বিতর্কিত মন্তব্য করায় জুড়ি নেই পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের৷ কিন্তু তাঁর দলের নেতারাও বিরক্ত হচ্ছেন এবার৷
বিজ্ঞাপন
পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের উদ্দেশ্যে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সর্বশেষ হুঁশিয়ারি, ‘‘মেরে হাত–পা ভেঙে দেব৷ দিদির ভাইয়েরা বেশি বাড়াবাড়ি করলে সোজা শ্মশানে পাঠিয়ে দেব৷’’এবং এমন গুন্ডামার্কা হুমকি দিলীপ ঘোষের মুখে এই প্রথম নয়৷ এর আগেও একাধিকবার তিনি এমন সুরে কথা বলেছেন, যা প্ররোচনার নামান্তর৷ অথচ এই রাজ্যেই একসময় রাজনৈতিক নেতা–নেত্রীরা তাঁদের বাগ্মিতার জন্য সুখ্যাত ছিলেন৷ জাতীয় সংসদেও বহু বাঙালি সদস্যের বুদ্ধিদীপ্ত ভাষণ এখনও ইতিহাস হয়ে আছে৷ সেখানে রাজনীতিকদের এই ভাষা কতটা মান বাড়াচ্ছে বাঙালিদের?
সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই: তথাগত রায়, বিজেপি নেতা
তুখোড় বক্তা হিসেবে খ্যাত বিজেপিরই প্রাক্তন সাংসদ, ত্রিপুরার প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায় টিভি বিতর্ক এবং রাজনৈতিক প্রচারসভায় তীক্ষ্ণ কটাক্ষ, টিকা–টিপ্পনি করার কারণে সুবিদিত৷ তাঁর কীরকম লাগে, যখন তাঁরই দলের একজন নেতা এই ভাষায় কথা বলেন? তথাগত রায় সরাসরি বললেন, ‘‘আমার ভাল লাগে না৷ এর বেশি কিছু এই মুহূর্তে বলতে আমি রাজি নই৷’’ কিন্তু প্রশ্নটা যেখানে সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক অবনমনের?তথাগত রায়ের বক্তব্য, ‘‘এটা আমার আদৌ মনঃপূত নয়৷ গণতন্ত্রের যে মূল চিন্তাভাবনা, এটা তার পরিপন্থী৷ কিন্তু বিভিন্ন সময়ে, কালের নিয়মে কিছু নেতা জন্মান, যাঁরা এই ধরণের ব্যাপারে আশ্রয় নেন৷ তার ফলে এটা প্রশ্রয় পায়৷ তারই ফলে আজকে এটার উদ্ভব হয়েছে৷ ব্যাপারটা চলছে৷ আমরা আশা করি কালের নিয়মে এই ব্যাপারটা আবার মিলিয়ে যাবে৷ চিরকাল থাকবে না৷ কিন্তু ততদিন আমাদের সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই৷’’
অর্থাৎ চলতি সময়ের ওপরেই দোষ দিচ্ছেন বর্ষীয়ান নেতা৷ যে সময়, যে সমাজ, তার শিক্ষাদীক্ষা, রুচিবোধ দিলীপ ঘোষের মতো নেতাদের তৈরি করছে৷ এবং সত্যি কথা বলতে, একা দিলীপ ঘোষ নন, অন্য দলেরও এমন কিছু নেতা–নেত্রী আছেন, যাঁদের ভাষণের ভাষা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়৷ এবং তথাগতবাবুর কথার প্রতিধ্বনি করেই বলতে হয়, সময় যতক্ষণ না বদলাচ্ছে, এই আকথা–কুকথার রাজনীতি সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই৷ এটাই চলছে, চলবেও৷
২০১৮ সালের ছবিঘরটি দেখুন...
