বসন্ত পঞ্চমীর দিন দিল্লির হযরত নিজামউদ্দিন দরগায় গান, ফুল, রঙের মধ্য দিয়ে পালিত হলো প্রেম আর আনন্দের উৎসব৷
বিজ্ঞাপন
চারপাশে শুধু বাসন্তীর সমারোহ৷ বাসন্তী রঙের চাদর, যা চড়ানো হবে দরগায়৷ তার ওপর উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সূর্যমূখির পাপড়ি৷ মাথায় বাসন্তী রঙের পাগড়ি, গলায় একই রঙের অঙ্গবস্ত্র জড়িয়ে চাদর ধরে আছেন জনা দশেক লোক৷ আশপাশের লোকের পোশাকেও একইরকমভাবে হলুদের ছোঁয়া৷ সঙ্গে গান, 'আজ বসন্ত মানা লে সুহাগন, আজ বসন্ত মানা লে৷' ঢোলকের বোলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাততালি৷ গান যে রাগে বাঁধা, তার নামও বসন্ত৷ এ ভাবেই বসন্ত পঞ্চমীর দিনে আনন্দে উতরোল হল দিল্লির হজযরত নিজামউদ্দিন দরগা৷ সুফি সাধকের দরগায় গান রোজই হয়। তবে তা কাওয়ালি৷ কিন্তু বসন্ত পঞ্চমীর উৎসবে সেখানে কেবলই বসন্তের গান৷
এখান থেকে পনেরো-কুড়ি কিলোমিটার দূরে শাহিনবাগ৷ যেখানে সিএএ নিয়ে একমাসের বেশি সময় ধরে বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে৷ শুধু শাহিনবাগই নয়, দিল্লির মোট তেরোটি জায়গায় চলছে এই ধরনের বিক্ষোভ৷ আর সেই প্রতিবাদকে সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে শুরু হয়েছে বিভাজনের রাজনীতিও৷ এই আবহে একেবারেই ব্যতিক্রমী হযরত নিজামউদ্দিন দরগার বসন্ত উৎসব৷ এখানে একটাই রঙ৷ বাসন্তী৷ উৎসবের রঙ, সম্প্রীতির রঙ, শান্তির রঙ, সৌহার্দ্যের রঙ৷
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ শুরু হল উৎসব৷ মূল প্রবেশদ্বারে পৌঁছলেন গাইয়েরা৷ সঙ্গে ঢোল৷ বিশাল চাদর হাতে তৈরি বাকিরা৷ হাতে সর্ষে ফুল নিয়ে সাজ্জাদা নাশিন শোনাতে শুরু করলেন কাহিনি৷ দরগায় বসন্ত উৎসব শুরুর কাহিনি৷ সৈয়দ আফসর আলি নিজামি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন সেই ইতিহাস৷ ''সাতশো বছর আগে হজরত নিজামউদ্দিনের ভাগ্নের অকালপ্রয়াণের পর সুফি সন্ত বিষন্ন হয়ে যান৷ মুখ থেকে হাসি চলে যায়৷ তাঁর এই অবস্থা দেখে প্রবল চিন্তিত হন সুফি কবি আমির খসরু৷ তিনি একদিন দরগা থেকে বেরিয়ে একটু দূরে গিয়ে দেখতে পান, কিছু লোক বাসন্তী পোশাক পরে বাসন্তী রঙা ফুল নিয়ে গান গাইছেন। তাঁদের কাছে খসরু জানতে চান, এ কীসের উৎসব? লোকেরা জানান, বসন্ত উৎসব। বসন্ত পঞ্চমীর দিন এভাবেই তাঁরা উৎসব পালন করেন৷ আর এ হল আনন্দের উৎসব৷ খসরু জানতে চান, এভাবে গেলে হজরত নিজামুদ্দিনের মুখে হাসি ফিরবে? তাঁরা বলেন, ফিরবে৷ খসরু তখন বাসন্তী রঙের পোশাক পরে, সর্ষে, সূর্যমুখি ফুল হাতে নিয়ে, বসন্তের গান গাইতে গাইতে ঢুকলেন দরগায়৷ দেখেই হযরত নিজামউদ্দিনের মুখে হাসি ফুটল৷ তারপর থেকে সাতশো বছর ধরে এভাবেই আনন্দের উৎসব পালন করা হচ্ছে দরগায়৷''
চাদর নিয়ে নিয়ে যাওয়া হল হযরত নিজামউদ্দিনের মাজারে৷ সঙ্গে গাইয়ের দল। ঢোলও৷ সৈয়দ গুলাম নিজাম বলছিলেন, ''এই একদিনই ঢোল ঢোকে মাজারের ভিতরে৷ এমনিতে রোজ সন্ধ্যায় কাওয়ালি হয়৷ তবে আজ শুধু বসন্তের গান৷ খসরুর নিজের লেখা, কিছু সংগ্রহ করে সামান্য বদল করে নেওয়া৷'' হজরত নিজামুদ্দিনের মাজার থেকে বেরিয়ে গাইয়েরা বসলেন সামনের চাতালে৷ চারপাশে ভিড় করে অজস্র মানুষ৷ হিন্দু-মুসলিম সকলেই আছেন৷ শুরু হল গান৷ 'আজ বসন্ত মানা লে৷' বারবার উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হলুদ ফুলের পাপড়ি৷ মাঝে মধ্যে গানের দলের ওপর টাকা বৃষ্টিও হচ্ছে৷ বসন্ত রাগের আবেশে, ঢোলের ছন্দে বাহিত হয়ে আনন্দের পরশ লাগছে লোকের মনে৷
