় শহর ও রাজধানীতে একটি করে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এম শামসুল হককে চেয়ারম্যান করে ১৯৯৭ সালে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়৷ শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা দান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তাদের অনুপ্রাণিত করার কথা বলেছিল ঐ কমিশন৷ এছাড়া কমিটি একটি শিক্ষানীতিও প্রণয়ন করেছিল, যেটি ২০০০ সালে সংসদে গৃহীত হয়৷ কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি৷
ছবি: Sony Ramany/NurPhoto/picture alliance
এম.এ বারী শিক্ষা কমিশন, ২০০১
ড. এম এ বারীর নেতৃত্বাধীন এই কমিটি ২০০২ সালে রিপোর্ট পেশ করে শিক্ষাক্ষেত্রে কতিপয় সংস্কার ও পরিবর্তনের সুপারিশ করে৷ এসব সুপারিশ ২০০৩ সালে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশন কর্তৃক বিবেচনায় আনা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশন, ২০০৩
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বাধীন এই কমিশনের রিপোর্ট তিন ভাগে বিভক্ত ছিল: সাধারণ শিক্ষা, পেশাগত শিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষা৷ ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, লিঙ্গ, আর্থিক অবস্থা ও ভৌগোলিক অবস্থানের পার্থক্য নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষালাভের সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার অধিকতর সুযোগ সৃষ্টির সুপারিশ করেছিল৷
ছবি: Md Rafayat Haque Khan/Eyepix/IMAGO
কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন, ২০০৯
২০০০ সালের শিক্ষানীতিকে সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়৷ এই কমিটি ১৯৭৪ সালের কুদরাত-ই-খুদা কমিশন রিপোর্ট এবং ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের আলোকে একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে৷ সেটি ২০১০ সালে সংসদে গৃহীত হয়৷
ছবি: Bdnews24.com
বাস্তবায়ন কত দূর?
শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণির বদলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবে৷ কিন্তু সেটি হয়নি৷ মাধ্যমিক শিক্ষা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা বলা হয়েছিল৷ এজন্য উচ্চবিদ্যালয়গুলোতে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি সংযোজন করার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি৷ শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো হয়নি৷ শিক্ষক নিয়োগে পিএসসির মতো কমিশন হয়নি৷ শিক্ষা আইন হয়নি৷ স্থায়ী শিক্ষা কমিশনও হয়নি৷
ছবি: Sony Ramany/NurPhoto/picture alliance
নতুন শিক্ষাক্রম
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা ২০২২ সালে অনুমোদিত হয়৷ এরপর এ বছর থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে৷ ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে; ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে৷ একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে৷
ছবি: Habibur Rahman/abaca/picture alliance
কী আছে?
নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার চেয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে৷ তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে৷ পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম দুটোই আছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দশম পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাস
শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাসে পড়বে৷ আর তারা বিজ্ঞান, মানবিক, না বাণিজ্য বিভাগে পড়বে, তা ঠিক হবে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে৷ এছাড়া এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ধরণ এখনকার মতো হবে না৷ শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা৷ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পরীক্ষা হবে৷ প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে৷ এরপর দুই ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে৷
ছবি: Salim/Xinhua/picture alliance
শেখার ক্ষেত্র
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে৷ এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি৷ প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকেরাই শেখাবেন৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