বিজেপিকে চিনে নিন
ভারতে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি৷ বর্তমানে জাতীয় ও রাজ্যস্তরে সর্বাধিক প্রতিনিধিত্ব রাখা দলটি সদস্য সংখ্যায় বিশ্বের বৃহত্তম৷ ঐতিহাসিকভাবে হিন্দু-জাতীয়তাবাদী অবস্থানের বিজেপির গল্প এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. K. Singh
আদর্শগত উৎস
বিজেপিকে চিনতে হলে ‘সংঘ পরিবার’-এর অন্তর্গত হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলির উৎস আরএসএস অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে জানা দরকার৷ বিশ্বের বৃহত্তম এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মারাঠি চিকিৎসক কেশব হেডগেওয়ার৷ ১৯২৫ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি৷ ভি ডি সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণই আরএসএস-এর প্রধান উদ্দেশ্য৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরত্ব
কংগ্রেসের নেতৃত্বে চলা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে দূরে ছিল আরএসএস৷ ১৯৪০-এর দশকে সংগঠনের নেতা হিসেবে এম এস গোলওয়ালকর হিন্দু রাষ্ট্র গড়তে ব্রিটিশ বিরোধিতার বদলে ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার ডাক দেন৷ উল্লেখ্য, পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অটলবিহারী বাজপেয়ী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় সত্যাগ্রহীদের সাথে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ লিখিত মুচলেকা দিয়ে আন্দোলনে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে ছাড়া পান তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M.Desfor
দেশভাগ ও আরএসএস
দেশভাগের সময় আরএসএস পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের সাহায্য করে৷ আরএসএস ও বর্তমানের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কর্মীরা মনে করেন, দেশভাগ মুসলিমদের প্রতি নরম আচরণের ফল৷ এজন্য গান্ধী ও নেহরুকে বিশেষভাবে দায়ী মনে করেন তাঁরা৷ স্বাধীনতার পর কংগ্রেসকে ঠেকাতে ১৯৫১ সালে জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়৷ সেই জনসংঘই আসলে বিজেপির উৎস৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
জরুরি অবস্থা ও জনতা পার্টির জন্ম
১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন৷ বিক্ষোভে অংশ নেয়ার কারণে জনসংঘের অসংখ্য সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা শেষে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন৷ কংগ্রেসকে হারাতে অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলে যায় জনসংঘ, জন্ম নেয় জনতা পার্টি৷ নির্বাচনে জিতেও যায় জনতা পার্টি৷ প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই৷ স্বাধীন ভারতে সূচিত হয় হিন্দুত্ববাদীদের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ জয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিজেপির জন্ম
১৯৮০’র পর দল ও আরএসএসের দ্বৈত সদস্য হবার বিধান না থাকায় জন্ম নেয় ভারতীয় জনতা পার্টি৷ নতুন দলে নতুন সদস্য যোগ দিলেও, গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল পুরোনোদের দাপট৷ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন বাজপেয়ী৷ মূলত, ইন্দিরা হত্যার পর ভোটে খারাপ করার কারণেই নেতৃত্বে এই পরিবর্তন৷ তবে বিজেপির উত্থান শুরু ১৯৮৪ সালে৷ সে বছর দলের সভাপতি হন লালকৃষ্ণ আডবানি৷ রাম জন্মভূমির দাবিকে ঘিরে তাঁর নেতৃত্বেই শক্তিশালী হতে থাকে বিজেপি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Raveendran
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও বাবরি মসজিদ
নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই বিজেপি সরাসরি ধর্মের রাজনীতিতে নামে৷ বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির গঠনের দাবিতে সারা দেশ থেকে অযোধ্যার পথে রওয়ানা দেয় হাজার হাজার ‘করসেবক’৷ পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে উত্তেজিত জনতা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে৷ এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হন দু’ হাজারেরও বেশি মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
সরকার গঠন ও জোটের রাজনীতি
সাম্প্রদায়িক আবেগকে হাতিয়ার করে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি ১৬১টি লোকসভা আসনে জয়ী হয়৷ প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন অটলবিহারী বাজপেয়ী৷ কিন্তু ১৩ দিন পর, লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার গঠন করতে পারেনি বিজেপি৷ ১৯৯৬ সালে আঞ্চলিক দলগুলির একটি জোট সরকার গঠন করে৷ কিন্তু সেই সরকারের স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয়নি৷ ১৯৯৮ সালে আবার নির্বাচন হয়৷
ছবি: UNI
প্রথম এনডিএ সরকার
নির্বাচনে জিতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) সরকার গড়ে৷ জোটে অংশগ্রহণ করে সমতা পার্টি, অকালী দল, শিব সেনা, নিখিল ভারত আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্র কড়গম (এআইএআইডিএমকে), বিজু জনতা দল ও শিব সেনা৷ ১৯৯৯ সালে তাঁরা সংসদে ৩০৩টি আসন জিতলে বাজপেয়ী তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন৷ পাঁচ বছরের পূর্ণমেয়াদী এই জোট সরকার প্রতিরক্ষা ও সন্ত্রাসের মোকাবিলার পাশাপাশি নব্য-উদার অর্থনীতির ওপর জোর দেয়৷
ছবি: Imago/photothek/T. Koehler
দুর্নীতি ও দাঙ্গায় কোণঠাসা বিজেপি
বিজেপির জয়রথে প্রথম ‘বাধা’ গোধরা দাঙ্গা৷ তীর্থযাত্রীবাহী ট্রেনে আগুন লাগাকে ঘিরে প্রায় ২০০০ মানুষ মারা যান৷ তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতার নাম এই দাঙ্গার সাথে জড়ায়৷ বিজেপি-প্রধান বঙ্গারু লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে ওঠে দুর্নীতির অভিযোগ৷ সব মিলিয়ে বিপন্ন বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ জোট ২০০৪ সালে নতুন সরকার গড়ে৷ প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং৷
ছবি: AP
নেতৃত্বে কে? মোদী, না আডবাণী?
২০১৪’র লোকসভা নির্বাচনে জেতার পর নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত করে বিজেপি৷ অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, দলের নেতৃত্বের দায়ভার বর্ষীয়ান নেতা এল কে আডবানির ওপর বর্তানোর কথা উঠলেও, বাস্তবে তা হয়নি৷
ছবি: AP
মোদীর উত্থান
বিজেপির ইতিহাসে ব্যক্তিকেন্দ্রীক নির্বাচনী প্রচার মোদীর ক্ষেত্রেই প্রথম৷ পূর্ববর্তী সরকারের দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে মোদীর ‘গুজরাট মডেল’-কে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হয় প্রচারে৷ সুবক্তা মোদী শীঘ্রই হয়ে ওঠেন তরুণ প্রজন্ম থেকে সংবাদমাধ্যম, সকলের প্রিয়পাত্র৷ নির্বাচনের আগে বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে গেলেও, মোদীর প্রাক-নির্বাচন বক্তব্যের বড় অংশ জুড়েই ছিল ‘হিন্দুত্ব’৷
ছবি: picture alliance/AA/M. Aktas
মোদী থেকে ‘মোদীজি’
২০১৪ সালে বিজেপি ২৮২টি আসন জিতে ক্ষমতায় আসে৷ ভোটারদের কংগ্রেসের প্রতি অনাস্থার পাশাপাশি বিজেপির সাফল্যের আরেকটি কারণ ছিল আরএসএসের নিঃশর্ত সমর্থন৷ নরেন্দ্র মোদীই হন প্রধানমন্ত্রী৷ পিউ গবেষণা কেন্দ্রের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রথম বছরের তুলনায় বর্তমানে মোদীর জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে, যা ২০১৯-র নির্বাচনে কংগ্রেস-সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলির জন্যও নিঃসন্দেহে ভাবনার বিষয়৷