গাইবান্ধায় সাঁওতাল পল্লিতে আগুন দেয়ার ঘটনায় সর্বশেষ প্রকাশ হওয়া একটি ভিডিও ফুটেজ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে৷ ফুটেজে এক পুলিশ সদস্যকে সাঁওতালদের একটি বাড়িতে আগুন দিতে দেখা গেছে৷ তবে পুলিশ তা অস্বীকার করেছে৷
বিজ্ঞাপন
ভিডিওতে এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্বেই সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়৷ এ ব্যাপারে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশও আগুন দিয়েছে, দুর্বৃত্তরাও আগুন দিয়েছে৷'' তবে পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ তারা দাবি করছে, ‘‘পুলিশ আগুন দিতে নয়, আগুন নেভাতে গিয়েছিল৷''
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জে সাঁওতালদের জমিতে চিনিকলের আখ কাটাকে কেন্দ্র করে গত ৬ নভেম্বর সংঘর্ষ হয়৷ সংঘর্ষে তিনজন সাঁওতাল নিহত হন, আহত হন অনেকে৷ পুলিশের ৯ সদস্যও আহত হন৷ সংঘর্ষের পর সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে৷ সেই ঘটনার পর একমাসেরও বেশি সময় পার হয়েছে৷ এরইমধ্যে ঐ ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিলেও তাতে ঘটনার জন্য পুলিশকে দায়ী করা হয়নি৷ দায়ী করা হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য, ইউপি চেয়ারম্যানসহ ভূমি দস্যু ও তাদের সহযোগীদের৷
কিন্তু নতুন ভিডিও ফুটেজ পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে৷ বাংলাদেশের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং এবং একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এই সাড়ে তিন মিনিটের ফুটেজ প্রকাশ করেছে৷
আসরাফুল ইসলাম
ফুটেজে দেখা যায় প্রথমে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে একটি বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন৷ এরপর কাছে গিয়ে পুলিশের কয়েকজন সদস্য বাড়ির দরজায় লাথি মারছেন৷ তারপর একজন পুলিশ সদস্য আগুন দিচ্ছেন৷ এসময় সাদা পোশাকে একজন তাঁকে সহায়তা করেন৷ ঐ পুলিশ সদস্য আগুন ছড়িয়ে দেয়ার কাজও করেন৷ আগুন লাগানোর সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সদস্যরা পিছনে দাঁড়িয়ে থাকেন৷ আগুনে ঘরটি পুড়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সেখানে অবস্থান করেন৷
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন বলেন, ‘‘আমি ফুটেজটির কথা শুনেছি৷ তবে আমরাতো আগেই বলেছি পুলিশও আগুন দিয়েছে, ওরাও আগুন দিয়েছে৷ সেখানে পুলিশের সঙ্গে এমপিও ছিলেন৷ পুলিশকে সঙ্গে নিয়েই আগুন দেয়া হয়৷''
তবে গাইবান্ধা জেলার পুলিশ সুপার আসরাফুল ইসলাম ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন, ‘‘পুলিশ আগুন দিতে নয়, আগুন নেভাতে গিয়েছিল৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি নতুন এই ভিডিও ফুটেজটি এখনো দেখিনি৷
নূর খান
তবে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে এর একটি ব্যাখ্যা দেয়া হবে৷ ভিডিও ফুটেজটি সংগ্রহ করতে পারলে আমরা আমলে নেব৷''
গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুব্রত সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ আগুন দেয়নি৷ আমি ঐ ভিডিও ফুটেজ দেখিনি৷ যে ভিডিও ফুটেজ আমি দেখিনি তা নিয়ে কী তদন্ত করবো?''