বসন্ত উৎসবে মেতেছে গোটা বিশ্ব
শুভ নববর্ষ৷ অবাক হলেন? চীনে কিন্তু নববর্ষের সূচনা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই৷ তবে শুধু চীনেই নয়, ১৯শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষের কাছ বছরের শুভারম্ভ তো বটেই, বসন্ত উৎসবও! বেইজিং-এর রাস্তায় রাস্তায় তাই উৎসবের আমেজ৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
ঘোড়ার পরে এলো ছাগল
চীনা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ঘোড়াবর্ষ শেষ হয়ে শুরু হয়েছে ছাগলবর্ষ, অর্থাৎ ‘ইয়ার অফ দ্য গোট’৷ চীনাদের জন্য ছাগল নম্রতা, শান্তি এবং ভালোবাসার প্রতীক৷ ১২ বছর পর পর একবার ফিরে আসে এই ছাগলবর্ষ৷ আর এর মাঝের বছরগুলো অন্য একটি প্রাণীর নামে পরিচিত হয়৷ যেমন ড্রাগন, ইঁদুর, বাঘ, খরগোশ, সাপ, বানর, ঘোড়া ইত্যাদি৷
ছবি: picture alliance/ANN/The Straits Times
নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা
চীনা নববর্ষ হলো চন্দ্রবর্ষের সূচনা, যাকে বলে ‘লুনার ইয়ার’৷ ঈদ-দুর্গোৎসবের মতোই, নববর্ষ বা বসন্ত উৎসবে মানুষ দেশের বাড়ি যায়, যায় স্বজনদের কাছে৷ তাই যে সমস্ত অভিবাসী শ্রমিক সারা বছর দেশের বাইরে কাটান, তাঁরাও ফিরে আসেন নিজ পরিবারে৷ অন্তত একটা গোটা সপ্তাহ তাঁরা কাটিয়ে যান ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে৷ এর ফলে চীনের পরিবহন ব্যবস্থার ওপর ভীষণ চাপ পড়ে এ সময়৷
ছবি: Reuters
...এসো বসো আহারে...
বর্ষবরণের ঠিক একদিন আগে থেকেই শুরু হয় খাওয়া-দাওয়ার পালা৷ শুধু বর্তমান প্রজন্ম নয়, এতে যোগ দেন পরিবারের জ্যেষ্ঠ কর্তাব্যক্তিরাও৷ নানা-নানি, ঠাকুরমা-ঠাকুরদা, বাবা-মা, ছেলে-বুড়ো, নাতি-নাতনি – সবাই মিলে চলে মহাভোজ৷ উত্তর চীনে এ সময় ‘নিয়ান গাও’ নামের বিশেষ এক ধরনের ‘ডাম্পলিং’ বা পিঠা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি’
এ উৎসবের আর একটা বৈশিষ্ট্য হলো আতশবাজির খেলা৷ চীনা ঐতিহ্য অনুযায়ী, ভূতপ্রেত তাড়ানোর জন্য বাজি পোড়ানো হয় এই সময়৷ আতশবাজির আর রঙীন বাতির আলোয় বর্ণিল হয়ে উঠে শহর৷ কিন্তু বাজির বিকট আওয়াজে শব্দ এবং বায়ু দূষণের মাত্রাও বেড়ে যায়৷ এ কারণে চীনের প্রায় ১৩৮টি শহরে আতশবাজি নিষিদ্ধ করা হয়েছে এ বছর৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
সোনা, রূপা নয়, কাঠের ছাগলবর্ষ
শুধু চীনে নয়, তিব্বতেও চান্দ্র বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী নতুন বছর শুরু হয়৷ তবে সেটা হয় আরো একটা চন্দপক্ষের পর৷ রাজধানী লাসায় পোটালা প্রাসাদের সামনে শয়ে শয়ে মানুষ জড়ো হয়৷ তাঁদের পরনে রঙীন পোশাক, চোখে-মুখে আনন্দ৷ ১২টি প্রাণী ছাড়াও, তিব্বতিরা পাঁচটি মৌলিক উপাদানে বিশ্বাস করে৷ যেমন এ বছরের উপাদান হলো কাঠ৷ তাই বছরটা হলো ‘কাঠের ছাগলবর্ষ’৷
ছবি: China Photos/Getty Images
‘আজ আমাদের ছুটি রে ভাই...’
