সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা যেন শুধুই কেতাবি শব্দ
৩০ অক্টোবর ২০২০তখন ভারতের রাষ্ট্রপতি সদ্য প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়৷ ঠিক মনে পড়ছে না, তবে কোনো এক বিশেষ দিনে জাতির উদ্দেশে ভাষণে রাষ্ট্রপতি লম্বা সময় ধরে অসহিষ্ণুতা নিয়ে কথা বলেছিলেন৷ মোদ্দা বক্তব্য ছিল, সকলকে সকলের প্রতি সহিষ্ণু হতে হবে৷ সম্মান দেখাতে হবে৷ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, প্রণববাবু বুঝি এক ক্লাস লাগামহীন ছাত্রকে সভ্যতা শেখানোর মরিয়া চেষ্টা করছেন৷
ভারতে কি সত্যিই কোনোদিন সহিষ্ণুতা ছিল? সহনশীলতা নামক সোনার পাথরবাটির আদৌ কি কোনো জায়গা ছিল এই বিশাল উপমহাদেশে? থাকলে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা দেখতে হতো না৷ পঞ্চাশের দশকে একাধিক ছোটবড় সাম্প্রদায়িক হানাহানির ঘটনা ঘটতো না৷ ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ লেখা হতো না৷ দেশভাগের পর বিভক্ত পাঞ্জাবের ট্রেন থেকে সারি সারি লাশ নামতো না৷ রক্ত ঝরতো না কাঁটাতার ঘিরে৷ পৃথিবীর সব চেয়ে বড় শরণার্থীর ঢল খেয়া পারাপারের মতো দেশ পারাপার করতো না৷ আশির দশকে শিখনিধন যজ্ঞ হতো না৷ '৯২ সালে মসজিদ ভাঙা হতো না৷ দেশ জুড়ে অসংখ্য হানাহানির ঘটনা ঘটতো না৷
আর বর্তমান? যে সময়ে বসে মাস্টারমশাইয়ের মতো প্রণববাবু দেশের মানুষকে সম্প্রীতির, সহনশীলতার, সহিষ্ণুতার পাঠ দিচ্ছিলেন, সে ভারতে ফ্রিজে গোমাংস রাখার অভিযোগে মহম্মদ আকলাখকে খুন করা হচ্ছিলো৷ বর্তমান ভারতের মিডিয়ায় সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দগুলির অন্যতম ‘লাভ-জিহাদ’, ‘ঘরওয়াপসি’৷ হিন্দু মেয়ে মুসলিম ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করলে তা হলো লাভ-জিহাদ৷ হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করার চক্রান্ত৷ আর মুসলিম মেয়ে হিন্দু ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করলে তা হলো ঘরওয়াপসি৷ মানে হিন্দু ধর্মে ফিরে আসা৷ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে এ সবই ভারতে আলোচনার বিষয়বস্তু৷ টেলিভিশনের প্রাইম শো৷ কিসের সহিষ্ণুতা? কিসের সহনশীলতা?
আসলে গোটা পৃথিবী জুড়েই অসহিষ্ণুতার এক প্রবল ঢেউ উঠেছে৷ ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, জাতির নামে হানাহানি সর্বত্র৷ কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি নয়৷ অথচ জমি ছাড়া না গেলে সহিষ্ণু হওয়া যায় না৷ বহু শতক আগে আকবর সে কথা বুঝেছিলেন বলে যোধাবাঈকে বিয়ে করতে পেরেছিলেন৷ বিয়ের পর যোধাবাই নিজের ধর্মাচরণ করতে পেরেছিলেন৷ কী বলবেন তাকে, লাভজিহাদ? যদি তাই হতো, আকবর তা হলে সর্বধর্ম সমন্বয়ের দীন-ই-ইলাহি ধর্মের কথা ভাবতেন না৷ সকলকে মর্যাদা দেওয়ার কথা ভাবতে পেরেছিলেন বলেই মুঘল সম্রাট সকলকে নিজস্ব স্পেস দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন৷ আকবরের প্রাসাদ ফতেপুর সিক্রি তাই আজও ভালোবাসার প্রামাণ্য দলিল৷
নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের ভারতে বিভেদের মাঝে একটা মিলনের সুর ছিল৷ এখনো মুর্শিদাবাদে একই মানুষের নামে মহম্মদও থাকে আবার রামও থাকে৷ পেশায় রাজমিস্ত্রি মহম্মদ রাম সরকার ইটের উপর ইট গাঁথতে গাঁথতে লালনের গান করেন৷ এখনও৷ কিন্তু রাজনীতির তাতে অসুবিধা হয়৷ রাজনীতির অঙ্কে হিন্দু-মুসলিম-শিখ-খ্রিস্টান-- সবই সংখ্যা৷ ওই রবিঠাকুরের রক্তকরবীর মতো৷ কোন সংখ্যা কোন ভোটবাক্সে কাকে ভোট দেবে, তার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে এ দেশের রাজনীতি৷ শুধু বিজেপি কেন, তৃণমূল ধর্মের রাজনীতি করে না? মুসলিম ভোটের মেরুকরণ করতে গিয়ে বিভেদের যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে দেয় না? একদা বাম অধুনা তৃণমূলের পশ্চিমবঙ্গে কেন গত কয়েক বছরে একাধিক ছোট ছোট দাঙ্গা হয়ে গেল? একা বিজেপির ক্ষমতা ছিল সাম্প্রদায়িক লড়াই বাঁধানোর?
উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানার মতো রাজ্যে বিজেপি যা করছে, তা তো তথৈবচ৷ রাজধানী দিল্লিতে যে দাঙ্গা ঘটে গেল, তার দগদগে ঘা এখনো বর্তমান৷ গা শিউড়ে ওঠে ওই ক'দিনের কথা ভাবলে৷ করোনাকালেও যেভাবে কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীকে টার্গেট করা হয়েছে, কোনো সভ্য দেশে তা হয় না৷
আসলে ছাই চাপা আগুন এবং অবিশ্বাসের জন্যই হয়ত দেশ ভাগ হয়েছিল '৪৭ সালে৷ ওই অবিশ্বাস, অসহিষ্ণুতা ছিল বলেই গত সাত দশকে আগ্নেয়গিরির মতো ধক ধক করে জ্বলে উঠেছে এক একটি এলাকা৷ বর্তমান সময়ে পৌঁছে সেই আগুন যেন দাবানল হয়ে গিয়েছে৷ সকলে দেখতে পাচ্ছেন৷ আগুনের ছ্যাঁকা সকলের গায়ে লাগছে৷ তাই প্রণববাবুকে দেশের সব চেয়ে বড় অভিভাবক হিসেবে পাঠ দিতে হয়েছিল৷ বড় দেরিতে পাঠ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন রাষ্ট্রপতি৷ অপরাধ করে ফেলার পরে পাঠ দিয়ে আর কী লাভ? লাভ যে খুব বেশি হয়নি, প্রতিদিন তা টের পাওয়া যাচ্ছে৷ হিন্দু এলাকায় রাজমিস্ত্রি মহম্মদ রাম সরকার কাজ করতে গেলে শুধু রাম বলে নিজের পরিচয় দেন৷ মুসলিম এলাকায় গেলে কেবলই মহম্মদ৷ সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা- ওসব যেন শুধুই কেতাবি শব্দ৷ আগে তো প্রাণ বাঁচুক!