ঈদে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়ে জটিলতায় পড়তে পারে অন্তত ১ হাজার তৈরি পোশাক কারখানা৷ এই খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র এক জরিপে এই আশঙ্কার চিত্র উঠে এসেছে৷
বিজ্ঞাপন
শ্রম মন্ত্রণালয়ও এসব কারখানার একটি তালিকা তৈরি করছে৷ এসব কারখানার বেতন-বোনাস নিয়ে সৃষ্ট অসন্তোষ যাতে বড় আকারের শ্রম অসন্তোষে রূপ না নেয় তা নিয়ে সতর্ক সরকার ও মালিক পক্ষ৷ এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, গার্মেন্টস মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে করণীয় ঠিক করতে একাধিক বৈঠকও হয়েছে৷ বৈঠকে ঐসব কারখানার বেতন-বোনাস পরিশোধে বিশেষ নজরদারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিক-শ্রমিক সব পক্ষই৷
পোশাক শ্রমিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত
বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন সম্প্রতি গিয়েছিলেন একটি পোশাক কারখানায়৷ তাঁর অভিজ্ঞতা ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
অনিশ্চিত ভবিষ্যত
ঢাকার পূর্ব রামপুরার টিএম গার্মেন্টস-এর এই কর্মীরা জানেন না তাঁদের ভবিষ্যত৷ কারণ তাঁদের এখানে শ্রম আইন এবং মজুরি বোর্ড পুরোপুরি কার্যকর নেই৷ তাঁদের অগ্নিনিরাপত্তাও পর্যাপ্ত নয়৷ এমনকি ভবনটিও পুরনো৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
সংসার চালানো কষ্টকর
টিএম গার্মেন্টস-এর পোশাক কর্মী সুফিয়া বেগম যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালান কষ্টকর৷ তবুও তার এরচেয়ে বেশি কিছু করার সুযোগ নেই৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
সর্বনিম্ন বেতনও পান না
সর্বনিম্ন বেতন ৩০০০ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও রাহেলা আক্তার তা পান না৷ তাঁকে বেতন দেয়া হয় ২৫০০ টাকা৷ সে নতুন বলেই তাঁকে নাকি কম বেতন দেয়া হয়৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
নতুন, তাই বেতন কম
সুমি বেগমেরও বেতন অনেক কম৷ কারণ তিনিও নতুন৷ খরচে পোষায় না বলে তাঁরা পাঁচজন মিলে একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
গেটে তল্লাশি
এই পোশাক কর্মীদের গার্মেন্টস-এ প্রবেশ এবং বের হওয়ার আগে গেটে তল্লাশী চালানো হয়৷ আর ‘ফ্রেশ’ হতে গেলেও বলে যেতে হয়৷ আর ফিরতে যদি একটু দেরি হয়, তাহলে মেলে গালমন্দ৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ
ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন এঁরা৷ তাপ ওপর মেশিনপত্রও পুরনো৷ কাজ করতে গিয়ে পুরনো মেশিনপত্রের কোনো ক্ষতি হলে কখনো কখনো জরিমানাও করা হয় তাঁদের৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
রঙিন স্বপ্ন
রঙিন পোশাক আর রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আসেন কুড়িগ্রামের মৌসুমী৷ পোশাক কারখানায় কাজ নেয়ার পর ধীরে ধীরে তাঁর স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
শ্রমিকরা অপুষ্টির শিকার
আছিয়া বেগমকে দেখেই বোঝা যায় তিনি অপুষ্টির শিকার৷ সকাল-সন্ধ্যা গার্মেন্টস-এ কাজ করেও তিনি জোটাতে পারেন তাঁর প্রয়োজনীয় খাবার৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
8 ছবি1 | 8
মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে সমন্বয় করছেন বিজিএমইএ-র সহ-সভাপতি এস এম মান্নান কচি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, বিজিএমইএ প্রায় ১ হাজার কারখানার তালিকা করেছে যেগুলোতে বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ নিয়ে ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে৷ এসব কারখানাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে৷ এ লক্ষ্যে বিজিএমইএ'র নানামুখী উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, পহেলা রমজান থেকে ঈদের আগের রাত পর্যন্ত রাজধানীর বিজিএমইএ ভবনে ক্রাইসিস কন্ট্রোল রুম খোলা রয়েছে৷ এছাড়া ঢাকা, গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জসহ শ্রমিক অধ্যুষিত ও অসন্তোষপ্রবণ এলাকার সংকট তাৎক্ষণিক সমাধানের লক্ষ্যে ১৫টি টিম কাজ করছে৷ প্রতিটি টিমের নেতৃত্বে রয়েছেন বিজিএমইএ-র একজন করে পরিচালক৷ মালিকরা এ নিয়ে দিন-রাত কাজ করছেন৷
বিজিএমইএ-র হিসাবে দেখা গেছে, রানা প্লাজা পরবর্তী সময়ে কাজ না পাওয়া, কারখানায় কমপ্লায়েন্সের (কর্মপরিবেশ) অভাবসহ নানামুখী সংকটে পড়ে ১৭৬টি তৈরি পোশাক কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে৷ এর মধ্যে অনেক কারখানার শ্রমিকদের যথাযথ পাওনা পরিশোধ করা হয়নি৷ এসব শ্রমিকরা তাঁদের দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রায়শই রাজধানীর বিজিএমইএ ভবনের সামনে হাজির হচ্ছেন৷ সাম্প্রতিক সময়ে বিজিএমইএ ভবনের সামনে শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও দেনদরবার নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ঈদের আগে তারাও আন্দোলনে নামতে পারে৷
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?
ছবি: DW/M. Mohseni
8 ছবি1 | 8
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিজিএমইএ-র সদস্য বহির্ভূত প্রায় ১২শ' কারখানার মধ্যেও বেশ কিছু কারখানার বেতন-বোনাস পরিশোধে অনিশ্চয়তা রয়েছে৷ বর্তমানে বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত ৪ হাজার ৩শ' কারখানার মধ্যে চালু রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৩শ' কারখানা৷ এর বাইরে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সদস্যভুক্ত কারখানা রয়েছে আরো প্রায় ১ হাজার৷ গত ডিসেম্বরে নতুন মজুরি কার্যকর হওয়ার পর প্রথমবারের মত বর্ধিত নতুন মজুরির হিসাবে এসব কারখানাকে আসছে ঈদে বোনাসও দিতে হবে৷
রাস্তা অবরোধ
এদিকে বুধবার রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা প্রায় দুই ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে রাখে৷ তাদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে৷ পরে পুলিশের আশ্বাসে তারা অবরোধ তুলে নেয়৷
বাড্ডা থানার ওসি এম এ জলিল ডয়চে ভেলেকে বলেন, শ্রমিকদের অবরোধের জন্য বাড্ডা পূর্ব ও পশ্চিম পাশের সড়ক বন্ধ হয়ে যায়৷ মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলা হবে এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে শ্রমিকরা রাস্তা ছেড়ে অবরোধ তুলে নেন৷ তবে যে-কোনো সময় তারা আবার নামতে পারে এমন আশঙ্কাও তাঁর৷
অপরদিকে ২০ রমজানের আগেই পোশাক শ্রমিকদের বকেয়া বেতন বোনাস পরিশোধের দাবিতে মানববন্ধন করেছে নারী নেতৃত্বাধীন ৭টি পোশাক শ্রমিক ফেডারেশন৷ বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাঁরা এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে৷ ওই সাতটি সংগঠনের সমন্বয়কারী শহিদা সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, এই দুর্মূল্যের বাজারে পোশাক শ্রমিকরা সারা বছর যে বেতন-ভাতা পায় তা দিয়ে কোনোরকম খেয়ে পড়ে চলতে পারে৷ তাদের সঞ্চয় বলে কিছুই নেই৷ এ জন্য আগামী ২০ রমজানের মধ্যে সব শ্রমিকদের বেতন-বোনাসসহ সব রকম পাওনা বুঝিয়ে না দিলে আনন্দের ঈদ তাদের কাছে কষ্টের হয়ে উঠবে৷