চীনে তো নববর্ষ এবং বসন্ত উৎসবে গোটা সপ্তাহটাই ছুটি৷ তবে চীনের বাইরে এশিয়ার অন্যান্য দেশের মানুষও বসন্ত উৎসব পালন করে৷ থাইল্যান্ডে যেমন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এ দিন মন্দিরে যান৷ প্রার্থনা করেন সুস্থ, সুন্দর জীবনের জন্য৷ হংকং এবং সিঙ্গাপুরেও বসন্ত উৎসবে সরকারি ছুটি থাকে৷ সেখানকার মানুষও তাই মেতে ওঠে আনন্দে৷
ছবি: Paula Bronstein/Getty Images
লাল রঙের উৎসব
চীন বা চীনের বাইরে যেখানেই বর্ষপূর্তি বা বসন্ত উৎসব পালন হোক না কেন, একটা রঙের প্রাচুর্য দেখা যায়৷ লাল৷ লাল রঙের বাতি, পোশাক-আশাক, লাল পাথরের অলংকার, লাল পর্দা – একেবারে লালে লাল হয়ে যায় সর্বত্র৷ এমনকি ছোটরা উপহার হিসেবে বখশিশটাও পায় লাল রঙের খামে৷ চীনা ভাষায় ‘লাল’ শব্দটির অর্থ যে ‘আনন্দ’-ও হয়!
ছবি: cc-by-sa-Calvin Teo
সিংহের প্রথাগত গর্জন
যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথমবারের মতো চীনা নববর্ষ ২০১৫ উদযাপন করা হবে৷ নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে তাই এবার থাকছে নানা আয়োজন৷ এই যেমন নিউ ইয়র্ক শহরে বড় আকারের ফায়ার ওয়ার্ক-এর আয়োজন করা হয়েছে৷ আবার সিয়াটেলে থাকছে বিখ্যাত সিংহ-নৃত্য৷ এই নাচ নাকি সমৃদ্ধির প্রতীক৷ তাই আজকাল বিশ্বের বহু ‘চায়না টাউন’-এই এই নাচ দেখা যায়৷
ছবি: cc-by-sa-Joe Mabel
জার্মানিতে চীনা সিংহ
ইউরোপের মধ্যে জার্মানির নর্থ রাইন ভেস্টফেলিয়া রাজ্যে চীনা নববর্ষ পালন করা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর যাবত৷ এর মধ্যে ড্যুসেলডর্ফ শহর তো গত প্রায় দশ বছর ধরে মেতে উঠেছে বসন্ত উৎসবে৷ চীনা অভিবাসীদের মধ্যে একটা বিরাট অংশের বাস এ শহরেই৷ তাই ইউরোপের মধ্যে এখানেই চীনা ঐতিহ্যের প্রাধান্য চোখে পড়ে৷
ছবি: Stadt Düsseldorf
9 ছবি1 | 9
গান শেষ হল, গাইয়েরা চললেন খসরুর মাজারে৷ তারপর অন্য মাজারেও৷ খসরুর মাজারের পাশের চাতালে আবার বসলেন তাঁরা৷ শুরু হল আরেক দফা গান৷ তারপর নামাজের বিরতি৷ মসজিদে গিয়ে প্রার্থনার সময়৷ তার আগেই মাজারের সামনে দুয়া হয়ে গিয়েছে, শান্তি ও সম্প্রীতি কামনা করে৷ নামাজ শেষ হতেই আবার শুরু হল বসন্তের গান৷ ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে৷ আঁধার নেমেছে৷ কিন্তু উৎসবের রঙ ফিকে হয়নি৷ গান শুরু হতেই বর্ষিত হতে থাকল ফুলের পাপড়ি৷ ছড়িয়ে গেল বসন্তের আমেজ ও আনন্দের লহরী৷