14 ছবি1 | 14
ভারতের সংবিধানে ৪২ নম্বর ধারায় শিক্ষা বিষয়ক আলোচনা আছে। মনে রাখা দরকার, ভারত একটি ফেডারেল স্টেট বা যুক্তরাজ্যীয় রাষ্ট্র। এখানে রাজ্যের হাতে কিছু ক্ষমতা থাকে, কেন্দ্রের হাতে কিছু ক্ষমতা থাকে। সংবিধান সেই ক্ষমতা ভাগ করে দিয়েছে। সংবিধানের ৪২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে শিক্ষা স্টেট সাবজেক্ট বা রাজ্যের বিষয়। ফলে প্রতিটি রাজ্য তার নিজস্ব শিক্ষা নীতি ঠিক করতে পারে। এবং সেই শিক্ষানীতি নির্দিষ্ট কমিটির হাত ঘুরে সরকারের কাছে পৌঁছায়। ১৯৭৬ সালে এই ধারায় একটি সংশোধন আনা হয়। শিক্ষা যৌথ বিষয় বা কনকারেন্ট লিস্টে গৃহীত হয়। অর্থাৎ, কেন্দ্র এবং রাজ্যের সমানাধিকার থাকবে শিক্ষার বিষয়ে। এর মূল কারণ, কেন্দ্র এবং রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা।
যৌথ বিষয় হলেও, কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি সম্পূর্ণভাবে মানতে বাধ্য নয় রাজ্য। আবার কোনো রাজ্যের নির্দিষ্ট শিক্ষানীতি মানতে বাধ্য নয় ওই রাজ্যেই অবস্থিত কেন্দ্রীয় শিক্ষাকেন্দ্র। সকলেই তার নিজস্ব রাস্তায় চলতে পারে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার জন্য কেন্দ্র এবং রাজ্য নিজেদের শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা করে, একটি মূলগত সমতা বজার রাখআর চেষ্টা করে।
শিক্ষার পরিকাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এখনো কেন্দ্র এবং রাজ্য এই ভারসাম্য বজায় রেখেই চলছে। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষাব্যবস্থায় সাংঘাতিক কোনো তফাত নেই। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে, সিলেবাসে আমূল তফাত তৈরি হচ্ছে। আর এর সবচেয়ে বড় কারণ রাজনীতি।
একসময় স্কুল সিলেবাসে সামান্য পরিবর্তন হলেও তা নিয়ে রীতিমতো আলোচনা হতো। সরকার আইনসভার ভিতর এবং বাইরে বিতর্ক আহ্বান করতো। ইদানীং সে সব চল আর নেই বললেই চলে। কথা নেই বার্তা নেই, সিলেবাস বদলে দেওয়ার এক আশ্চর্য চল শুরু হয়েছে গত কয়েক দশক ধরে। এবং এই সিলেবাস পরিবর্তন মূলত রাজনৈতিক।
কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গের স্কুলপাঠ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ানো হয়। ২০০৬ সালে ঘটে যাওয়া সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন স্কুলপাঠ্যে ঢোকানো হয়েছে। এর থেকে স্পষ্ট, স্কুলপাঠ্যকে আসলে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঠিক একইরকম ভাবে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) নিয়মিত জাতীয় স্কুলপাঠ্যের পাঠক্রম বদলে চলেছে। ইতিহাস বই থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে মুঘল আমল। দক্ষিণপন্থি রাজনীতির আলাদা চ্যাপ্টার যোগ করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের স্কুলপাঠ্য থেকে বাদ গেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা। যুক্ত হয়েছে বাবা রামদেবের লেখা। এই ধরনের পরিবর্তনকে ঠিক কাঠামোগত পরিবর্তন বলা যায় না। এই ধরনের পরিবর্তনের জন্য খুব বেশি কাঠ-খড়ও পোড়াতে হয় না। সন্তর্পনে এই কাজগুলি ধীরে ধীরে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর এইভাবেই পাঠক্রম নিয়ে রাজনীতি সমানে চলছে। গত কয়েকদশকে এই পরিবর্তনের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে ইদানীং তা নিয়ে কোথাও কোথাও আলোচনা, বিতর্ক শুরু হয়েছে।
ভারতের মতো বিরাট দেশে রাতারাতি শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামো বদলে ফেলা সহজ নয়। এখানে কমিটি গঠনের জন্যও কমিটি বসানো হয়। আলোচনার বিষয় স্থির করার জন্য আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। এর যেমন অনেক খারাপ দিক আছে, তেমন কিছু ভালো দিকও আছে। হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে। যে কোনো সিদ্ধান্তেই চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের সুযোগ বেশি। কিন্তু স্কুলপাঠ্য থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত একবার নেওয়া হয়ে গেলে তার পরিবর্তন করতেও অনেকটা সময় লেগে যায়। বলি হয়ে যায় একটা গোটা প্রজন্ম।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে পরীক্ষানিরিক্ষা শুরু করেছে, তার প্রভাবও আজ দেখা যাবে না। কয়েকদশক পর একটা আস্ত প্রজন্মকে এর জন্য ভুগতে হবে।