এদিকে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ নিজেই আগুন দিয়েছে৷ পুলিশ এখন যা খুশি তাই করে৷ নিজেরা আগুন দিয়ে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়৷ এই পুলিশকে পুরোপুরি সংস্কার করা উচিত৷ তাদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন৷''
বন্ধু, এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই৷ তাই লিখুন নীচের ঘরে৷
ভূমিপুত্রদের আত্মত্যাগ, ঘরহারা শত পরিবার
৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও সাঁওতালদের সংঘর্ষ থামাতে গুলি চালায় পুলিশ৷ এতে তিন সাঁওতাল নিহত হন, আহত হন অনেকে৷ সেখানে গিয়ে ছবি তুলে এনেছেন খোকন সিং৷
ছবি: bdnews24.com
ঘটনার সূত্রপাত
৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও সাঁওতালদের সংঘর্ষ থামাতে গুলি চালায় পুলিশ৷ এতে তিন সাঁওতাল নিহত হন, আহত হন অনেকে৷ নিহতরা হলেন শ্যামল হেমব্রম, মংগল মান্ডি, রমেশ টুডু৷
ছবি: bdnews24.com
ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গুলি
সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের উপর গুলির নির্দেশ কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটরা দিয়েছিলেন বলে স্থানীয় থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন৷ সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়৷ তাদের ঘরে আগুন দেয়া হয় পুলিশের উপস্থিতিতেই৷
ছবি: bdnews24.com
উচ্ছেদ অভিযান
পরে পুলিশ-র্যাব ঐ দিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এক অভিযান চালিয়ে মিলের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে৷
ছবি: DW/K. Singha
বিক্ষোভের ঝড়
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপর গুলিবর্ষণের এই ঘটনায় সমালোচনা চলছে দেশজুড়ে৷ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে৷
ছবি: DW/K. Singha
ট্র্যাক্টর দিয়ে চিহ্ন মুছে দেয়া
একচালা ঘরগুলো পুড়িয়ে দেওয়ার পর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ট্র্যাক্টর দিয়ে মাটি সমান করে দিয়েছে৷ নির্যাতিত শালনি মুর্ম ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন পুড়ে যাওয়া ভিটা, মসজিদ, গির্জাঘর, মন্দির, ভূমি রক্ষা কমিটির অফিস ঘর৷ যেগুলোর চিহ্ন ট্র্যাক্টর চালিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে৷
ছবি: DW/K. Singha
ইতিহাস
সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল৷ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা ওই জমিতে কয়েকশ’ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস করে আসছিল কয়েক বছর ধরে৷ চিনিকল কর্তৃপক্ষ ওই জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে৷
ছবি: DW/K. Singha
খোলা আকাশের নীচে কয়েকশ’ পরিবার
চোখে মুখে অজানা আতঙ্ক নিয়ে এখনও খোলা আকাশের নীচে চারশ’ থেকে পাঁচশ’ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন৷ ক্যাথলিক মিশন ভিত্তিক সংগঠন ‘মাদার টেরেসা’ তিন কেজি করে চাল, আধা কেজি ভোজ্য তেল, এক কেজি করে আলু সরবরাহ করেছেন ক্ষুদ্র পরিসরে৷ প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল৷
ছবি: DW/K. Singha
ত্রাণ নিতে অস্বীকৃতি
উচ্ছেদ অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য দেওয়া সরকারি ত্রাণ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন মাদারপুর ও জয়পুর পল্লীর সাঁওতালরা৷
ছবি: DW/K. Singha
আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থলে
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল ১৩ নভেম্বর সাঁওতাল পল্লী পরিদর্শন করে ৬ নভেম্বরের ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আশ্বাস দিয়েছে৷ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের উপর হামলায় ইন্ধন দেওয়ার জন্য স্থানীয় এমপি আবুল কালাম আজাদ ও সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন৷
ছবি: bdnews24.com
চার সাঁওতাল গ্রেপ্তার
সংঘর্ষের পর গোবিন্দগঞ্জ থানার পুলিশ এ ঘটনায় দু’টি মামলা করে৷ গ্রেপ্তার করা হয় চার সাঁওতালকে৷ রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসাধীন সাঁওতালদের কোমরে দড়ি ও হাতকড়া পরানো নিয়ে গণমাধ্যমে খবর আসার পর হাইকোর্টে রিট আবেদনটি হয়৷ হাইকোর্টের নির্দেশের পর পুলিশ সাংবাদিকদের দেখলে হাতকড়া খুলে দেয়, সাংবাদিকরা চলে গেলে ফের হাতকড়া লাগিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা৷
ছবি: DW/K. Singha
সাঁওতালদের দাবি
সাঁওতালরা উচ্ছেদকৃত জমিতেই পুনর্বাসন, জমির চার পাশ থেকে চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাঁটাতারের বেড়া অপসারণ, আখ চাষ বন্ধ ও তাদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে৷ এছাড়াও এমপি আজাদ ও ইউপি চেয়ারম্যান বুলবুলসহ তাদের উচ্ছেদ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটে সহযোগিতাকারীদের বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে সাঁওতালরা৷